ঢাকা শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

শীতের সকাল : কুয়াশার ফাঁকে বাংলার সৌন্দর্য

আরশী আক্তার সানী
শীতের সকাল : কুয়াশার ফাঁকে বাংলার সৌন্দর্য

বাংলার শীতের সকাল এমন এক দৃশ্য, যাকে প্রথম নজরে দেখে মনে হয় প্রকৃতির নিজস্ব কোনো নিঃশব্দ রিহার্সাল চলছে। সে আলো, সে নীরবতা, সে কুয়াশার আঁচল সব মিলিয়ে শীতের সকালকে এমন এক আভা দেয়, যা বছরের অন্য কোনো ঋতুতে পাওয়া যায় না। সূর্য তখনও পুরোপুরি জেগে ওঠেনি, আকাশের রং হলদণ্ডসাদা, আর চারপাশের বাতাসে থাকে এক ধরনের নরম ঠান্ডা, যা শরীর ছুঁয়ে গেলেও মনে অদ্ভুত প্রশান্তি তৈরি করে। এই সময়টা যেন প্রকৃতি মানুষের কোলাহলকে থামিয়ে দিয়ে বলে অল্পক্ষণ চুপ করে থাকো, আমার সৌন্দর্যটা দেখো।

শীতের সকালকে বুঝতে হলে গ্রামের পথে হেঁটে যেতে হয়। গাছের পাতায় জমে থাকা শিশির, ভেজা মাটির ঘ্রাণ, দূর থেকে ভেসে আসা বাঁশির মতো হালকা কোনো নামাজের ডাক সব মিলিয়ে যে অনুভূতি জন্ম নেয়, সেটি একাধারে শান্তি, আবার এক ধরনের গভীর ভাবনারও জন্ম দেয়। মনে হয়, আমরা যে পৃথিবীতে এত তাড়াহুড়ো করে চলি, যে পৃথিবীকে এত দ্রুত পরিবর্তন করতে চাই পৃথিবী নিজে কিন্তু ধীরেই থাকে। সে ধীরতা দেখানোর সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত হলো শীতের সকাল।

গ্রামাঞ্চলে শীতের দিনের শুরুটা যেন এক ছোট্ট চলচ্চিত্র। উঠোনে টিনের ছাদের নিচে বোবা ধোঁয়া উড়তে থাকে মাটির চুলায় ভাত বসানো হয়েছে। ভোরবেলাকার আলোয় রান্নাঘরের সেই ধোঁয়ার দৃশ্য এমন এক নস্টালজিয়া তৈরি করে, যা মানুষের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আরও কোমল হয়ে ওঠে। অনেক সময়ই শীতের সকালে ঘর থেকে বেরোলেই দেখা যায় দুই-তিনটি মুরগি কুয়াশা ঠেলে বেরিয়ে হাঁটছে। তাদের ডানার ওপর জমে থাকা শিশির তারা ঝাড়ছে ধীরে ধীরে। কোনো শিশু হয়তো দৌড়ে যাচ্ছে খেলার মাঠে, পায়ের কাছে মা চিৎকার করে বলছে এত ভোরে যাও কেন, ঠান্ডা লাগবে! কিন্তু সে শোনে কোথায়? শীতের মাঠ শিশুদের কাছে সবসময় এক রহস্যময় স্বর্গ।

শীতের সকালে নদীর ধারে গেলে যে দৃশ্য পাওয়া যায়, তার তুলনা নেই। নদীর ওপর সকালবেলার কুয়াশা এমনভাবে বসে থাকে, যেন নদীটাকে কেউ হালকা করে তুলোর আস্তরণে ঢেকে দিয়েছে। মাঝনদীতে কোনো নৌকা চললে দাঁড় টানার শব্দটুকুই শুধু ভেসে আসে দেখা যায় না নৌকাটাকে। ক্ষীণ আলোয় নদীর জল কখনও ধূসর, কখনও সাদা, কখনও আবার একেবারে রূপালি হয়ে ওঠে। নদী তখন এত নরম, এত কোমল, এত শান্ত থাকে যেন প্রকৃতি নিজেই শ্বাস আটকে রেখেছে কিছুক্ষণ।

বাংলার গ্রাম ছাড়াও শহরের শীতের সকাল এক অন্য বাস্তবতা। রাস্তাগুলো তখনও পুরো জেগে ওঠেনি। দোকানগুলো খুলছে ধীরে ধীরে। বাসস্ট্যান্ডে কয়েকজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে হালকা কাঁথা বা গরম কাপড় শরীরে জড়িয়ে।

স্কুলে যাওয়ার আগের তাড়াহুড়ো, চাকরিজীবীদের সকালবেলার অসহায়ের মতো দৌড়ঝাঁপ, রিকশাওয়ালাদের ভোরের প্রথম রোজগার এসবের মাঝেই শহরের শীতের সকাল আলাদা একটি জীবনচিত্র আঁকে। এই শহুরে ভোরে কুয়াশা আলোর সঙ্গে মিশে এমন এক দৃশ্য তৈরি করে, যা রাত্রির সঙ্গে দিনের সীমারেখা মুছে দেয়। গাড়ির হেডলাইট কুয়াশার দেয়ালে এমনভাবে লাগে, যেন আলো দিয়ে কেউ ভোরকে ছুঁতে চেয়েছে।

তবে শীতের সৌন্দর্য শুধু দৃশ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এটি মানুষের অনুভূতিকে বিশেষভাবে স্পর্শ করে। শীতের সকালে হাঁটতে গেলে মানুষের মনে অনেক সময়ই অদ্ভুত এক শান্তি নামে। কারণ এই নীরবতা মানুষের ভেতরের নীরবতার সঙ্গে কথা বলে। শহরের মানুষ যেসব শব্দকে সারাদিন সহ্য করে হর্ন, চিৎকার, ভিড়, ব্যস্ততা শীতের সকালে সেগুলো যেন একটু থেমে যায়। আর সে সময়টুকুতে মানুষ নিজের সঙ্গে কথা বলতে পারে।

শীতের সকাল বাঙালির সংস্কৃতি ও খাবারের সঙ্গেও গভীরভাবে জড়িয়ে আছে। খেজুর রস সংগ্রহের জন্য ভোরবেলা গাছের নিচে যে ভিড় জমে, তা শীতের মায়ার সবচেয়ে জীবন্ত উদাহরণ। কাঠের বড় হাঁড়িতে গরম দুধ আর গরম রসে ভিজে থাকা হালকা মিষ্টি গন্ধ মানুষকে মনে করিয়ে দেয় শীত মানে শুধু ঠান্ডা নয়, শীত মানে উষ্ণতার সন্ধান। একইভাবে শীতের পিঠাণ্ডপুলির পরিবেশও মূলত সকালের সময়েই তৈরি হয়। নরম আলোয় গরম পিঠার ধোঁয়া উঠতে দেখে মনে হয়, শীতের সকাল যেন হাত বাড়িয়ে বলছে এসো, একটু বসো।

এমন সকালগুলো মানুষের ভেতরে গভীর স্মৃতির দরজা খুলে দেয়। ছোটবেলাকার সেই নিঃশর্ত আনন্দ শীতের ছুটির সকালে বিছানা থেকে উঠে পুরো পরিবার একসঙ্গে গরম খাবার খাওয়া, দাদা-দাদির গল্প শোনা, আগুন পোহানোর জন্য চারপাশে জড়ো হওয়া এসব অভিজ্ঞতা সময়ের সঙ্গে ধীরে ধীরে দূরে চলে যায়। কিন্তু শীতের সকাল এলেই সেগুলো আবার ফিরে আসে। হয়তো কারণ শীত মানুষের ভেতরের নরম জায়গাটাকে ছুঁয়ে যায়। শীত মানুষকে নরম করে, ভঙ্গুর করে, একই সঙ্গে স্মৃতিকাতরও করে।

শীতের সকালের আরেকটি সৌন্দর্য হলো তার নীরবতা। পাখির ডাক, ঠান্ডায় পাতার কেঁপে ওঠা, দূরের কোনো মসজিদ থেকে আসা ভোরের আজানের ধ্বনি এগুলো সব মিলিয়ে এমন এক শান্তির সিম্ফনি তৈরি করে, যা মানুষের অতিরিক্ত ব্যস্ত মনকে মুহূর্তের জন্য হলেও থামিয়ে দেয়। যে মানুষ সারাদিন নানা চিন্তায় ডুবে থাকে, শীতের এই ভোরে সে একটু হলেও গভীরভাবে শ্বাস নিতে শেখে।

যেসব মানুষ নিয়মিত ব্যায়াম করেন, তাদের কাছে শীতের সকাল এক অদ্ভুত তাজা শক্তি নিয়ে আসে। কুয়াশার ভেতর হেঁটে যাওয়ার অনুভূতি এমন, যেন আপনি বাস্তব পৃথিবীর বাইরে কোনো নরম, শান্ত জগতে হাঁটছেন। যারা হাঁপানি রোগী, ঠান্ডায় একটু কষ্ট পায় তারাও শীতের সকালের তাজা বাতাসে একটু প্রশান্তি খুঁজে নেয়। আবার কৃষকদের কাছে এই সকাল ফসলের প্রতিশ্রুতি নিয়ে আসে। শীতকালে কৃষিজীবী মানুষের ব্যস্ততা বাড়ে, কিন্তু সেই ব্যস্ততার ভেতরেও থাকে এক ধরনের আনন্দ কারণ শীতের সকালের আলো মাটিকে যে রূপে সাজায়, তা তাদের কাছে আশার মতো।

একই সঙ্গে শীতের সকাল আমাদের সমাজের বৈষম্যকেও স্মরণ করিয়ে দেয়। শহরের উঁচু ভবনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে যেসব মানুষ শীতের সৌন্দর্য উপভোগ করে রাস্তার ফুটপাতে থাকা শিশুটি হয়তো সেই একই শীতে কষ্টে কাঁপছে। তাই শীতের সকাল একদিকে যেমন শান্তি দেয়, অন্যদিকে আমাদের দায়িত্বের কথাও মনে করিয়ে দেয়। মানুষের উষ্ণতা শুধু নিজের শরীরে নয় অন্যকে উষ্ণতা দিতে পারলে তবেই আসল সৌন্দর্য পূর্ণ হয়। তাই শীতের সকাল যেমন প্রকৃতির রূপ দেখায়, তেমনভাবেই মানুষের মানবিকতার পরীক্ষাও নেয়।

বাংলার শীতের সকাল শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্য নয়; এটি একটি অনুভূতি, একটি স্মৃতি, একটি মানবিক স্পর্শ, একটি নীরব প্রশান্তি। কুয়াশার ফাঁকে লুকিয়ে থাকা আলো যেমন- ধীরে ধীরে দিনের দিকে এগিয়ে আসে, তেমনি মানুষের জীবনেও শীতের সকালে জন্ম নেয় নরম একটা আশা। সেই আশাই বলে জীবন যতই ব্যস্ত হোক, কিছু মুহূর্ত আছে যেগুলো শুধু চোখে নয়, মনের গভীরে অনুভব করার জন্য।

আরশী আক্তার সানী

গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত