প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ২৫ ডিসেম্বর, ২০২৫
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর মুক্তির স্বপ্ন বহুল চর্চিত বিষয়। ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ অর্থ যে সব আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহিদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। ১৯৭১ সালে রণাঙ্গনের সংগ্রামের মাধ্যমে পাকিস্তানি শাসকদের যাবতীয় অন্যায়, অবিচার, শোষণ থেকে মুক্ত হয়েছি ঠিকই কিন্তু কাঙ্ক্ষিত মুক্তি আজও মেলেনি। আমাদের রাজনীতি ও অর্থনীতি এখনো বিদেশি প্রভূর উপর নির্ভরশীল। দূর্নীতি আজও আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে আছে। আমাদের আইন ও সমাজ ব্যবস্থা এখনো দুর্নীতি, অনিয়ম, অবিচার, স্বজনপ্রীতি থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে পারেনি, যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পরিপন্থি। স্বাধীনতার পর থেকেই দুর্নীতি দমন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বহু আইন, বিধি-বিধান প্রণয়ন করা হয়েছে ঠিকই কিন্তু দুর্নীতি নির্মূল করা সম্ভব হয়নি। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ এর সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ নামক যে বিষবাষ্প আমদানি করা হলো, তা কোনোক্রমেই কোটি কোটি সাধারণ বীর মুক্তিযোদ্ধার অন্তস্থ চাওয়া ছিল না। অথচ তাদের প্রত্যাশা বা চাওয়ার কোনো মূল্যায়ন করা হলো না। এখানেই মুক্তিযুদ্ধের মূল স্টেকদের ছেঁটে ফেলা হলো। বিদেশি প্রভূর হস্তক্ষেপের কারনে সংবিধানকে বলপূর্বক নাস্তিক্য ও ধর্মনিরপেক্ষ বাদীদের কল্যাণে নিয়োজিত করলেন শেখ মজিবুর রহমান। সদ্য স্বাধীন দেশ প্রকৃত মুক্তির পথ হারালো। মুক্তস্বাধীন সত্ত্বা ত্যাগ করে ভারতীয় গোলামির জিঞ্জির পরলো।
‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ ফ্রেজটি বা শব্দবন্ধটি হাল আমলে খুব ব্যবহৃত হচ্ছে। মাত্রাতিরিক্ত অপপ্রয়োগের কারণে অধিকাংশ মানুষের কাছে শব্দযুগলটি এখন বিবমিষা উদ্রেককারী। পতিত সরকারের মতলববাজির কারণে নিরীহ শব্দ দুটি সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে বাণিজ্য হচ্ছে বর্তমান সময়ে একটি বড় বাণিজ্য। আপনার মধ্য কোন আদর্শের দরকার নেই, শুধুমাত্র মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বুকে ধারণ করলেই হবে। আপনি এই চেতনা বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা ইনকাম করতে পারবেন। ফ্যাসিস্ট হাসিনা তার ষোল বছরের দানবীয় শাসনকালে এই ‘চেতনা’ ব্যবহার করে দূর্নীতি-লুটপাট, ঘুম-খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, জুডিশিয়াল কিলিং এবং আয়নাঘরের জুলুমকে দেশে ও বিদেশে বৈধতা দিয়েছেন। পর পর তিনটা ভূয়া নির্বাচনের পর তথাকথিত ইসলামী জঙ্গী ও মৌলবাদ ঠেকানোর গল্প ফেরি করেই তিনি বিশ্বকে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছেন। জুলাই বিপ্লব হাসিনা-ভারতের দালালদের একাত্তরের জীর্ণ চেতনার ব্যবসাকে কবর দিয়েছিল। একাত্তুরের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ন্যারেটিভকে গত ৫৪ বছর ধরে এ জাতিকে এমনভাবে গেলানো হয়েছে যে, আওয়ামী রাজনীতির সরাসরি প্রতিপক্ষ দলের অনেক নেতাকর্মী নিজেকে প্রগতিশীল ও মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তি প্রমাণ করতে এখনো আওয়ামী ন্যারেটিভের বুলি আওড়াচ্ছে। তাদের প্রথমে এটা বুঝতে হবে যে, স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও যখন দেশের মানুষ তার মৌলিক অধিকারের জন্য হাজার হাজার মানুষকে রক্ত দিয়ে রিজিম চেঞ্জ করতে বাধ্য হয়, তখন একাত্তুরের বয়ান হাজির করে ‘স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ ন্যারেটিভ’ বর্তমান বাস্তবতায় আদৌ দেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কিনা?
বিগত সরকারের ১৬ বছরের শাসনকালে আওয়ামী লীগ সরকার মুক্তিযুদ্ধের যে বয়ান তৈরি করেছে সেটার সাথে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কোনো মিল নেই। জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতা কখনো মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ কিংবা চেতনা ছিল না। মুক্তিযোদ্ধা সংসদের অন্যতম প্রদান নেতা মাহফুজুর রহমান কয়েক বছর আগে মারা গেছেন। তিনি ও আওয়ামী লীগের সমালোচনা করে বলতেন, আওয়ামী লীগ আসলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী নয়। তখনকার সময়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিলো সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করা।
কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার সেই চেতনাকে শুধুই অপব্যবহার করেছে, বাস্তবায়নের কোনো চেষ্টা করেনি।
তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিক্রি করে হেন অপকর্ম নেই যা করেনি। তার কয়েকটা নমুনা আজকে তুলে ধরবো।
পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ বাস্তবায়নে নামকাওয়াস্তে নেওয়া হয় বিভিন্ন প্রকল্প। এসব প্রকল্পের বাস্তবায়ন দেখিয়ে লুটপাট করা হয়েছে হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ। মূলত ‘মুক্তিযুদ্ধ’ শব্দটি ব্যবহার করে হরিলুটের এসব ঘটনা ঘটেছে। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে দিতে অনুষ্ঠিত হয় বিভিন্ন সভা-সেমিনার। এ সমস্ত সভা-সেমিনারের মাধ্যমে লুট করা হয় এসব টাকা। বিগত ৫৪ বছরে অসংখ্যবার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা সংশোধন করা হয়েছে।
প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ১ লক্ষ ৬০ হাজার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৩ লক্ষের অধিক হয়েছে। অভিযোগ আছে এই ৩ লক্ষ মুক্তিযোদ্ধার মধ্য অধিকাংশ ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা। এই ভূয়া মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে পত্রিকায় বার বার শিরোনাম হয়েছে। ১৯৭১ সালের আসল মুক্তিযোদ্ধারা এ অভিযোগ উত্থাপন করেন। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌছেছে যে অনেক সংসদ সদস্যরা ও পদ পদবি বৃদ্ধি এবং মন্ত্রী হওয়ার লোভে ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়েছেন। যাদেরকে ঐ এলাকার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারগণ আসল মুক্তিযোদ্ধার খেতাব দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। সবছেয়ে হাস্যকর ব্যাপার হচ্ছে ১৯৭১ সালে যাদের বয়স ৪-৫ বছর তাদেরকে ও মুক্তিযোদ্ধা সনদ প্রদান করা হয়েছে। সাবেক হাসিনা সরকারের মুক্তিযোদ্ধাবিষয়ক মন্ত্রী আকম মোজাম্মেল হকের বিরুদ্ধে ভূয়া মুক্তিযুদ্ধ সনদ বাণিজ্য করার অভিযোগ উঠেছে। কমপক্ষে ৭ লক্ষ টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ দেড় কোটি টাকার বিনিময়ে তিনি প্রায় ২৫০০০ হাজার ভূয়া মুক্তিযোদ্ধার কাছে সনদ বিক্রি করেন। এই পঁচিশ হাজার ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ বিক্রি করে তিনি হাজার কোটি টাকা নিজের পকেটে ঢুকিয়েছেন। সাবেক মন্ত্রী মোজাম্মেল হক শুধু ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ বিক্রি করে ক্ষান্ত হননি, মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা (ঘষামাজা) টেম্পারিং করে সনদ নিয়েছেন নিজেও। অথচ ভারতে প্রশিক্ষণ নেওয়া ৫১ হাজার মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় এবং ১৯৮৬ সালের গেজেটে নাম নেই আকম মোজাম্মেল হকের। এ ব্যাপারে ২ বছর আগে উচ্চ আদালতে একটি রিট পিটিশন দায়ের করা হয়। ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদের পর এবার আলোচনা করা যাক মুক্তিযোদ্ধাদের নামে ফ্ল্যাট নিয়ে জালিয়াতীর কথা। ঢাকা মিরপুর ১৪ পুলিশ কমিউনিটি হলের পাশে ৫০ বিঘা জমির উপর গড়ে তুলেছে কনডোমিনিয়াম আবাসন প্রকল্প। বিজয় রাকিন সিটি ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি কর্তৃক মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নির্মিত ৮৭০টি ফ্ল্যাটের অর্ধেকই আওয়ামী লীগ নেতা, মন্ত্রী, এপি ও প্রভাবশালীদের দখলে। এর মধ্য সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোর্শেদুল আলম ও তার স্বজনদের নামে আছে ৭০টি ফ্ল্যাট। এগুলো কবজায় রাখতে পতিত সরকারের এমপি-মন্ত্রীসহ প্রশাসনের অনেককে তিনি ফ্ল্যাট দিয়েছেন। তারা নানা কায়দায় প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের বাদ দিয়ে ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা, আওয়ামী লীগ নেতা ও প্রশাসনের প্রভাবশালীদের নামে ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। গত ৯ই আগস্ট-২০২৫ সিরডাপ মিলনায়তনে ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও জাতীয় নিরাপত্তা ভাবনা’ বিষয়ক আলোচনা সভায় সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, স্বাধীনতা নিয়ে বক্তব্য দিয়ে জাতিকে আর বিভক্ত করা যাবে না। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ আরো বলেন, বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে বাণিজ্য হয়েছে এবং প্রত্যেকটা প্রতিষ্ঠানকে রাজনৈতিকীকরণ করা হয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে মানুষকে বিভক্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশকে একটি বৈষম্যহীন শক্তিশালী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গঠন করতে হবে।
বহু ত্যাগ তিতিক্ষা ও রক্তের বিনিময়ে এ দেশ স্বাধীন হয়েছে। আমাদের দেশ স্বাধীন হয়েছে সত্য, কিন্তু স্বাধীনতার ৫৪ বছর পার হলেও আমরা বৈষম্যমুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত, শোষণমুক্ত সামাজিক ন্যায়বিচার ভিত্তিক বাংলাদেশ গড়তে পারিনি। আমাদের মুক্তিকামী মুক্তিযোদ্ধারা পায়নি যথাযোগ্য সম্মান ও মর্যাদা।
মুহাম্মদ জামাল উদ্দিন
প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট