প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ২৬ ডিসেম্বর, ২০২৫
বাংলাদেশের অর্থনীতির চালিকা শক্তি কী? সাধারণভাবে এই প্রশ্নের উত্তরে বলব কৃষি, শিল্প কিংবা রপ্তানি। এসব খাত ছাড়াও প্রবাসীদের পাঠানো ডলার দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। দেশের অর্থনীতি যখন বৈশ্বিক মন্দা কিংবা মুদ্রাস্ফীতির মতো সংকটে পড়ে তখন বিদেশ থেকে পাঠানো রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের ডলার দেশের অর্থনীতির মেরুদন্ড সোজা রাখে।
প্রবাসী কল্যাণ, বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ও জনশক্তি ব্যুরো (বিএমটি)-এর জরিপ অনুযায়ী বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশি প্রবাসীর সংখ্যা ১ কোটি ৫০ লক্ষের উপরে। প্রতিবছর প্রায় ১০ লক্ষ নতুন শ্রমিক প্রবাসে পাড়ি জমান। দেশের বাইরে থাকা প্রবাসী শ্রমিকের অর্ধেকেরও বেশি সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে কর্মরত আছেন। ২০২৩ সালে বার্ষিক রেমিট্যান্স ছিল প্রায় ২৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বিশ্বের সপ্তম সর্বোচ্চ। ২০২৪ সালে এই রেমিট্যান্স বেড়ে দাঁড়াই ২৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিএসএস এর রিপোর্ট অনুযায়ী মার্চ ২০২৫ পর্যন্ত (৯ মাসে) প্রায় ১০ লক্ষ কর্মী বিদেশে গেছেন।
ফলে চলতি বছরে রেমিট্যান্স প্রবাহ ব্যাপক হারে বেড়েছে। গত এক দশকে গড়ে প্রতিবছর ১৮ থেকে ২৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রবাসী আয়ের মাধ্যমে দেশে এসেছে । যা মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৪০-৫০ শতাংশের সমান। বর্তমানে রেমিট্যান্স ছাড়া বাংলাদেশের অর্থনীতি মেরুদণ্ডহীন দেহের মতো। দেশের জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় প্রতিবছর জ্বালানি, খাদ্যশস্য, শিল্পের কাঁচামাল, ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশ ও ভোগ্যপণ্যের জন্য গড়ে ৬০-৭০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি আমদানি ব্যয় হচ্ছে। বিশ্ব ব্যাংকের হিসাব মতে সাউথ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ রেমিট্যান্স গ্রহণকারী শীর্ষ দেশগুলোর অন্যতম। রেমিট্যান্স থেকে দেশের মোট জিডিপির প্রায় ৬-৭ শতাংশ সরাসরি আসে। ২০২০ সালে কোভিড পরবর্তী সময় গোটা বিশ্বে যখন অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিয়েছিল, তখন রেমিট্যান্স যোদ্ধারাই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে ভেঙ্গে পড়া থেকে রক্ষা করেছিলেন। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের রিজার্ভের একটা বড় অংশই আসে প্রবাসী কর্মীর আয় থেকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, রেমিট্যান্স প্রবাহ স্বাভাবিকভাবে চলতে থাকলে দেশের মাসিক আমদানি ব্যয়ের ৪-৫ মাসের সমপরিমাণ রিজার্ভ ধরে রাখা সম্ভব। দেশের রিজার্ভ যত শক্তিশালী হবে, আন্তর্জাতিক মহলে বিশ্বাসযোগ্যতা তত বেড়ে যাবে। অন্যদিকে রেমিট্যান্স ধস নামলে ডলার সংকট দেখা দিবে। ফলে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।
দেশের বেকারত্ব নিয়ন্ত্রণেও রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের অবদান রয়েছে। প্রতিবছর ৮-১০ লক্ষ শ্রমিক বিদেশে গমন করেন। ফলে দেশের শ্রমবাজারের ওপর চাপ কমে। রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের জীবন সংগ্রাম খুব সহজ নয়। প্রতিদিন তাদের দুশ্চিন্তা, আশঙ্কা, হতাশা ও ঝুঁকির মধ্য দিয়ে পার করতে হয়। মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ কিংবা আফ্রিকায় অবস্থিত প্রবাসীদের কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। তারা তাদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ত্যাগ করে অনেক ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত হন। মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় ৭০ শতাংশ প্রবাসী স্বল্পমজুরিতে পূর্ণঘন্টা কাজ করেন। অনেক নারী শ্রমিক আছেন যারা দিনের পর দিন অত্যাচার, নির্যাতন সহ্য করে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন।
রেমিট্যান্সের বড় একটি অংশ দেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে সরাসরি প্রবেশ করে। দেশের অধিকাংশ প্রবাসী গ্রামের নিম্নবিত্ত কিংবা মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। তাদের পাঠানো রেমিট্যান্সে গড়ে ওঠে দালান-কোঠা, ছোটছোট ব্যবসা, কৃষিতে বিনিয়োগ, শিক্ষা ব্যয় ও পরিবারের চিকিৎসা ব্যয়। বাংলাদেশের গ্রাম পর্যায়ে অনেক নিম্নবিত্ত পরিবার রেমিট্যান্সে তাদের সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হচ্ছেন। এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ৬০% গ্রামীণ এলাকায় ব্যয় হয়। তারা নিজের প্রয়োজন সীমিত করে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ অর্থ দেশে পাঠিয়ে দেন।
অর্থনীতিবিদদের ধারণা, প্রবাসীদের প্রকৃত রেমিট্যান্সের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এখনো বৈধ ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে রয়ে গেছে। যদিও রেমিট্যান্স প্রবাহ দেশের অর্থনীতির জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ, তবে হুন্ডির মতো অনানুষ্ঠানিক চ্যানেল বড় ধরণের চ্যালেঞ্জ। অবৈধভাবে টাকা পাঠানোর ফলে সরকারি রাজস্ব ও রেমিট্যান্স ব্যবস্থাপনা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই সমস্যাটি হওয়ার পেছনেও কয়েকটি কারণ রয়েছে। যেমন দেশের ব্যাংকিং সেবার জটিলতা ও প্রবাসীদের আস্থার অভাব। দেশের অর্থ মন্ত্রণালয় ও প্রশাসন যদি এই সমস্যা দূর করতে সক্ষম হয় তাহলে বৈধ রেমিট্যান্সে রাজস্ব খাত সমৃদ্ধ হবে।
প্রবাসে শ্রমিক নির্যাতন যেন এখন স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। খবরের কাগজ, সোশ্যাল মিডিয়া কিংবা টেলিভিশন অন করলেই দেখতে পাচ্ছি অহরহ প্রবাসী নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এছাড়াও রিক্রুটিং এজেন্সির প্রতারণা রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের ঝুঁকির মুখে ফেলছে। ভালো কাজের আশ্বাস দিয়ে প্রবাসে পাঠিয়ে দিলেও তারা আশানুরূপ কাজ পাচ্ছেন না। ফলে দেশের অধিকাংশ যুবক প্রবাসে যেতে অনিহা প্রকাশ করছেন। ভিসা জটিলতার কারণে মানুষজন ধৈর্য হারা হয়ে পড়ছেন।
প্রবাসীদের আমরা শুধু ডলার পাঠানোর মেশিন মনে করি। আমাদের উচিত তাদের সম্পর্কে এমন ধ্যান-ধারণা থেকে বেরিয়ে আসা। তাদেরকে সম্মান ও মর্যাদার সাথে নীতিগত স্বীকৃতি নিশ্চিত করা অতীব জরুরি। প্রবাসীদের জন্য ডিজিটাল রেমিট্যান্স প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা এখন সময়ের দাবি।
দেশে বিনিয়োগের নিরাপদ সুযোগ তৈরি করতে পারলে তারা সম্পূর্ণ আস্থার সাথে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে কাজে লাগাতে পারবে। প্রবাসীদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে বিমানবন্দরে শৃঙ্খলা, স্বচ্ছতা, নিরাপত্তা ও গতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে। তাদের পাঠানো রেমিট্যান্সে আমাদের অর্থনীতির চাকা বেগবান হলেও তাদের প্রতি সুন্দর ব্যবহার উপেক্ষিত। অনেক প্রবাসী মৃত্যুবরণ করলে তাদের লাশটা পর্যন্ত পরিবারের কাছে পৌঁছায় না। যা একটা প্রবাসীর পরিবারের কাছে সবচেয়ে বেদনাদায়ক। স্বাভাবিকভাবে দেখলে রেমিট্যান্স বিলিয়ন ডলারের অঙ্ক মাত্র, কিন্তু বাস্তবে এটি লাখো প্রবাসীর ঘাম, ত্যাগ ও স্বপ্নের সমষ্টি। তাদের অবদানকে স্বীকার করে জাতীয় মর্যাদা ও ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। রেমিট্যান্স যোদ্ধারা বাঁচলে শুধু একটি পরিবার নয়- বাঁচে পুরো দেশের অর্থনীতি।
লোটাস জাহাঙ্গীর
শিক্ষার্থী, ইতিহাস বিভাগ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়