ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০ পৌষ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

আলোচনা-সমালোচনাই গণতন্ত্র ও সুস্থ রাষ্ট্রের ভিত্তি

এম মহাসিন মিয়া
আলোচনা-সমালোচনাই গণতন্ত্র ও সুস্থ রাষ্ট্রের ভিত্তি

নাগরিক গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হলো মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং যুক্তিনির্ভর আলোচনা-সমালোচনার অবাধ সুযোগ। যে কোনো রাজনৈতিক দল, সরকার কিংবা প্রতিষ্ঠান, তা রাষ্ট্রীয় হোক বা বেসরকারি, ক্ষমতায় থাকুক কিংবা না থাকুক, তাদের জন্য আলোচনা ও সমালোচনার দরজা সবসময় খোলা রাখা অপরিহার্য। কারণ সমালোচনা কেবল বিরোধিতা নয়; এটি সংশোধন, উন্নয়ন ও জবাবদিহিতার একটি কার্যকর মাধ্যম।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, যেখানে সমালোচনার সুযোগ সংকুচিত হয়েছে, সেখানেই ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার ঝুঁকি বেড়েছে। সমালোচনাহীন পরিবেশে ক্ষমতাসীনরা নিজেদের ভুল বুঝতে পারে না কিংবা বুঝলেও সংশোধনের তাগিদ অনুভব করে না।

ফলে রাষ্ট্র ও সমাজ ধীরে ধীরে স্থবির হয়ে পড়ে। অন্যদিকে, উন্মুক্ত আলোচনা ও যুক্তিনির্ভর সমালোচনা নীতিনির্ধারকদের আয়নায় নিজেদের কর্মপরিকল্পনা পর্যালোচনা করার সুযোগ দেয়।

গণতান্ত্রিক সমাজে সাধারণ জনগণ, সাংবাদিক, লেখক, গবেষক ও বিশ্লেষকদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণ জনগণ বাস্তব অভিজ্ঞতা ও প্রত্যক্ষ ভোগান্তির কথা তুলে ধরে রাষ্ট্রের নীতির কার্যকারিতা যাচাই করে। সাংবাদিকরা তথ্যভিত্তিক অনুসন্ধান, প্রতিবেদন বা লেখা প্রকাশের মাধ্যমে গোপন অনিয়ম উন্মোচন করেন। লেখক ও গবেষকরা দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব বিশ্লেষণ করে বিকল্প চিন্তার পথ দেখান। বিশ্লেষকরা যুক্তি ও পরিসংখ্যানের আলোকে সিদ্ধান্তের শক্তি ও দুর্বলতা তুলে ধরেন। এই সম্মিলিত কণ্ঠস্বরই একটি সমাজকে সচেতন ও গতিশীল রাখে।

সমালোচনা বন্ধ করার প্রবণতা অনেক সময় ‘রাষ্ট্রবিরোধিতা’ বা ‘অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির’ অজুহাতে দেখা যায়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, দায়িত্বশীল ও তথ্যভিত্তিক সমালোচনা রাষ্ট্রের শত্রু নয়; বরং রাষ্ট্রকে শক্তিশালী করার সহায়ক শক্তি। যে সরকার বা প্রতিষ্ঠান সমালোচনাকে ভয় পায় না, বরং তা থেকে শিক্ষা নেয়, তারাই দীর্ঘমেয়াদে জনগণের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়।

তবে সমালোচনার ক্ষেত্রেও দায়িত্বশীলতা জরুরি। ব্যক্তিগত আক্রমণ, বিভ্রান্তিকর তথ্য বা বিদ্বেষমূলক বক্তব্য সমালোচনার উদ্দেশ্যকে ক্ষুণ্ণ করে। তাই আলোচনা হতে হবে যুক্তিনির্ভর, তথ্যসম্মত ও শালীন। সমালোচনার লক্ষ্য হওয়া উচিত সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধানের পথ দেখানো, কাউকে হেয় করা নয়।

সবশেষে বলা যায়, আলোচনা-সমালোচনার উন্মুক্ত পরিবেশ ছাড়া কোনো সমাজ টেকসই উন্নয়ন ও ন্যায়বিচারের পথে এগোতে পারে না। ক্ষমতায় কে আছে তা মুখ্য নয়; মুখ্য হলো জনগণের কথা বলার, প্রশ্ন তোলার এবং ভিন্নমত প্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করা। এই অধিকার যত সুরক্ষিত থাকবে, রাষ্ট্র ও সমাজ ততই সুস্থ, শক্তিশালী ও ভবিষ্যতমুখী হয়ে উঠবে।

এম মহাসিন মিয়া

সাংবাদিক ও লেখক, পার্বত্য চট্টগ্রাম

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত