ঢাকা শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

পথশিশুদের শীতের কষ্ট : এক অব্যক্ত আর্তনাদ

ড. মো. আনোয়ার হোসেন
পথশিশুদের শীতের কষ্ট : এক অব্যক্ত আর্তনাদ

শীতকাল আমাদের অনেকের কাছেই পুলকিত হওয়ার মতো একটি ঋতু, লেপ-কম্বল মুড়ি দিয়ে গরম চায়ে চুমুক দেওয়া, অথবা পরিবারের সঙ্গে পিকনিকের আনন্দ। কিন্তু এই একই শীতকাল, ফুটপাত বা রেলস্টেশনে আশ্রয় নেওয়া হাজার হাজার পথশিশুর কাছে এক বিভীষিকার নাম। তাদের কাছে শীত মানে জমে যাওয়া রক্ত, ঠান্ডা বাতাস আর খাবারের হাহাকার। বাংলাদেশে পথশিশুদের এই দুর্দশা এক চিরন্তন এবং হৃদয়বিদারক বাস্তবতা।

ঘটনাটি গত বছরের ডিসেম্বরের। ঢাকার কারওয়ান বাজারের এক কোনায়, পরিত্যক্ত কাগজের স্তূপের মাঝে, কনকনে ঠান্ডায় কাঁপছিল আট বছরের রহিম। তার পরনে ছিল একটি মাত্র পাতলা সুতির জামা, যা শীত নিবারণের জন্য যথেষ্ট ছিল না।

রহিমের বাবা-মা নেই; জন্মের পর থেকেই সে একা। প্রতিদিনের মতো সেদিনও সে সারাদিন প্লাস্টিক কুড়িয়েছে, কিন্তু তাতে মাত্র ২০ টাকা আয় হয়েছে। সেই টাকা দিয়ে সে কিছু মুড়ি কিনে খেয়েছিল। সন্ধ্যা নামতেই উত্তরের হিমেল হাওয়া বইতে শুরু করল। রহিম প্রথমে ভেবেছিল, পুরোনো খবরের কাগজগুলো গায়ে জড়িয়ে রাতটা পার করে দেবে।

রাত যত বাড়তে লাগল, শীতের তীব্রতা ততই অসহনীয় হয়ে উঠল। তার শরীর অবশ হয়ে আসছিল। আশপাশে আরও কিছু পথশিশু ছিল, তারাও কাঁপছিল। হঠাৎ, এক পথচারী একজন মানুষ একটি পুরোনো চাদর তার দিকে ছুঁড়ে দিলেন। রহিম চাদরটি দ্রুত গায়ে জড়িয়ে নিল। কিন্তু তাতেও পুরোপুরি শীত মানল না।

ভোরের দিকে, শীতের প্রকোপ যখন তুঙ্গে, রহিমকে এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আবিষ্কার করে। তার শরীর তখন প্রায় জমে গিয়েছিল। তাকে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ডাক্তার জানালেন, তীব্র হাইপোথার্মিয়া (শরীরের তাপমাত্রা অস্বাভাবিক কমে যাওয়া) হয়েছিল। একটুর জন্য সে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছিল।

রহিমের মতো এমন হাজারও পথশিশু প্রতিদিন এই শহরের আনাচে-কানাচে শীতের সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে। তাদের এই লড়াইয়ের খবর সমাজের উচ্চশ্রেণির মানুষের কাছে পৌঁছালেও, তা শুধু ক্ষণিকের সহানুভূতি হয়েই থেকে যায়।

পথশিশুদের সঠিক সংখ্যা নির্ণয় করা কঠিন, কারণ তারা সব সময়ই স্থান পরিবর্তন করে। তবে বিভিন্ন গবেষণা ও সংস্থার জরিপ কিছু উদ্বেগজনক তথ্য তুলে ধরেছে। ইউনিসেফের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে পথশিশুর সংখ্যা প্রায় ১০ লাখের বেশি। এদের বেশিরভাগই ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনাসহ বড় শহরগুলোতে বাস করে। ঢাকার বিভিন্ন রেলস্টেশন, বাস টার্মিনাল, পার্ক এবং ফ্লাইওভারের নিচে তাদের দেখা যায়।

শীতকালে এই শিশুদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, শীতজনিত রোগের মধ্যে সর্দি, কাশি, নিউমোনিয়া এবং ডায়রিয়ায় আক্রান্ত পথশিশুর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ে।

এই শিশুদের প্রায় ৯৫ শতাংশই কোনো ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বা সুরক্ষামূলক ব্যবস্থার আওতায় নেই। এই পরিসংখ্যানগুলো শুধু সংখ্যা নয়, প্রতিটি সংখ্যার পেছনে লুকিয়ে আছে এক একটি জীবন, এক একটি স্বপ্ন, এক একটি না বলা কষ্ট।

সাধারণত একাধিক প্রতিকূল কারণের সংমিশ্রণে একটি একটি শিশু পথশিশুতে রূপান্তরিত হয়। যেমন, বাবা-মায়ের বিবাহবিচ্ছেদ, মৃত্যু, অথবা পরিবারের সদস্যদের দ্বারা উপেক্ষা বা নির্যাতনের শিকার হলে শিশুরা বাড়ি ছেড়ে পালাতে পারে। চরম দারিদ্যের কারণে পরিবার শিশুর ভরণপোষণ বা মৌলিক চাহিদা পূরণে অক্ষম হলে, শিশুটি জীবিকার সন্ধানে ঘর ছাড়তে বাধ্য হতে পারে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, উচ্ছেদ বা ভাড়া দিতে না পারার কারণে পুরো পরিবার গৃহহীন হলে, শিশুরা প্রায়শই রাস্তায় আশ্রয় নেয় এবং পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

যখন কোনো শিশু স্কুল বা প্রাপ্তবয়স্কদের তত্ত্বাবধান থেকে বঞ্চিত হয়, তখন তাদের রাস্তায় সময় কাটানোর সম্ভাবনা বেশি থাকে এবং একসময় তারা সম্পূর্ণভাবে পথবাসী হয়ে পড়ে। কিছু শিশু পাচারকারী বা শোষক চক্রের প্ররোচনায় বা চাপে পড়ে পরিবার ছেড়ে আসে এবং রাস্তায় শ্রম বা ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত হয়। সংক্ষেপে যদি বলি, যখন একটি শিশু তার পরিবার বা সমাজ থেকে প্রয়োজনীয় সহায়তা, নিরাপত্তা এবং আশ্রয় পাওয়া থেকে সম্পূর্ণরূপে বঞ্চিত হয়, তখনই সে পথশিশুতে রূপান্তরিত হয়।

পথশিশুদের শীতের কষ্ট লাঘব করা বা তাদের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনা কোনো একক ব্যক্তি বা সংস্থার কাজ নয়। এর জন্য প্রয়োজন সরকারি, বেসরকারি এবং ব্যক্তিগত সম্মিলিত ও টেকসই প্রচেষ্টা। স্বল্পমেয়াদি সমাধানের মধ্যে সবচেয়ে জরুরি হলো শীতকালে পর্যাপ্ত শীতবস্ত্র, যেমন- কম্বল, জ্যাকেট, মোজা ইত্যাদি বিতরণ করা। এই উদ্যোগে সমাজের বিত্তবান শ্রেণি ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।

সরকারের সমাজসেবা অধিদপ্তর এবং বিভিন্ন এনজিও মিলে অস্থায়ী বা স্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপন করতে পারে, যেখানে পথশিশুরা রাতে নিরাপদে ও উষ্ণভাবে থাকতে পারবে। বিদ্যমান আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে এবং নিশ্চিত করতে হবে যেন কোনো শিশুই আশ্রয়হীন না থাকে। শীতকালে ভ্রাম্যমাণ মেডিকেল টিম গঠন করে তাদের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। নিউমোনিয়া বা অন্যান্য শীতজনিত রোগ দেখা দেওয়ার আগেই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।

দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের জন্য পুনর্বাসন এবং শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। প্রতিটি শিশুকে যদি মূলধারার শিক্ষাব্যবস্থায় ফিরিয়ে আনা যায়, তবেই তাদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া সম্ভব। শিশু একাডেমী ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় এই ক্ষেত্রে সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারে।

পথশিশুদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। তারা আমাদেরই অংশ, কোনো বোঝা নয়। তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া এবং সম্ভব হলে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য গণমাধ্যমে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো প্রয়োজন।

পথশিশুদের শীতের কষ্ট একটি মানবিক সংকট। ছোট্ট রহিমের মতো শিশুদের বাঁচাতে হলে আমাদের সবাইকে নিজ নিজ জায়গা থেকে এগিয়ে আসতে হবে। শীতবস্ত্র বিতরণ থেকে শুরু করে তাদের পুনর্বাসনের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা-সবকিছুই জরুরি। একটি উষ্ণ পৃথিবী গড়ার জন্য প্রয়োজন আমাদের সম্মিলিত উষ্ণ হৃদয়। আসুন, এই শীতে আমরা সংকল্প করি-ফুটপাতে যেন আর কোনো শিশুকে শীতে জমে যেতে না হয়।

একটি শিশু যাতে পথশিশুতে রূপান্তরিত না হতে পারে, তা নিশ্চিত করতে সমাজ এবং সরকার উভয়েরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এই বিষয়ে উভয়পক্ষ সম্মিলিতভাবে কার্যক্রম গ্রহণ করতে পারে : শিশুদের বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে এবং শিশুশ্রম প্রতিরোধে কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে। জন্মনিবন্ধন প্রক্রিয়া সহজলভ্য এবং বাধ্যতামূলক করতে হবে, যাতে প্রতিটি শিশুর আইনি পরিচয় থাকে। পথশিশুদের পরিবারগুলোকে চিহ্নিত করে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসেবা এবং বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।

আশ্রয়ণ প্রকল্প বা অন্যান্য সরকারি উদ্যোগে ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারের পুনর্বাসন নিশ্চিত করতে হবে। সকল শিশুর জন্য বিনামূল্যে এবং মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা। পথশিশুদের জন্য বিশেষায়িত স্কুল বা উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কেন্দ্র স্থাপন করা। বিধবা ভাতা, বয়স্ক ভাতা, মাতৃত্বকালীন ভাতাসহ বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বাড়াতে হবে, যাতে দরিদ্র পরিবারগুলো আর্থিক সহায়তা পায়। শিশুশ্রমের ক্ষতিকর দিক এবং শিশুর অধিকার সম্পর্কে সমাজে সচেতনতা সৃষ্টি করা। শিশুদের প্রতি সহিংসতা এবং নির্যাতনের বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলা।

স্থানীয় ক্লাব, এনজিও এবং কমিউনিটি সংগঠনগুলোকে পথশিশুদের মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে কাজ করতে উৎসাহিত করা। ধনী ব্যক্তিরা বা প্রতিষ্ঠানগুলো কর্পোরেট সুরক্ষা তহবিলের মাধ্যমে এই শিশুদের শিক্ষা ও পুনর্বাসনে সহায়তা করতে পারে। পথশিশুদের বিচ্ছিছন্ন না করে তাদের প্রতি সহমর্মী হওয়া এবং তাদের সমস্যাগুলো বোঝার চেষ্টা করা। কোনো শিশুকে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় দেখলে বা নির্যাতনের শিকার হতে দেখলে স্থানীয় প্রশাসন বা জাতীয় জরুরিসেবা ৯৯৯ নম্বরে জানানোর মাধ্যমে কর্তৃপক্ষকে সহায়তা করা। সরকার এবং সমাজ সম্মিলিতভাবে কাজ করলে একটি শিশুর পথশিশুতে রূপান্তরিত হওয়ার ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো সম্ভব।

ড. মো. আনোয়ার হোসেন

প্রাবন্ধিক, কথা সাহিত্যিক, প্রেসিডেন্ট আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী, সংগঠন ফ্রিডম ইন্টারন্যাশনাল এন্টি অ্যালকোহল

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত