প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২৫
আমরা সবাই বলি, এখন আধুনিক যুগ চলছে। মেয়েরা আজ সব জায়গায় কাজ করছে- স্কুলে, হাসপাতালে, অফিসে, মিডিয়ায়, এমনকি সেনাবাহিনী পর্যন্ত। তারা গাড়ি চালাচ্ছে, ব্যবসা করছে, বিদেশে পড়াশোনা করছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এইসব অর্জনের মধ্যেও কি একজন নারী সত্যিই নিরাপদ? উত্তরটা যতটা সহজ মনে হয়, ততটা নয়। একজন নারী আজও যখন রাতে একা বাইরে বের হয়, তখন তার পরিবার চিন্তায় পড়ে যায়- ‘ও নিরাপদে ফিরবে তো?’ একজন মেয়ে যখন ভিড় বাসে ওঠে, তখন তার মনে একটাই ভয়- কেউ কি অপ্রত্যাশিতভাবে ছুঁয়ে দেবে না তো? স্কুল, কলেজ, অফিস- যেখানেই যাওয়া হোক না কেন, একটা অদৃশ্য ভয় যেন তাকে সারাক্ষণ ঘিরে রাখে। এই ভয়টাই প্রমাণ করে, আমরা যতই উন্নত হই, নারীর নিরাপত্তা এখনও প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে।
সমস্যা শুধু রাস্তায় নয়, সমাজের মানসিকতায় : অনেকে ভাবে, মেয়েরা রাস্তায় বা জনসমাগমে বেশি বিপদে পড়ে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সমস্যা শুধু বাইরের নয়, সমস্যা আমাদের মানসিকতার গভীরে। আজও অনেক পরিবারে মেয়েদের স্বাধীনভাবে চলাফেরা করা ভালো চোখে দেখা হয় না। একজন মেয়ে যদি একটু আত্মবিশ্বাসী হয়, হাসিখুশি থাকে, তখনও অনেকে বলে এই মেয়েটা খুব বেশি ফ্রি। আবার কেউ একটু সাহস করে কথা বললে, সমাজ তাকে ‘অশালীন’ ট্যাগ দেয়। এই মানসিকতা আসলে মেয়েদের প্রতি অসম্মানেরই আরেক নাম। আমরা মেয়েদের শেখাই কীভাবে পোশাক পরতে হবে, কিভাবে কথা বলতে হবে, কখন বাইরে যেতে হবে, কিন্তু ছেলেদের শেখাই না কিভাবে একজন নারীকে সম্মান করতে হয়। এই জায়গাতেই আমাদের সবচেয়ে বড় ভুল।
নিরাপত্তা শুধু আইন দিয়ে আসে না : আমাদের দেশে নারী নির্যাতন বা হয়রানির বিরুদ্ধে অনেক আইন আছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সেগুলো কতোটা কার্যকর? যখন কোনো ঘটনা ঘটে, তখন আমরা সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিবাদ করি, নিউজে দেখি, কিছুদিন পরে সবাই ভুলে যাই। অপরাধীরা অনেক সময় শাস্তি পায় না বা খুব ধীরে বিচার হয়। ফলে অন্যরা ভয় না পেয়ে বরং সাহস পেয়ে যায়।
নিরাপত্তা শুধু আইন দিয়ে আসবে না, এর জন্য দরকার সামাজিক পরিবর্তন। মানুষের চিন্তা, দৃষ্টিভঙ্গি, ব্যবহার, সবকিছু বদলাতে হবে। একজন নারী রাতে বাইরে গেলে তার দিকে কৌতূহলী চোখে তাকানো বন্ধ করতে হবে। একজন নারী কাজের জায়গায় সফল হলে তার দক্ষতাকে সম্মান করতে হবে, ‘পছন্দের’ কারণে নয়। একজন নারী যদি অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলে, তাকে দোষী নয়, সাহসী হিসেবে দেখতে হবে।
নারীর নিরাপত্তা মানে শুধু শারীরিক নয় : অনেক সময় আমরা মনে করি, নারীর নিরাপত্তা মানে শুধু শারীরিক নিরাপত্তা। কিন্তু মানসিক নিরাপত্তাও ঠিক ততটাই জরুরি। প্রতিদিন সোশ্যাল মিডিয়ায় মেয়েদের ব্যক্তিগত ছবি নিয়ে কটূ মন্তব্য, ট্রল বা হুমকি দেওয়া হয়। এই অনলাইন হয়রানি এখন এক ভয়াবহ সমস্যা। একজন মেয়ে নিজের ছবি পোস্ট করলেই অনেকে তার ওপর মন্তব্য করে, বিচার করে, অপমান করে। এমনকি কেউ প্রতিবাদ করলে উল্টো তাকে ‘অতিরিক্ত সংবেদনশীল’ বলা হয়। এগুলো সবই নারীর মানসিক শান্তি কেড়ে নেয়। ফলে মেয়েরা ধীরে ধীরে নিজেদের প্রকাশ করতে ভয় পায়, নিজের মতামত দিতে দ্বিধা করে। এভাবেই সমাজ তাদের কণ্ঠ রুদ্ধ করে দেয়।
পরিবারই প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান : নারীর নিরাপত্তা শুরু হয় পরিবার থেকে। একজন ছেলে ছোটবেলা থেকেই যদি শেখে ‘মেয়েরা দুর্বল নয়, সমান’, তাহলে সে বড় হয়ে কখনও কাউকে অসম্মান করবে না। একজন বাবা যদি তার ছেলেকে শেখান, ‘তোমার মা, বোন, সহপাঠি, সবাই তোমার সমান’, তাহলে সেই ছেলের চোখে নারী মানে শুধু সম্পর্ক নয়, সম্মানের প্রতীক হবে। আমরা স্কুলে ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান শেখাই, কিন্তু নৈতিক শিক্ষা শেখাতে ভুলে যাই। আর এই জায়গাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, একজন শিক্ষিত মানুষ মানেই সবসময় সচেতন মানুষ নয়। অনেক সময় উচ্চশিক্ষিত হয়েও কেউ নারীর প্রতি অবমাননাকর আচরণ করে। তাই মানবিক শিক্ষার চর্চা সবচেয়ে জরুরি।
মিডিয়ার ভূমিকা ও সামাজিক প্রভাব : আজকের সমাজে মিডিয়া খুব বড় ভূমিকা রাখে। টেলিভিশন, সিনেমা, ওয়েব সিরিজ, এসবের মাধ্যমে মানুষ আচরণ শেখে, ভাবনা তৈরি করে। কিন্তু অনেক সময় এসব মাধ্যমে নারীকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়। একজন নারীকে শুধু সাজগোজ, প্রেম, বা দুঃখের চরিত্রে দেখানো হয়, যেন তার জীবনে অন্য কোনো শক্তি বা চিন্তা নেই। মিডিয়াকে বুঝতে হবে, নারী শুধু সৌন্দর্যের প্রতীক নয়, সে শক্তি, বুদ্ধি ও নেতৃত্বেরও প্রতীক। যখন আমরা নারীর চরিত্রকে সম্মানজনকভাবে উপস্থাপন করব, তখন সমাজও তাদের প্রতি সম্মান দেখাতে শিখবে।
নারীর প্রতি অপরাধ রোধে কী করা যায় : নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে কিছু বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়া দরকার- শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে সেফ জোন তৈরি করা, যাতে মেয়েরা ভয় ছাড়াই কাজ বা পড়াশোনা করতে পারে। যৌন হয়রানি প্রতিরোধ আইন বাস্তবভাবে প্রয়োগ করা- শুধু কাগজে নয়, বাস্তবে যেন কাজ করে। মানসিক সহায়তা কেন্দ্র স্থাপন করা- যাতে নির্যাতিত নারীরা ভয় না পেয়ে কথা বলতে পারে। সচেতনতা বৃদ্ধি ক্যাম্পেইন- বিশেষ করে ছেলেদের জন্য, যেন তারা নারীকে সম্মানের চোখে দেখে। অনলাইন হয়রানি প্রতিরোধে কঠোর আইন, কারণ ডিজিটাল নিরাপত্তাও এখন সমান গুরুত্বপূর্ণ।
আরশী আক্তার সানী
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়