প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৫
প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতি আমাদের জীবনযাত্রাকে বদলে দিয়েছে আমূল। আজ মোবাইল, কম্পিউটার, ফ্রিজ, টিভি, টিউবলাইট, ব্যাটারি সবকিছুই আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু এই সুবিধারই আরেকটি অন্ধকার দিক আছে, ‘ইলেকট্রনিক বর্জ্য বা ই-বর্জ্য ।’ এটি এমন একটি সংকট, যা চোখে দেখা যায় না, কিন্তু এর বিষাক্ত থাবা আমাদের পরিবেশ, খাদ্য, পানি এমনকি মানবদেহে প্রবেশ করছে নিঃশব্দে। বাংলাদেশ এখন এই অদৃশ্য বিপদের মুখোমুখি।
গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে বছরে ৩০-৩৫ লাখ টনেরও বেশি ই-বর্জ্য তৈরি হয়। এর মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশ আসে মোবাইল ফোন ও সংশ্লিষ্ট যন্ত্রাংশ থেকে। অবাক করার মতো বিষয় হলো, এই বিপুল ই-বর্জ্যের মাত্র ৩-৫ শতাংশ নিরাপদভাবে পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করা হয়; বাকি অংশ অপরিকল্পিতভাবে ভাঙা হয় খোলা আকাশের নিচে বা ফেলে দেওয়া হয় নদীর পাড়ে, খালে-বিলে, বাজারের পাশে কিংবা ডাস্টবিনে। এতে সীসা, পারদ, ক্যাডমিয়াম, নিকেলসহ বিভিন্ন বিষাক্ত রাসায়নিক সরাসরি পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে।
একটি মোবাইল ব্যাটারি খোলা জায়গায় পড়ে থাকলে এর মধ্যে থাকা সীসা বৃষ্টির পানির সঙ্গে মিশে মাটিকে দীর্ঘমেয়াদে দূষিত করে। একটি নষ্ট টিউবলাইটে থাকা অল্প পারদও বাতাসে ছড়িয়ে পড়লে মানুষের স্নায়ুতন্ত্রের ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলে। ক্যাডমিয়াম মাটিতে মিশে গেলে ফসলের শরীরে প্রবেশ করে, আর সেখান থেকে আমাদের দেহে ঢোকে। শুধু তাই নয়, এসব বর্জ্য ভাঙার কাজে ব্যবহৃত শিশুদের শরীরে প্রতিদিন জমছে এই বিষাক্ত উপাদান, যা তাদের মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত করে, শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা বাড়ায় এবং অনেক সময় দীর্ঘমেয়াদি রোগের ঝুঁকি তৈরি করে।
বাংলাদেশের বড় শহরগুলোতে যেমন গাবতলী, চকবাজার, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম- সেখানে ই-বর্জ্য ভাঙার বিশাল পল্লী গড়ে উঠেছে। গ্রামের হাটবাজারেও দৃশ্য প্রায় একই- নষ্ট ব্যাটারি, ভাঙা মোবাইল, পুরনো চার্জার, টিউবলাইট, বৈদ্যুতিক যন্ত্রাংশ পড়ে থাকে খোলা জায়গায়। বৃষ্টির পানির সঙ্গে রাসায়নিক বের হয়ে ধীরে ধীরে জমি ও পানিতে মিশে যায়। কৃষকরা সেই পানি ব্যবহার করেন জমিতে; গবাদিপশুরাও সেই পানি পান করে। এভাবে ই-বর্জ্যের বিষ কৃষির মধ্যেও ঢুকে পড়ে।
বিশ্বের উন্নত দেশগুলো ই-বর্জ্য-কে ‘হ্যাজার্ডাস ওয়েস্ট’ হিসেবে চিহ্নিত করে কঠোরভাবে আলাদা শ্রেণিতে ফেলে। সেখানে বাড়ি-ভিত্তিক আলাদা সংগ্রহব্যবস্থা আছে। প্রতিটি বড় শহরে আছে আধুনিক রিসাইক্লিং প্ল্যান্ট। এমনকি স্কুল-কলেজেও বিশেষ শিক্ষামূলক কার্যক্রম রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতা এখনো আশঙ্কাজনক। বহু মানুষ জানেই না নষ্ট মোবাইল বা ব্যাটারি সাধারণ বর্জ্য নয়। ফলে বাড়ির আবর্জনার সঙ্গেই এগুলো ফেলা হয়, যা পরিবেশের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করে।
সরকার ২০২১ সালে ‘ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালা’ প্রণয়ন করে। এতে বলা হয়েছে, যে প্রতিষ্ঠান ইলেকট্রনিক পণ্য উৎপাদন বা আমদানি করবে, তাদেরই বর্জ্য সংগ্রহ ও রিসাইক্লিংয়ের দায়িত্ব নিতে হবে। কিন্তু বাস্তবে এ আইন প্রয়োগ খুবই সীমিত। বড় কোম্পানিগুলো আংশিকভাবে সংগ্রহ করলেও বাজারের ছোট ব্যবসায়ীরা কোনো দায়িত্বই নেয় না। গ্রামাঞ্চলে তো এই ধারণাই নেই যে ই-বর্জ্য আলাদা করে ফেলার প্রয়োজন আছে। এ পরিস্থিতি থেকে বের হতে হলে প্রয়োজন আরও শক্তিশালী, বাস্তবভিত্তিক ও সমন্বিত দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা- যা পরিবার, সমাজ, সরকার, ব্যবসায়িক খাত এবং স্থানীয় প্রশাসনকে একই সুতোয় গেঁথে ফেলবে। শুধু নির্দেশনা নয়, প্রতিটি ধাপের সঙ্গে যুক্ত থাকবে সচেতনতা, আইন, প্রণোদনা ও প্রযুক্তির সমান গুরুত্ব।
প্রথমত, পরিবারে-পরিবারে আলাদা করে ই-বর্জ্য জমা রাখার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। আমাদের দেশে সাধারণত বাড়ির নষ্ট মোবাইল, ব্যাটারি, চার্জার, টিউবলাইট বা রিমোট আমরা ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলি। অথচ একটু সচেতন হলেই এগুলো আলাদা বাক্সে জমা রাখা যায়। পরিবারে আলাদা একটি ‘ই-বর্জ্য বাক্স’ থাকলে বর্জ্য আর এলোমেলোভাবে পরিবেশে ছড়িয়ে পড়বে না। স্কুলে-কলেজেও শিক্ষার্থীদের এমন বাক্স রাখতে উৎসাহিত করা গেলে ছোটবেলা থেকেই গড়ে উঠবে দায়িত্ববোধ। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি কিংবা ইউনিয়ন পরিষদ চাইলে পরিবারভিত্তিক ই-বর্জ্য সংগ্রহ প্রতিযোগিতা চালু করতে পারে- যেখানে বেশি বর্জ্য জমা দেওয়া পরিবাররা পাবে স্বীকৃতি বা পুরস্কার। এতে পুরো সমাজই উৎসাহিত হবে।
দ্বিতীয়ত, প্রতি উপজেলা ও ইউনিয়নে ই-বর্জ্য সংগ্রহকেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে। রিসাইক্লিং কেন্দ্র না থাকলেও অন্তত সংগ্রহকেন্দ্র থাকা জরুরি। এখানে মানুষ সহজেই নষ্ট ব্যাটারি, টিউবলাইট, মোবাইল, ফ্যান, চার্জারসহ যেকোনো ই-বর্জ্য জমা দিতে পারবে। এসব সংগ্রহকেন্দ্র থেকে বর্জ্য বড় রিসাইক্লিং প্রতিষ্ঠানে পাঠানো হবে। উপজেলা প্রশাসন চাইলে মাসের নির্দিষ্ট দিনে ‘ই-বর্জ্য সংগ্রহ দিবস’ চালু করতে পারে, যেমন অনেক এলাকায় চলছে ‘পরিচ্ছন্নতা দিবস’। ইউনিয়নের গ্রামপুলিশ বা স্বেচ্ছাসেবক দল গ্রাম থেকে গ্রামে গিয়ে বর্জ্য সংগ্রহ করতে পারে- যা পুরো ব্যবস্থাকে সহজ ও কার্যকর করবে।
তৃতীয়ত, নষ্ট মোবাইল, টিউবলাইট, ব্যাটারি নেওয়ার জন্য দোকানভিত্তিক ‘বাই-ব্যাক সিস্টেম’ চালু করা জরুরি। এই ব্যবস্থা চালু হলে মানুষ বর্জ্য লুকিয়ে রাখবে না বা ডাস্টবিনে ফেলবে না। বরং দোকানে দিলে পাবে নির্দিষ্ট ছাড় বা পয়েন্ট। যেমন, পুরনো ফোন দিলে নতুন ফোন কেনায় ২০০ টাকা কমে কেনার সুযোগ, অথবা ব্যাটারি দিলে দোকানদার থেকে নগদ টাকা। এতে বর্জ্যরে প্রবাহ সরাসরি দোকানের মাধ্যমে রিসাইক্লিং ব্যবস্থায় যাবে। দোকানদাররাও সরকারের নির্দিষ্ট লাইসেন্স নিয়ে এই বর্জ্য সংগ্রহ করে রিসাইক্লিং প্রতিষ্ঠানে হস্তান্তর করতে পারবে। চতুর্থত, রিসাইক্লিং খাতে বিনিয়োগ ও সরকারি প্রণোদনা বাড়াতে হবে। বাংলাদেশে এখনো আধুনিক প্রযুক্তিভিত্তিক ই-বর্জ্য রিসাইক্লিং প্ল্যান্ট খুব কম। অথচ ই-বর্জ্য সঠিকভাবে পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করলে পাওয়া যায় স্বর্ণ, রুপা, তামা, নিকেল ও বহু মূল্যবান উপাদান। সরকার যদি কর-ছাড়, কম সুদের ঋণ, কিংবা বিশেষ শিল্পাঞ্চল সুবিধা দেয়- তাহলে উদ্যোক্তারা এই খাতে বিনিয়োগে আগ্রহী হবে। এতে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে এবং দেশের অর্থনীতি আরও শক্তিশালী হবে। পঞ্চমত, শিশুদের স্বাস্থ্যঝুঁকি রোধে ই-বর্জ্য ভাঙার কাজ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে কঠোর নজরদারি বাড়াতে হবে। বাংলাদেশের বড় বড় বর্জ্য পল্লীতে শিশুদের শ্রম এখনো ভয়ংকর বাস্তবতা। তারা খালি হাতে ব্যাটারি ভেঙে ধাতু বের করে; মোবাইলের সার্কিট গরম করে তামা আলাদা করে। এতে তাদের শরীরে প্রবেশ করে সীসা, পারদ ও ক্যাডমিয়াম- যা ভবিষ্যতে গুরুতর অঙ্গ বিকল, মস্তিষ্কের ক্ষতি এবং এমনকি ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়। শিশু শ্রম বন্ধে প্রশাসনকে নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে।
সুদীপ্ত শামীম
গণমাধ্যমকর্মী, কলামিস্ট ও সংগঠক