প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৫
বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। উন্নয়নশীল দেশগুলোর সামগ্রিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে শহরায়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া। বর্তমান মানুষের গ্রাম থেকে শহরে অবিরাম আগমন হচ্ছে। শিল্পায়নের বিস্তার, যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি এবং আধুনিক জীবনযাপনের আকর্ষণে শহরগুলো দ্রুত প্রসারিত হচ্ছে। কিন্তু এই প্রসার কি শুধু সুবিধাই এনে দিচ্ছে? নাকি এর আড়ালে লুকিয়ে আছে বিভিন্ন ধরনের সংকট? বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, শহরায়ন একদিকে যেমন নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলেছে, অন্যদিকে কিছু কঠিন বাস্তবতাও তৈরি করেছে।
একদিকে, শহরগুলো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। উন্নত যোগাযোগব্যবস্থা, দ্রুত ব্যবসা-বাণিজ্য, উন্নত চিকিৎসা ও শিক্ষার সুযোগ শহরকে আকর্ষণীয় করে তুলছে। বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান, ব্যাংকিং ব্যবস্থা, বাণিজ্যিক হাব ও কর্মসংস্থানের প্রাচুর্য মানুষকে শহরমুখী করছে। প্রযুক্তিনির্ভর চাকরি, তথ্যপ্রযুক্তি, স্টার্টআপ এবং সৃজনশীল কর্মক্ষেত্রের উদ্ভবও শহরেই বেশি। ফলে তরুণরা তাদের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা খুঁজতে গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে আসছেন। শহরায়ন দেশের জিডিপি বৃদ্ধিতে বিশাল ভূমিকা রাখছে। অন্যদিকে অর্থনীতিকে গতিশীল করছে।
এছাড়া শহরায়নের সুফলের মধ্যে রয়েছে আধুনিক জীবনযাপনের সুবিধা। উন্নত স্বাস্থ্যব্যবস্থা, মানসম্মত শিক্ষা, শিল্প-সংস্কৃতির বিস্তার, উন্নত নাগরিক সুবিধা মানুষের জীবনমানকে উন্নত করেছে। শহরগুলোই প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনী চিন্তার কেন্দ্র, যা রাষ্ট্রের উন্নয়ন ধারাকে ত্বরান্বিত করে। সরকারও শহর উন্নয়নকে গুরুত্ব দিয়ে নানামুখী প্রকল্প হাতে নিয়েছে, যেমন- মেট্রোরেল, ফ্লাইওভার, স্মার্ট সিটি উদ্যোগ। এসব উন্নয়ন কর্মসূচি শহুরে জীবনে নতুন সুযোগ তৈরি করছে।
তবে শহরায়নের এই বিস্তার একাধিক সংকটও সৃষ্টি করেছে। সবচেয়ে বড় সংকট হলো জনসংখ্যার চাপ। অব্যবস্থাপনা, পরিকল্পনার অভাব ও দ্রুত নগরায়নের ফলে বড় বড় শহরগুলো আজ ভোগান্তির কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়েছে। ঢাকার মতো শহরে যানজট একটি দৈনন্দিন দুর্ভোগ। যানজটের কারণে প্রতিদিন হাজার হাজার কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়, যা অর্থনৈতিক ক্ষতির পাশাপাশি নাগরিকদের মানসিক চাপও বাড়ায়।
দ্বিতীয়ত, বাসস্থানসংকট ও বস্তির বিস্তার শহরের অন্যতম বড় সমস্যা। লক্ষ লক্ষ নিম্নআয়ের মানুষ শহরে এলেও তাদের জন্য পর্যাপ্ত মানসম্মত আবাসন নেই। ফলে তারা বাধ্য হয়ে অনিরাপদ বস্তিতে বসবাস করেন। এসব এলাকায় স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, নিরাপত্তা, বিশুদ্ধ পানি- কোনো কিছুরই পর্যাপ্ত প্রবেশাধিকার নেই। একইসঙ্গে জমির দাম বাড়ায় সাধারণ মানুষের জন্য শহরে বাড়ি নির্মাণ বা ভাড়া করাও কঠিন হয়ে উঠেছে। তৃতীয়ত, পরিবেশ দূষণ শহরায়নের সবচেয়ে ভয়াবহ সংকট। বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, শব্দদূষণ শহরের বাসিন্দাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রতিনিয়ত ক্ষতিগ্রস্ত করছে। শিল্পবর্জ্য, যানবাহনের ধোঁয়া এবং অনিয়ন্ত্রিত আবাসন নির্মাণ পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ঢাকার মতো শহরে বায়ুদূষণ বিশ্বে অন্যতম শীর্ষ স্থানে থাকায় শ্বাসকষ্ট, অ্যালার্জি, হৃদরোগসহ নানা জটিলতা বাড়ছে। পাশাপাশি সবুজায়ন কমে যাওয়া শহরকে আরও বেশি তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও জলবায়ু ঝুঁকিতে ফেলছে। প্রাকৃতিক দূর্যোগ, যেমন- ভূমিকম্প হলে দাঁড়ানোর মতো ফাঁকা মাঠ পাওয়া কষ্টকর।
চতুর্থত, বিশুদ্ধ পানি ও পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতাও বড় সমস্যা। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অবকাঠামো বাড়ছে না। ফলে বন্যা, জলাবদ্ধতা, ড্রেনেজসংকট নিয়মিত সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্ষাকালে অনেক শহর এক ধরনের ‘অচল নগরী’তে পরিণত হয়।
সবশেষে, সামাজিক নিরাপত্তাহীনতাও শহরায়নের একটি সংকট। অপরাধ, মাদক, কিশোর গ্যাং- এসবই দ্রুত নগরায়নের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। জনসংখ্যার ঘনত্ব ও বৈষম্যের কারণে সামাজিক বন্ধন দুর্বল হয়ে পড়ছে। সব মিলিয়ে বলা যায়, শহরায়ন একদিকে সম্ভাবনার সিঁড়ি, অন্যদিকে সংকটের চ্যালেঞ্জ। সঠিক পরিকল্পনা, টেকসই নগরব্যবস্থাপনা, পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন ও সমতাভিত্তিক নীতি গ্রহণের মাধ্যমে শহরায়নকে সুযোগে পরিণত করা সম্ভব। প্রযুক্তিনির্ভর স্মার্ট সিটি উদ্যোগ, সবুজ পরিবহন, আধুনিক স্যানিটেশন, আবাসন প্রকল্প এবং বিকেন্দ্রীকরণমূলক উন্নয়ন পরিকল্পনা এ ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
শহরায়নকে টেকসই করতে হলে শুধু শহর নয়, গ্রামেও উন্নয়নের সমান সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। তবেই শহরের ওপর চাপ কমবে এবং সামগ্রিক উন্নয়ন হবে সুষম। শহরায়নকে সংকট নয়, উন্নয়নের সুযোগে রূপান্তর করাই এখন সময়ের দাবি।
তানিয়া খান
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়