ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০ পৌষ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

শীতবস্ত্র বিতরণ দায়বদ্ধতা নাকি লোক দেখানো

আরশী আক্তার সানী
শীতবস্ত্র বিতরণ দায়বদ্ধতা নাকি লোক দেখানো

শীত আসলে আমাদের সমাজের অনেক না বলা সত্য সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দেয়। বছরের অন্য সময় যেসব বাস্তবতা আমরা এড়িয়ে চলি, শীত এলেই সেগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় কে কতটা নিরাপদ, কে কতটা অসহায়। এই সময়েই সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আসে শীতবস্ত্র বিতরণ। ভালো উদ্যোগ, নিঃসন্দেহে। কিন্তু এই উদ্যোগের ভেতরে ঢুকলেই নানা প্রশ্ন, দ্বিধা আর বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়।

শীত এলেই আমরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একের পর এক পোস্ট দেখি শীতবস্ত্র বিতরণ কর্মসূচি, মানবিক উদ্যোগ, সবার সহযোগিতা কাম্য। ছবি থাকে, হাসি থাকে, ব্যানার থাকে। এসব দেখে মনে হয়, সমাজ যেন খুব দায়িত্বশীল হয়ে উঠেছে। কিন্তু বাস্তবে শীত কি সত্যিই সবার জন্য সহনীয় হয়ে উঠছে?

আমাদের দেশে শীত মানে শুধু ঠান্ডা নয়, শীত মানে টিকে থাকার লড়াই। শহরের ফুটপাত, বাসস্ট্যান্ড, রেলস্টেশন, নদীর চর, হাওরের পাড়- এই জায়গাগুলোতে শীত যেন অন্য রকম। সেখানে রাত মানে শুধু অন্ধকার নয়, রাত মানে কাঁপতে কাঁপতে সকাল হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা। একটি পাতলা কম্বল কিংবা পুরোনো সোয়েটারও সেখানে অমূল্য হয়ে ওঠে।

কিন্তু শীতবস্ত্র বিতরণ করতে গিয়ে আমরা অনেক সময় এই বাস্তবতাকে গভীরভাবে বুঝতে চাই না। অনেকের কাছে এটি হয়ে ওঠে একটি মৌসুমি কাজ শীত এসেছে, কিছু করতে হবে। কোথাও কোথাও এটি আবার ব্যক্তিগত কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক প্রচারের মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়। সাহায্য করার আগ্রহের চেয়ে দেখানো টা বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

শীতবস্ত্র বিতরণের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো- আমরা কেন দিচ্ছি? সত্যিকারের দায়িত্ববোধ থেকে, নাকি সামাজিক চাপ থেকে? কেউ কেউ দিচ্ছেন কারণ সবাই দিচ্ছে। কেউ দিচ্ছেন কারণ ছবি না দিলে ভালো দেখা যায় না। আবার কেউ কেউ সত্যিই মন থেকে দিতে চান, কিন্তু সেই সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো কারা পাচ্ছে এই শীতবস্ত্র। অনেক সময় দেখা যায়, যাদের পাওয়া সহজ, তারাই বেশি পায়। রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয় কম্বল, দ্রুত ছবি তোলা হয়। কিন্তু যারা একটু দূরে থাকে, যারা লজ্জায় সামনে আসে না, যারা শহরের আলো-ঝলমলে জায়গা থেকে অনেক দূরে- তারা থেকে যায় উপেক্ষিত।

শীতবস্ত্র বিতরণের সময় নির্বাচন নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। শীতের শুরুতেই যখন ঠান্ডা সবচেয়ে বেশি অনুভূত হয়, তখন তেমন তৎপরতা দেখা যায় না। অথচ জানুয়ারির শেষ দিকে, যখন শীত প্রায় বিদায় নিতে বসেছে, তখন হঠাৎ করেই কম্বল বিতরণের হিড়িক পড়ে যায়। তখন মনে হয়, এই কাজটা প্রয়োজনের চেয়ে দায়সারা হিসেবেই বেশি হচ্ছে।

শীতবস্ত্রের মান নিয়েও আমাদের ভাবা দরকার। অনেক সময় এমন কাপড় দেওয়া হয়, যা আসলে শীত নিবারণে খুব একটা কাজে আসে না। পুরোনো, পাতলা, কিংবা ব্যবহার অযোগ্য কাপড় দিয়ে দায়িত্ব শেষ করার প্রবণতাও দেখা যায়। কিন্তু যারা এগুলো পাচ্ছে, তাদের সামনে তো বিকল্প নেই। তাদের জন্য এটুকুই শেষ ভরসা।

মানবিকতা মানে শুধু কিছু তুলে দেওয়া নয়। মানবিকতা মানে বুঝে দেওয়া। কার প্রয়োজন কতটা, কোন জায়গায় শীত বেশি, কোন মানুষ সবচেয়ে ঝুঁকিতে এই প্রশ্নগুলো আগে ভাবতে হয়। দানের সঙ্গে সম্মান জড়িয়ে থাকা জরুরি। কিন্তু অনেক সময় সাহায্যের মুহূর্তেই সাহায্যপ্রাপ্ত মানুষের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়, যা আমরা খেয়ালই করি না। তবে এসব নেতিবাচক দিকের মাঝেও ভালো উদাহরণ একেবারে নেই, তা নয়। কিছু মানুষ ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আছেন, যারা নীরবে কাজ করেন।

আরশী আক্তার সানী

গগণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত