ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রছাত্রী ও স্থানীয় গ্রামবাসী আবদ্ধ হোক অপূর্ব মেলবন্ধনে

ড. মো. আনোয়ার হোসেন
বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রছাত্রী ও স্থানীয় গ্রামবাসী আবদ্ধ হোক অপূর্ব মেলবন্ধনে

বাংলাদেশে সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের প্রতি স্থানীয় জনসাধারণের অনেকগুলো কারণে সম্মান ও ভালোবাসার দৃষ্টিভঙ্গি থাকে। বাংলাদেশসহ অনেক সমাজে শিক্ষাকে অত্যন্ত মূল্যবান মনে করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের জ্ঞান অর্জনকারী, সমাজের ভবিষ্যৎ নেতা, উদ্ভাবক এবং পরিবর্তনকারী ও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের অধিকারী হিসেবে দেখা হয়, যা স্বভাবতই শ্রদ্ধার জন্ম দেয়। ছাত্র ছাত্রীরা বাবা-মা ও পরিবার পরিজন হতে অনেক দূরে এসে স্থানীয়দের পাশে বসবাস করে, স্থানীয়রা অনেকেই কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পরিবার-পরিজনের অংশ মনে করে, এতেও স্বাভাবিকভাবে স্থানীয়দের মনে সহানুভূতি জন্ম নেয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা স্থানীয় অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। শিক্ষার্থীরা বাড়ি ভাড়া নেয়, স্থানীয় দোকানপাট, রেস্তোরাঁ ও অন্যান্য ব্যবসায় খরচ করে, যা অনেক পরিবারের জীবিকার উৎস। এই অর্থনৈতিক নির্ভরতাও এক ধরনের ইতিবাচক সম্পর্ক তৈরি করে। ছাত্রছাত্রীরা প্রায়শই স্থানীয় বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেয়, যা স্থানীয় সম্প্রদায়ের সঙ্গে তাদের বন্ধন মজবুত করে। তরুণদের উপস্থিতি স্থানীয় পরিবেশে এক ধরনের সজীবতা ও গতিশীলতা নিয়ে আসে। তাদের উদ্দীপনা এবং প্রাণবন্ত জীবনযাত্রা স্থানীয়দের প্রভাবিত করে।

বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা প্রায়শই প্রশাসনিক ও নিরাপত্তার দিক থেকে বিশেষ গুরুত্ব পায়, যা এলাকার ভাবমূর্তি উন্নত করে এবং পরোক্ষভাবে সেখানকার বাসিন্দাদের প্রতি স্থানীয়দের শ্রদ্ধাবোধ বাড়ায়।

উপযুক্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের মাঝেও বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় ও সমমানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে প্রায়শই স্থানীয়দের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সংঘাত অনেক সময় প্রাণঘাতি রূপ ধারণ করে। এই ধরনের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সাম্প্রতিক ঘটনা নিচে উল্লেখ করা হলো:

যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়- ২৫শে নভেম্বর, ২০২৫-এ (আজ, বুধবার), এক ছাত্রীকে স্থানীয় এক দোকানদার কর্তৃক উত্ত্যক্ত করার ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয় গ্রামবাসীর ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এতে উভয়পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া এবং সড়কে অবরোধের ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ ও অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন করতে হয়।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়- গত আগস্ট-সেপ্টেম্বর ২০২৫-এ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয় জোবরা গ্রামবাসীর মধ্যে দফায় দফায় ভয়াবহ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এক মেয়ে শিক্ষার্থীকে লাঞ্ছিত করার অভিযোগ থেকে এই ঘটনার সূত্রপাত হয়। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য, প্রক্টর, শিক্ষার্থী, গ্রামবাসী এবং সাংবাদিকসহ দেড় শতাধিক লোক আহত হন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে স্থানীয় প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করে এবং সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী বনাম পরিবহন শ্রমিক সংঘর্ষ (ডিসেম্বর ২০২৪)- গত ৪ ডিসেম্বর, ২০২৪ তারিখে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীকে বাস শ্রমিকরা মারধর ও একজন শিক্ষককে লাঞ্ছিত করার ঘটনাকে কেন্দ্র করে সোনাডাঙ্গা বাস টার্মিনাল এলাকায় ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এতে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ, সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছিল।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়- ২০২১ সালে ক্রিকেট টুর্নামেন্ট নিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের বিরোধের জেরে সংঘর্ষ হয়, যেখানে অন্তত ২৫ জন শিক্ষার্থী আহত হয়েছিল।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়- ২০২২ সালে বাস স্টাফদের সঙ্গে কয়েকজন শিক্ষার্থীর উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় কুষ্টিয়ার স্থানীয়দের সঙ্গে সংঘর্ষে রূপ নেয়, এতে ডজনখানেক আহত হয়।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়- ২০২৩ এবং ২০২৪ সালেও ছোটখাটো বিষয় নিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয়দের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছিল। ঢাকা কলেজ, জগন্নাথ কলেজসহ বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গেও প্রায়ই সংলগ্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানসহ স্থানীয়দের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সাধারণত, এই সংঘর্ষগুলোর মূল কারণ হিসেবে সাংস্কৃতিক দূরত্ব, প্রেম গটিত, মাদক সংক্রান্ত, চাঁদাবাজির টাকা ভাগাভাগি, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভৌগোলিক অবস্থান, আবাসন সমস্যা, স্থানীয়দের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত পর্যায়ের অহংকার বা ইগো, এবং তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট উত্তেজনাকে চিহ্নিত করা যায়। অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয়রাও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রছাত্রীদের হয়রানি করে থাকে। উভয়পক্ষ একে অপরকে প্রধান হয়রানি গুলো নিম্নে সংক্ষিপ্ত রূপে উল্লেখ করা হলো-

স্থানীয় মেয়েদের প্রায়শই ইভটিজিং বা অশালীন মন্তব্যের শিকার হতে হয়। এমনকি পশ্চিমা ধাঁচের পোশাক পরা বা ছেলেবন্ধু-মেয়েবন্ধু একসঙ্গে চলাফেরা করলেও অশালীন মন্তব্য করার অভিযোগ রয়েছে। অনেক শিক্ষার্থীর আবাসিক হলের অপর্যাপ্ততার কারণে স্থানীয় এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতে হয়। স্থানীয়দের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যে তারা এই নির্ভরতার সুযোগ নিয়ে অতিরিক্ত বাড়ি ভাড়া এবং পরিবহন ভাড়া দাবি করে। বাসের আসন, দোকানে বসা বা পরিবহন ভাড়ায় ছাড়ের মতো ছোটখাটো বিষয় নিয়ে প্রায়শই স্থানীয়দের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের কথা কাটাকাটি হয়, যা পরবর্তীতে বড় সংঘর্ষে রূপ নিতে পারে। কিছু শিক্ষার্থী, বিশেষ করে রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে জড়িতরা, স্থানীয় এলাকায় প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করে। চাঁদাবাজি, দোকান বরাদ্দ নিয়ে ঝামেলা এবং স্থানীয়দের ওপর পেশীশক্তি প্রয়োগের অভিযোগও রয়েছে। যখন কোনো ঘটনা ঘটে, তখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা স্থানীয়ভাবে ছড়িয়ে পড়া গুজব পরিস্থিতিকে আরও উস্কে দেয়। এসব ছোটখাটো বিরোধ প্রায়শই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে পরিণত হয়, যেখানে উভয় পক্ষই অস্ত্র ও লাঠিসোঁটা নিয়ে মারামারিতে লিপ্ত হয়। এই সমস্যাগুলো নিরসনে বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী এবং গ্রামবাসীদের মধ্যে সংঘর্ষ এড়াতে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলি গ্রহণ করা যেতে পারে-

উভয় পক্ষের জন্য কর্মশালার আয়োজন করা যেতে পারে যেখানে একে অপরের সংস্কৃতি, জীবনধারা এবং দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আলোচনা হবে। একটি স্থায়ী কমিটি বা ফোরাম তৈরি করা যেতে পারে যেখানে উভয় পক্ষের প্রতিনিধিরা নিয়মিত মিলিত হবেন এবং সমস্যাগুলি সমাধানের চেষ্টা করবেন। ছাত্রদের স্থানীয় রীতিনীতি, ঐতিহ্য এবং জীবনযাত্রার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে এবং এমন আচরণ এড়িয়ে চলতে হবে যা গ্রামবাসীদের অনুভূতিতে আঘাত করতে পারে।

ড. মো. আনোয়ার হোসেন

প্রাবন্ধিক ও কথা সাহিত্যিক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত