ঢাকা সোমবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৫, ৭ পৌষ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

কলমে পরিচয়, পাহাড়ে প্রাণ : পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের কথা

এম মহাসিন মিয়া, পার্বত্য চট্টগ্রাম
কলমে পরিচয়, পাহাড়ে প্রাণ : পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের কথা

লেখা আমার কাছে কেবল শব্দের বিন্যাস নয়- এ আমার অস্তিত্বের ঘোষণা, আত্মপরিচয়ের স্বাক্ষর। আমি যখন কলম ধরি, তখন নিজের জাতিসত্তা, শিকড় আর মাতৃভূমির প্রতি অনন্ত ভালোবাসা নিয়েই ধরি। আমার লেখার প্রতিটি বাক্যে আমি খুঁজে ফিরি পার্বত্য চট্টগ্রামকে- যে অঞ্চল শুধু একটি ভৌগোলিক নাম নয়, বরং আমার প্রাণের অংশ, আমার পরিচয়ের অবিচ্ছেদ্য অধ্যায়।

পার্বত্য চট্টগ্রাম মানেই শুধু পাহাড়, বন আর নদীর সৌন্দর্য নয়। এ এক দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস, সহাবস্থানের কঠিন বাস্তবতা এবং শান্তির জন্য অবিরাম লড়াইয়ের নাম। এখানে বসবাস করে নানা জাতিগোষ্ঠী- ভাষা, সংস্কৃতি, বিশ্বাসে ভিন্ন হলেও জীবনের মূল চাহিদায় এক। এই পাহাড়ি জনপদের মানুষ যুগ যুগ ধরে টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে- কখনও প্রকৃতির সঙ্গে, কখনও অবহেলার সঙ্গে, আবার কখনও সশস্ত্র অস্থিরতার সঙ্গে।

আমি লিখতে চাই সেই মানুষদের কথা- যারা পাহাড়ে জন্মে পাহাড়েই বড় হয়, পাহাড়েই স্বপ্ন দেখে। যারা শান্তিতে বাঁচতে চায়, সন্তানকে শিক্ষিত করতে চায়, জীবিকা আর নিরাপত্তার নিশ্চয়তা চায়। তাদের স্বপ্ন খুব বড় নয়, কিন্তু পথটা ভীষণ কঠিন। এই বাস্তবতাই আমার লেখার প্রেরণা।

পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস সহজ নয়। এখানে শান্তি কখনও স্থায়ী হয়নি সহজে। নানা রাজনৈতিক সমীকরণ, আঞ্চলিক স্বার্থ, ভ্রান্ত পরিচয়ের রাজনীতি আর বহিরাগত প্রভাব পাহাড়কে বারবার অস্থির করেছে। কিন্তু এসবের মধ্যেও সাধারণ মানুষ চেয়েছে স্বাভাবিক জীবন, চেয়েছে নিরাপদ ভবিষ্যৎ। এই চাওয়ার পাশে দাঁড়িয়ে যারা নিরবে কাজ করে যাচ্ছেন, আমি তাদের কথাও লিখতে চাই।

আমি লিখতে চাই সেই নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে- যাদের নাম হয়তো শিরোনাম হয় না, কিন্তু যাদের উপস্থিতিতে পাহাড়ের রাত কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়। নির্জন পাহাড়ি পথে, দুর্গম এলাকায়, গভীর অরণ্যের প্রহরায় যারা দাঁড়িয়ে থাকে- তাদের চোখে থাকে দায়িত্বের কঠোরতা আর দেশের প্রতি অটুট ভালোবাসা। পরিবার ছেড়ে, প্রিয়জন থেকে দূরে থেকে তারা পাহাড়ের মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। অনেক সময় বিনিময়ে পান ভুল বোঝাবুঝি, অবজ্ঞা কিংবা নীরবতা- তবুও তারা থেমে যান না।

এই পাহাড়ে শান্তি মানে শুধু অস্ত্রের নীরবতা নয়- শান্তি মানে আস্থা, নিরাপত্তা ও সহাবস্থানের পরিবেশ। আর সেই পরিবেশ তৈরিতে নিরাপত্তা বাহিনী, স্থানীয় জনগোষ্ঠী ও প্রশাসনের সম্মিলিত ভূমিকা অনস্বীকার্য। আমি বিশ্বাস করি, এই পারস্পরিক সম্পর্ক যত মানবিক হবে, পাহাড় ততই শান্ত হবে।

আমার লেখায় আমি কাউকে ছোট করতে চাই না, কাউকে অন্ধভাবে মহিমান্বিত করতেও চাই না। আমি চাই বাস্তবতা উঠে আসুক- সত্য, দায়িত্ব আর আত্মত্যাগের গল্প। কারণ পাহাড়ের শান্তি রক্ষার পেছনে যে মানুষগুলো নিঃস্বার্থভাবে কাজ করেন, তারা এই অঞ্চলের অদৃশ্য নায়ক।

আমি লিখতে চাই তাদের নিয়েও- যারা রাষ্ট্রের স্বার্থকে নিজের স্বার্থের ঊর্ধ্বে রেখে পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়ন, শান্তি ও সংহতির জন্য কাজ করছেন। তারা হয়তো রাজনীতির আলোচনায় আসেন না, কিন্তু তাদের কর্মেই পাহাড় বেঁচে থাকে। আমার কলম সাক্ষী থাকবে পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের সংগ্রামের, তাদের স্বপ্নের, তাদের ইতিহাসের। কারণ এই অঞ্চল আমার প্রাণের অঞ্চল। এখানে পাহাড় আছে, নদী আছে, বৈচিত্র্যময় মানুষ আছে- আর আছে এক জটিল কিন্তু সম্ভাবনাময় মানবিক সম্পর্কের গল্প।

আমি বিশ্বাস করি, কলম যদি সৎ থাকে, ভাষা যদি দায়িত্বশীল হয়- তবে লেখাও এক ধরনের দায়িত্ব পালন করে। আমার সেই দায়িত্ববোধ থেকেই আমি লিখি। যতদিন পার্বত্য চট্টগ্রাম থাকবে, ততদিন আমার লেখায় পাহাড় থাকবে- মানুষ থাকবে, শান্তির আকাঙ্ক্ষা থাকবে ইনশাআল্লাহ। কারণ আমি পাহাড়ের সন্তান, পার্বত্য চট্টগ্রামই আমার পরিচয়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত