প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ২৫ ডিসেম্বর, ২০২৫
শিক্ষকদের সম্মান প্রদর্শনের জন্য আলাদা কোনো দিবসের প্রয়োজন হয় না। ছাত্রদের যদি একটি বৃক্ষের সঙ্গে তুলনা করা হয় তবে শিক্ষকরা সেই বৃক্ষের একেকটি শেকড়। আজকের আমি হয়ে গড়ে ওঠার পেছনে যে শেকড় তার মূলেই রয়েছেন শিক্ষক সমাজ। আমাদের জীবনের বিশেষ মানুষগুলোর সঙ্গে কাটানো সময়ের ভালো কোনো ছবি কেন ক্যামেরাবন্দি করা হয়ে ওঠে না এটা কাকতালীয় হলেও সত্য বটে। শিক্ষকদের সাথে ভালো ছবি না থাকলেও তাদের শেখানো অমূল্য বাণীগুলোই যেন আমাদের আজীবনের সঞ্চয়। আমার জ্ঞানের আঙিনায় বিচরণের সেরা সময়টা পার করেছি হাটহাজারী কলেজের শিক্ষকদের ছত্রছায়ায়। তারা শুধু আমার শিক্ষক ছিলেন না; ছিলেন আমার পরামর্শদাতা, অভিভাবক ও সহচর। তাদের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা আমাকে ডানা মেলতে শিখিয়েছে বিশালতার প্রানে। তাদের প্রশ্ন করার অনুপ্রেরণা আমাকে শিখতে উৎসাহ জুগিয়েছে। পাশাপাশি শিক্ষকদের দিক-নির্দেশনামূলক কথাগুলো যেন সবসময়ের জন্য কানে বাজে। আমার প্রিয় শিক্ষক মীর কফিল স্যার বলতেন, ‘তোমরা দুষ্টুমির ছলেও শিক্ষকের চেয়ারে বসোনা কারণ এই চেয়ারে বসতে সম্মান ও যোগ্যতার প্রয়োজন হয়।’ স্যারের এই কথার পর থেকেই শিক্ষকতার পেশার প্রতি চিন্তার ভিন্নতা আসে। কফিল স্যার গত হয়েছেন কিন্তু তার এমন সুযোগ্য শিক্ষার্থী রেখে গেছেন বিভিন্ন প্রান্তে যারা আলো ছড়াচ্ছেন মহামঞ্চে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির শিক্ষক আরজু রনি স্যার বলতেন, ‘আজ তুমি আত্মাকে কষ্ট দাও ; আত্মা পরে তোমাকে শান্তি দিবে।’ স্যারের কথা তৎক্ষনাৎ বুঝতে না পারলেও আজ বুঝতে পারি কত গভীর ভাবনা স্যার সরল উক্তিতে তুলে ধরেছেন। অর্থনীতি শিক্ষক ফজলুল হক স্যার আমাকে সবসময় প্রশ্ন করতে উৎসাহিত করতেন। স্যার, আমাদের জন্য কত নোট, সাজেশন যে সময় নিয়ে নিজ হাতে লিখতেন তা দেখলে অবাক হওয়ার ছিল। বয়সের বারে নুয়ে পড়লেও দায়িত্বের ভার শিক্ষকদের কখনো কাবু করতে পারে না। স্যারের আমাদের পড়ানোর জন্য এত সময় ব্যয় করতে দেখে মাঝে মাঝে নিজেরাই লজ্জায় পড়ে যেতাম যে আমরা কতটা উদাসীন। আমাদের সবার যমের মতো ভয়ের বিষয় ইংরেজিও দারুণ রসিকতায় পড়াতেন মহিউদ্দিন আরমান স্যার। স্যার বলতেন, ‘তোমাকে দৌড়াতে হবে, দৌড়াতে না পারলে হাঁটতে হবে আর হাঁটতে না পারলে হামাগুড়ি দিতে হবে। কিন্তু এগিয়ে যেতেই হবে।’ এভাবে প্রতিনিয়ত নানা উক্তির ছলে শিক্ষকরা আমাদের এগিয়ে যাওয়ার দিকনির্দেশনা দেন। শিক্ষকদের শাসনে বন্দি সময়টায় সময়ের পরিক্রমায় সবচেয়ে মধুর সময় হয়ে ধরা দেয়।
শিক্ষক হওয়া সহজ নয়। শিক্ষার্থীর আগ্রহ বোঝা, তাদের বুঝার সক্ষমতা পরখ করা ও আনন্দের সাথে পাঠদান করানো শিক্ষকের অন্যতম গুনাবলী। কোথাও যেন পড়েছিলাম, “তুমি যদি সবচেয়ে দুর্বল শিক্ষার্থীটিকে বুঝাতে সক্ষম হও তবেই তুমি শ্রেনিকক্ষের সকলকে বুঝাতে সক্ষম হবে।” একজন শিক্ষককের সবার কাছে পৌঁছাতে পারার অনন্য ক্ষমতা থাকে। হয়রত আলী (রা:) বলেছিলেন, “আমি যার কাছ থেকে একটি হরফ শিখেছি আমি তার দাস ;সে চাইলে আমাকে বিক্রি করতে পারেন।” জীবন আলোকিত করা এই শিক্ষকদের সম্মান অনেক উচুতে। জীবনের প্রতিটা ধাপে বহু শিক্ষকের সানিধ্য পেয়েছি। যারা গোটা কর্মজীবনটায় শিক্ষকতা পেশায় অতিবাহিত করেছিলেন। কখনো চোখ রাঙ্গিয়ে কখনো প্রহার করে আমাদের শেখানোর চেষ্টা করেছেন। এখন বুঝতে পারি যতটা ব্যথা আমরা পেতাম তার চেয়ে বেশী ব্যথায় শিক্ষকদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হতো। কারণ তারা সোহাগ করেন বলে শাসন করেন। বাইরে থেকে কখনোই শিক্ষককে ব্যাখা করা সম্ভব নয় যদি না আমরা হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করি। একজন শিক্ষকের সাথে ছাত্রের সম্পর্ক কেবল মাস শেষে মাইনে নেওয়া জন্য হয়ে থাকেনা। একজন শিক্ষক মন থেকে চান, তার শিক্ষার্থীর ভালো বন্ধু হয়ে তার সমস্যা গুলো বুঝার এবং তাকে শিখতে সাহায্য করার। একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীর জায়গায় নিজেকে রেখে পরিস্হিতি বোঝার চেষ্ঠা করেন। বড় হয়ে বুঝতে পারি, সবচেয়ে বেশি শাসন করা শিক্ষকের চোখের কোণেও জল জমা হয় যা আড়ালেই রয়। সবশেষে বলতে চাই, শিক্ষক সমাজ ছাত্রকূলের শেকড় যেথায় মিশে আছি আমরা। জ্ঞানের দ্যাুতি ছড়ানো শিক্ষকসমাজের যোগ্য সম্মান নিশ্চিত হোক ;যেন কোন নক্ষত্রের মৃত্যু না হয়। প্রকৃতির নিয়মে মানুষ গত হয় তবে ছাত্র -শিক্ষককের মেলবন্ধন হৃদতার। এই বন্ধন যুগ যুগ ধরে অটুট ও পবিত্র থাকুক এই কামনায়।
তৈয়বা খানম
শিক্ষার্থী, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম