ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

বাংলাদেশের দুই মুখ : শহরের আলো, গ্রামের অন্ধকার

মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর ইসলাম
বাংলাদেশের দুই মুখ : শহরের আলো, গ্রামের অন্ধকার

বাংলাদেশ নামক যেই দেশটিতে জন্ম নেওয়ায় আমরা গর্ববোধ করি, সেই দেশের ভেতর যেন দুটি আলাদা পৃথিবী বসবাস করছে। যেই পৃথিবী দুটি অসমান্তরাল, যাদের গতি প্রকৃতির নেই কোনো মিল। একটি হলো সুসজ্জিত শহরের উন্নয়নের ছবি আর অন্যটি গ্রামের প্রতিকূলতার মধ্যে জীবনযুদ্ধের লড়াই। দিন দিন দেশ যেভাবে উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, ঠিক সেভাবেই গ্রাম ও শহরের মধ্যে বৈষম্যও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে সমাজের বাস্তবতার চিত্র যেন কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এমন কোনো ক্ষেত্র নাই যেখানে শহরের সঙ্গে গ্রামের বৈষম্য পরিলক্ষিত হচ্ছে না। স্বাভাবিকভাবে লক্ষ্য করলে আমরা শুধু আর্থিক বা প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্যগুলো দেখতে পাই। কিন্তু গভীরভাবে দৃষ্টিপাত করলে মানসিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষাগত, চিকিৎসা, প্রযুক্তিসহ নানান সুযোগ-সুবিধার বৈষম্য দেখতে পাই। স্বাধীনতার পর থেকে ৫৪ বছর ধরে শুধু শহর কেন্দ্রিকই উন্নয়ন হয়ে আসছে। অথচ বাংলাদেশের ৮০ ভাগ নাগরিক গ্রামে বাস করে। এই বড় একটি জনশক্তিকে অবহেলিত রেখে আমরা কোনো দিন উন্নয়নের মুখ দেখতে পাব না। গ্রাম ও শহরের উন্নয়নে সমতা আনয়ন করা কি অসম্ভব কোনো কিছু? গ্রামের মানুষজন কেন এত বঞ্চিত? রাষ্ট্র প্রধানদের উন্নয়নের দৃষ্টি গ্রামে আলোকপাত না করার কারণ কী? এমন অসংখ্য প্রশ্ন জনমনে জাগলেও, এর নেই কোনো উত্তর দাতা।

আমাদের ধ্যান ধারণার মতো বাস্তবতার কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। যেমন, শহর মানেই ঝলমলে আলো, সুযোগ-সুবিধা, আধুনিকতা, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্যসেবা, প্রযুক্তি, বিশাল বিশাল বিল্ডিং ও শিক্ষার সহজলভ্যতা আর গ্রাম বলতে কাদা-মাটি, কৃষি ক্ষেত্র, মূর্খ মানুষের আবাস এটাই বুঝে থাকি। শহরে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন ঘটছে, উঠছে ভবনের পাশে ভবন, ছড়িয়ে পড়ছে প্রযুক্তির ব্যবহার কিন্তু গ্রামে যুগের পর যুগ নেই কোনো পরিবর্তনের আলো। শিক্ষায় বৈষম্যের কথা মাথায় নিলে বাংলাদেশের ভবিষ্যত প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। কারণ গ্রাম ও শহরের শিক্ষায় আকাশ-পাতাল ফারাক। শহরের স্কুল-কলেজে রয়েছে আধুনিক সব সরঞ্জাম, যোগ্য শিক্ষক, কম্পিউটার ল্যাব, লাইব্রেরি এমনকি নামিদামী কোচিং সেন্টার। অন্যদিকে গ্রামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল অবকাঠামো এবং নেই কোনো আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার। দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শহরে অবস্থিত হওয়ায় গ্রামের শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষায় অনীহা তৈরি হচ্ছে। ফলে চাকরির বাজারে শহরের শিক্ষার্থীরা এগিয়ে যাচ্ছে আর গ্রামের শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়ছে। যা বৈষম্যকে আরও দীর্ঘমেয়াদে শক্তিশালী করছে।

স্বাস্থ্যসেবায় অমানবিক ব্যবধান উন্নয়নের সবচেয়ে বেদনাদায়ক দিক। শহরে আছে হাজারও উন্নত হাসপাতাল, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এবং অত্যাধুনিক চিকিৎসা প্রযুক্তি। সেই তুলনায় গ্রামে কিছুই নেই। না আছে চিকিৎসা সরঞ্জাম, না আছে ঔষধ। ফলে ভালো চিকিৎসা পাওয়ার আশায় গ্রামের মানুষজন শহরে দৌড়াচ্ছেন। চিকিৎসার অভাবে অনেক মানুষ মৃত্যুর মুখে পতিত হচ্ছেন।

গ্রামে কোনো কর্মসংস্থান না থাকায় লোকজন চাকরির জন্য শহরমুখী হতে বাধ্য হচ্ছেন। ফলে গ্রামে জনশূন্যতা বাড়ছে এবং কৃষি কাজে শ্রমিকদের অপ্রতুলতা দেখা দিচ্ছে। দেশের ৯৫ শতাংশ শিল্পকারখানা ও বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান শহরে অবস্থিত। তাই প্রতিদিন শহরের জনসংখ্যার চাপ বাড়ছে। বায়ু দূষণ, পানি দূষণ, পরিবেশ দূষণ, কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ সমস্যাসহ নানা ভয়াবহ সমস্যার সৃষ্টি করছে। আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে কাজ করছি ঠিকই কিন্তু শহর ও গ্রামের প্রযুক্তিগত বৈষম্য আমাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে দিচ্ছে না।

মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর ইসলাম

শিক্ষার্থী, ইতিহাস বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত