ঢাকা শুক্রবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১ পৌষ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

গণতন্ত্র উত্তরণই একমাত্র মুক্তির পথ

ওসমান গনি
গণতন্ত্র উত্তরণই একমাত্র মুক্তির পথ

একটি রাষ্ট্রের প্রাণশক্তি নিহিত থাকে তার জনগণের সম্মতির ওপর। রাষ্ট্র যখন সেই সম্মতির তোয়াক্কা না করে শুধু শক্তির ওপর ভর করে টিকে থাকতে চায়, তখন তার কাঠামোগত ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে পড়ে। আজ আমাদের জাতীয় জীবনের এক গভীর সংকটময় মুহূর্তে দাঁড়িয়ে এই সত্যটি বারবার সামনে আসছে যে, গণতন্ত্রের পূর্ণাঙ্গ উত্তরণ ছাড়া আমাদের সামনে মুক্তির আর কোনো বিকল্প পথ নেই। গণতন্ত্র শুধু একটি শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থা নয়, বরং এটি একটি জাতির আত্মপরিচয়, ন্যায়বিচার এবং মানবিক মর্যাদার সুনিশ্চিত দলিল। যখনই কোনো সমাজ থেকে এই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধগুলো হারিয়ে যায়, তখন সেখানে অন্ধকার নেমে আসে এবং নাগরিক জীবন এক দমবন্ধ করা পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়।

গণতন্ত্রের অনুপস্থিতিতে একটি রাষ্ট্রে সবচেয়ে বড় যে ক্ষতিটি হয়, তা হলো জবাবদিহিতার বিলুপ্তি। একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকার জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকে, কারণ তারা জানে যে নির্দিষ্ট সময় পর তাদের জনগণের দরবারে ফিরে যেতে হবে। কিন্তু যখন নির্বাচনের পরিবেশ কলুষিত হয় কিংবা জনগণের ভোটাধিকার হরণ করা হয়, তখন শাসকের মনে এই দায়বদ্ধতার ভয় আর অবশিষ্ট থাকে না। ফলে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার শুরু হয় এবং দুর্নীতি একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। এই জবাবদিহিতাহীন শাসনব্যবস্থা শুধু রাজনৈতিক ক্ষতি করে না, বরং দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ডকেও ভেঙে দেয়। মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের হাতে সম্পদ কুক্ষিগত হয় এবং সাধারণ মানুষ ক্রমেই প্রান্তিক থেকে প্রান্তিকতর হতে থাকে। মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের দীর্ঘশ্বাস যখন আকাশচুম্বী হয়, তখন বুঝতে হবে গণতন্ত্রের অভাবে রাষ্ট্রের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেছে।

অনেকেই উন্নয়নের দোহাই দিয়ে গণতন্ত্রকে দ্বিতীয় সারিতে রাখতে চান। তাদের যুক্তি হলো, আগে উন্নয়ন, পরে গণতন্ত্র। কিন্তু ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায়, গণতন্ত্রহীন উন্নয়ন কখনোই টেকসই হয় না। স্বচ্ছতা ও অংশগ্রহণমূলক শাসন ছাড়া যে উন্নয়ন হয়, তা আদতে এক শ্রেণির লুটপাটের সুযোগ করে দেয়। বড় বড় মেগা প্রকল্পের আড়ালে যখন বিশাল অংকের অর্থ পাচার হয় বা অপচয় হয়, তখন সেই দায়ভার সাধারণ জনগণের ওপর করের বোঝা হিসেবে চেপে বসে।

প্রকৃত উন্নয়ন তখনই সার্থক হয় যখন তাতে সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটে। গণতন্ত্রের উত্তরণ ঘটলে উন্নয়নের প্রতিটি স্তরে জনমতের গুরুত্ব বাড়ে, যা শেষ পর্যন্ত একটি সুষম ও কল্যাণমুখী অর্থনৈতিক কাঠামো তৈরি করে।

একটি মুক্ত সমাজের অন্যতম পরিচয় হলো মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। গণতন্ত্রের সংকটে এই স্বাধীনতা সবার আগে আক্রান্ত হয়। যখন কোনো নাগরিক বা সংবাদকর্মী রাষ্ট্রের ভুল নীতির সমালোচনা করতে ভয় পায়, যখন সত্য বলার অপরাধে কারাগারে যেতে হয়, তখন সেই সমাজটি সৃজনশীলতা হারিয়ে ফেলে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা শুধু সাংবাদিক বা বুদ্ধিজীবীদের জন্য নয়, এটি সাধারণ মানুষের আত্মরক্ষার কবজ। ভিন্নমতকে দমন করার অর্থ হলো সত্যের কণ্ঠরোধ করা। একটি কার্যকর গণতন্ত্রে সরকারের গঠনমূলক সমালোচনাকে স্বাগত জানানো হয়, কারণ সমালোচনাই ভুল সংশোধনের পথ দেখায়। তাই গণতন্ত্রের পথে ফেরার অর্থ হলো ভয়হীন এক সমাজ বিনির্মাণ করা, যেখানে মানুষের কণ্ঠস্বর হবে রাষ্ট্রের চালিকাশক্তি।

আইনের শাসন বলতে যখন শুধু সবলদের ইচ্ছা বাস্তবায়িত হয়, তখন সাধারণ মানুষ বিচারালয়ের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি একটি সমাজকে ধ্বংসের কিনারে নিয়ে যায়। গণতন্ত্রের উত্তরণ ছাড়া এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাধীন করা অসম্ভব। নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন এবং প্রশাসনের নিরপেক্ষতা তখনই নিশ্চিত হয় যখন রাষ্ট্রকাঠামোটি গণতান্ত্রিক থাকে। রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত একটি প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হলে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং গণতান্ত্রিক চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স অত্যন্ত জরুরি।

তরুণ প্রজন্মের কথা চিন্তা করলে গণতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা আরও প্রকট হয়ে ওঠে। বর্তমানের বিশ্বায়নের যুগে তরুণরা মেধা এবং যোগ্যতার মূল্যায়ন চায়। কিন্তু যে ব্যবস্থায় শুধু দলীয় পরিচয় বা ক্ষমতার আনুকূল্যই সাফল্যের চাবিকাঠি হয়, সেখানে তরুণরা হতাশ হয়ে পড়ে। এই মেধা পাচার এবং তরুণদের বিমুখতা একটি জাতির জন্য দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি। গণতন্ত্রের উত্তরণ ঘটলে তরুণরা নতুন রাজনৈতিক নেতৃত্ব তৈরিতে ভূমিকা রাখতে পারবে এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় তাদের সতেজ চিন্তার প্রতিফলন ঘটবে। রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরেও গণতন্ত্রের চর্চা শুরু হওয়া দরকার, যাতে ত্যাগী ও যোগ্য কর্মীরা নেতৃত্বে আসতে পারেন। উত্তরাধিকার বা ক্ষমতার মোহের পরিবর্তে যদি জনসেবার রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত হয়, তবেই দেশ গড়ার নতুন কারিগর তৈরি হবে।

গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের এই যাত্রা কোনো বিশেষ ব্যক্তি বা দলের জন্য নয়, এটি ১৬ কোটি মানুষের মুক্তির সনদ। গত কয়েক দশকের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা আমাদের শিখিয়েছে যে, ক্ষমতার পালাবদল মানেই শুধু চেহারার পরিবর্তন নয়, বরং শাসন পদ্ধতির পরিবর্তন হতে হবে। ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু থেকে জনগণকে দূরে ঠেলে দিয়ে কোনো রাষ্ট্র দীর্ঘকাল স্থিতিশীল থাকতে পারে না। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ, সহনশীলতা এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ফিরিয়ে আনা এখন সময়ের দাবি। ধ্বংসাত্মক রাজনীতির পরিবর্তে গঠনমূলক ও জনমুখী রাজনীতির সূচনা করতে হবে। একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করাই হলো এই সংকটের একমাত্র সমাধান।

পরিশেষে, গণতন্ত্র কোনো বিলাসিতা নয়, এটি আমাদের মৌলিক অধিকার। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার- যার মূল ভিত্তিই ছিল গণতন্ত্র।

সেই চেতনার আলোকে একটি বৈষম্যহীন সমাজ গড়তে হলে আমাদের আবারও গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরে আসতে হবে। অন্ধকার যত গভীরই হোক, ভোরের আলো ফুটবেই। বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষ বারবার রক্ত দিয়ে প্রমাণ করেছে যে তারা স্বৈরাচারী শাসন মেনে নেয় না। আজ আবারও সময় এসেছে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার। সংকীর্ণ গোষ্ঠীস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে দেশপ্রেমের মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে যদি আমরা গণতন্ত্রের উত্তরণ নিশ্চিত করতে পারি, তবেই একটি সুখী, সমৃদ্ধ ও আত্মমর্যাদাশীল রাষ্ট্র হিসেবে আমরা বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারব। গণতন্ত্রের জয়ই হোক আমাদের সকলের কাম্য, কারণ এই পথেই নিহিত রয়েছে আমাদের চূড়ান্ত মুক্তি।

পরিশেষে বলা যায়, গণতন্ত্র কোনো নিছক বিলাসিতা বা নিছক শাসন পদ্ধতি নয়; এটি একটি রাষ্ট্রের বেঁচে থাকার অক্সিজেন এবং নাগরিকের আত্মমর্যাদার রক্ষাকবচ।

বাংলাদেশের দীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাস ও সংগ্রামের প্রতিটি অধ্যায় আমাদের এই সত্যটিই বারবার স্মরণ করিয়ে দেয় যে, যখনই জনগণের অধিকার হরণ করা হয়েছে এবং ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে সাধারণ মানুষকে দূরে ঠেলে দেওয়া হয়েছে, তখনই রাষ্ট্র কাঠামোগতভাবে ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে। আজ আমরা জাতীয় জীবনের যে বহুমুখী সংকটের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছি- তা সে অর্থনৈতিক বিপর্যয় হোক, সামাজিক অস্থিরতা হোক কিংবা বিচারহীনতার সংস্কৃতি হোক- তার প্রতিটি জট পাকিয়ে আছে দীর্ঘদিনের গণতান্ত্রিক অভাবের মধ্যে। একটি বৈষম্যহীন, শোষণমুক্ত ও স্বনির্ভর রাষ্ট্র গড়ার স্বপ্ন শুধু তখনই সার্থক হবে, যখন প্রতিটি নাগরিক তার ভোটাধিকার ফিরে পাবে এবং রাষ্ট্রের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অংশীদারিত্ব নিশ্চিত হবে।

গণতন্ত্রের উত্তরণ মানে শুধু এক দলের পরিবর্তে অন্য দলের ক্ষমতায় যাওয়া নয়, বরং এটি হলো এমন একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা যেখানে আইনের শাসন হবে প্রশ্নাতীত, প্রতিটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হবে প্রভাবমুক্ত এবং দুর্নীতি হবে একটি অযোগ্যতা। অন্ধকার যত ঘনীভূতই হোক না কেন, ইতিহাসের অমোঘ নিয়ম এই যে, জনগণের সম্মিলিত আকাঙ্ক্ষা ও ন্যায়ের লড়াইয়ের সামনে কোনো শক্তিই চিরস্থায়ী হতে পারে না। মহান মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার, পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য গণতন্ত্রের পথে ফেরার কোনো বিকল্প নেই। এটি কোনো আপসের বিষয় নয়, বরং অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই।

আমাদের মনে রাখতে হবে, গণতন্ত্রহীনতা একটি জাতির প্রাণশক্তি ও সৃজনশীলতাকে হত্যা করে সমাজকে পঙ্গু করে দেয়, আর গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধার সেই মৃতপ্রায় জাতিকে পুনরায় নতুন জীবন দান করে। তাই সংকীর্ণ গোষ্ঠীস্বার্থ ও দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও সর্বজনগ্রাহ্য নির্বাচনী ব্যবস্থার মাধ্যমে জনগণের প্রকৃত শাসন কায়েম করাই হোক আমাদের বর্তমান সময়ের প্রধান অঙ্গীকার। এই গণতান্ত্রিক উত্তরণের মাধ্যমেই আমরা একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ এবং দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে পারি। জনগণের হাত ধরে গণতন্ত্রের এই নতুন পথচলাই হবে আমাদের জাতির জন্য চূড়ান্ত মুক্তি এবং আগামীর প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ ও বাসযোগ্য বাংলাদেশ গড়ার একমাত্র সোপান।

ওসমান গনি

সাংবাদিক ও কলামিস্ট

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত