ঢাকা শনিবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২ পৌষ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

কিশোর অপরাধ ও গ্যাং কালচারের উত্থান এবং অপরাধের ভয়াবহতা

মো. নূর হামজা পিয়াস
কিশোর অপরাধ ও গ্যাং কালচারের উত্থান এবং অপরাধের ভয়াবহতা

অপরাধ করার আগে অপরাধীরা কীভাবে চিন্তা করে, তাদের মানসিক বৈশিষ্ট্য ও সামাজিক প্রভাব কীভাবে ভূমিকা রাখে তা বোঝার জন্য অপরাধবিদ্যা একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। এটি কেবল অপরাধের ধরন নয়, বরং কেন এবং কীভাবে অপরাধ ঘটে, তার গভীর মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করে। বিশেষ করে কিশোর অপরাধের ক্ষেত্রে অপরাধবিদ্যা দেখায়, কীভাবে কৈশোরের আবেগ, পারিবারিক অবহেলা, সামাজিক প্রভাব ও মানসিক দ্বন্দ্ব একত্রে একজন কিশোরকে ভুল পথে ঠেলে দেয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, এই বোঝাপড়া এখন আরও জরুরি, কারণ অপরাধের হার যেমন বেড়েছে, তেমনি অপরাধের ধরনও বহুমুখী হয়েছে।

একসময় টেলিভিশন নাটক বা সিনেমায় কিশোর অপরাধের কাহিনি শুধু কল্পনা মনে হতো, কিন্তু আজ তা বাস্তব জীবনের এক নির্মম সত্যে পরিণত হয়েছে। দেশের বড় শহরগুলো থেকে শুরু করে ছোট শহর ও গ্রাম পর্যন্ত, কিশোর গ্যাং, মাদক, চুরি, ছিনতাই, এমনকি খুনের ঘটনাও নিয়মিত ঘটছে। ২০২৫ সালের বাংলাদেশ পুলিশের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত এক বছরে কিশোর অপরাধের হার বেড়েছে প্রায় ২৩ শতাংশ। ঢাকায় নিবন্ধিত কিশোর অপরাধীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩,২০০-এরও বেশি, যার একটি বড় অংশ গ্যাং-সংক্রান্ত সহিংস কর্মকাণ্ডে যুক্ত।

কোহলবার্গের নৈতিক বিকাশ তত্ত্ব অনুসারে, একজন শিশুর নৈতিক বিকাশ তিনটি ধাপে এগোয় যা হলো: প্রাক-প্রচলিত, প্রচলিত এবং প্রচলিত-পরবর্তী পর্যায়। শিশুরা প্রথমে শাস্তির ভয় থেকে কাজ শিখে, পরে সমাজের নিয়মকে সম্মান করতে শেখে এবং প্রাপ্তবয়সে নিজের নৈতিক অবস্থান গঠন করে। কিন্তু বাংলাদেশে আজকের কিশোররা এই স্বাভাবিক নৈতিক বিকাশের ধারা থেকে সরে যাচ্ছে। মোবাইল গেমস, অনলাইন হিংস্রতা ও সামাজিক অস্থিরতা তাদের নৈতিক চিন্তাকে বিকৃত করছে। ফলে তাদের কাছে সঠিক-ভুলের সীমারেখা ধীরে ধীরে অস্পষ্ট হয়ে পড়ছে।

একটি শিশুর আচরণ জন্মগতভাবে আসে, নাকি তার পারিপার্শ্বিকতা তাকে অপরাধের দিকে ঠেলে দেয় এই বিতর্ক পুরোনো হলেও আজও প্রাসঙ্গিক। বাংলাদেশে দেখা যায়, নিম্নবিত্ত পরিবারে বেড়ে ওঠা, পারিবারিক সহিংসতা ও শিক্ষার অভাব প্রায়ই কিশোর অপরাধের মূল কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অপরদিকে, কিছু শিশু অপেক্ষাকৃত আর্থিকভাবে স্বচ্ছল পরিবার থেকেও অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে, যা প্রমাণ করে যে শুধু দারিদ্র্য নয়, নৈতিক দিক থেকেও সমাজে ভারসাম্য হারিয়েছে। প্রকৃতি ও পরিবেশ উভয়ই কিশোর অপরাধের জন্মে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

পারিবারিক বন্ধন ও ভালোবাসার ঘাটতি একটি শিশুর মনোজগতে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে। বাবা-মায়ের ঝগড়া, অবহেলা বা সহিংসতা শিশুর মধ্যে একধরনের মানসিক অস্থিরতা তৈরি করে, যা পরবর্তীতে সমাজবিরোধী আচরণে পরিণত হয়। বাংলাদেশে বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ৭০ শতাংশ কিশোর অপরাধীর পরিবারে নিয়মিত পারিবারিক দ্বন্দ্ব বা সহিংসতার ঘটনা ঘটে। অনেকেই তাদের বাবা-মাকে ভয় পায়, কিন্তু ভালোবাসে না এই মানসিক দূরত্বই তাদের অপরাধের দিকে ঠেলে দেয়।

কৈশোর জীবনের এমন এক পর্যায় যেখানে মানসিক ও শারীরিক পরিবর্তন একসঙ্গে ঘটে। এই সময়ে হরমোনের পরিবর্তন একজন কিশোরকে অস্থির, বিদ্রোহী এবং কখনও আক্রমণাত্মক করে তোলে। ২০১৯ সালের আদেশ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা বলছে, শহরের কিশোরদের মধ্যে আগ্রাসনের হার ছিল প্রায় ৫২ শতাংশ। ২০২৫ সালে বাংলাদেশ মনোবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, এই সংখ্যা বেড়ে ৬১ শতাংশে পৌঁছেছে। যদি এই আবেগকে সঠিক পথে পরিচালিত করা না যায়, তবে কিশোররা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে নিজেকে প্রমাণের ভুল পথ বেছে নেয়।

মানুষ স্বভাবতই অনুকরণপ্রিয়, তাই মানুষ অন্যদের আচরণ দেখে শেখে। বাংলাদেশে আজকের কিশোররা অনলাইনে সহিংস ভিডিও, অপরাধমূলক কনটেন্ট, এমনকি রাজনৈতিক সংঘর্ষও নিয়মিত দেখছে। এর ফলে তাদের মস্তিষ্কে হিংস্রতা এক ধরনের ‘স্বাভাবিকতা’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে। একসময় যে বিষয়গুলোকে ঘৃণা করা শেখানো হতো, এখন সেগুলোই বিনোদনের অংশে পরিণত হয়েছে। এই সামাজিক শিক্ষাই কিশোরদের মনে অপরাধের প্রতি কৌতূহল তৈরি করছে।

কিশোরদের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার অন্যতম বড় কারণ হলো সমবয়সীদের প্রভাব। অনেক সময় বন্ধুরা ভুল পথে গেলে, একজন কিশোরও তাদের অনুসরণ করে, কারণ তার কাছে বন্ধুত্বই ‘গ্রহণযোগ্যতা’র প্রতীক। ঢাকার বিভিন্ন গ্যাং বা কিশোর চক্রে দেখা গেছে, একবার গোষ্ঠীর সদস্য হয়ে গেলে কিশোররা তা থেকে বেরিয়ে আসতে চায় না, বরং আরও গভীরে ডুবে যায়। ২০২৫ সালের গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, রাজধানীতে সক্রিয় কিশোর গ্যাংয়ের সংখ্যা এখন ৫৫টিরও বেশি, যার মধ্যে ৭০ শতাংশ সদস্য ১৮ বছরের নিচে।

মানুষ স্বভাবতই সুখ খোঁজে এবং যন্ত্রণা এড়াতে চায়। কিশোরদের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নয়। তারা প্রায়ই তাৎক্ষণিক তৃপ্তি বা রাগের বশে অপরাধ করে ফেলে। সামান্য অপমান, সামাজিক লজ্জা বা প্রতিশোধের ইচ্ছা থেকেই তারা মারাত্মক সিদ্ধান্ত নিতে পারে। অনেক কিশোরই মনে করে, অন্যের প্রতি প্রতিশোধ নিলেই সে নিজের মানসম্মান ফিরিয়ে আনতে পারবে। এই অপরিপক্ব মানসিকতা তাদের অপরাধে ঠেলে দেয়, কারণ তাদের মস্তিষ্ক তখনও পরিণত হয়নি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে।

কিশোর গ্যাংগুলো প্রায়শই স্থানীয় প্রভাবশালীদের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে থাকে। এই ‘বড় ভাইদের’ ছত্রছায়ায় থাকায় কিশোররা নিজেদের শক্তির উৎস খুঁজে পায় এবং কোনো ভয় ছাড়াই অপরাধ করে চলে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের এই দায়িত্বহীনতা সামাজিক শৃঙ্খলাকে দুর্বল করে। ২০২৫ সালের রিপোর্টে দেখা যায়, কিছু এলাকায় কিশোর গ্যাংগুলো ভোটের রাজনীতি এবং চাঁদাবাজির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

কিশোর অপরাধের অন্যতম প্রধান অনুঘটক হলো মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতা। গাঁজা, ইয়াবা, ড্যান্ডি বা সলিউশন কম দামে এবং সহজে এসব নেশাদ্রব্য পাওয়া যাওয়ায় কিশোররা দ্রুত আসক্ত হয়ে পড়ছে। একবার মাদকাসক্ত হয়ে পড়লে, মাদকের অর্থ জোগাড়ের জন্য তারা চুরি, ছিনতাই বা ডাকাতির মতো গুরুতর অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। ২০২৫ সালে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, রাজধানীতে আটক কিশোর অপরাধীদের ৬০ শতাংশের বেশি কোনো না কোনো মাদকে আসক্ত ছিল। মাদকের সরবরাহ রুট বন্ধ করা এবং কিশোরদের জন্য সহজলভ্য মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র স্থাপন করা।

স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট এখন কিশোর অপরাধের নতুন প্ল্যাটফর্ম। অনলাইন প্রতারণা, সাইবারবুলিং, ব্ল্যাকমেইল, এমনকি পর্নোগ্রাফিক কনটেন্টে আসক্তি কিশোরদের নৈতিক অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ। বাংলাদেশ পুলিশের সাইবার ইউনিটের ২০২৫ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, গত ১ বছরে ১৮ বছরের নিচে প্রায় ১,৪০০ কিশোর বিভিন্ন ধরনের অনলাইন অপরাধে জড়িত হয়েছে। ডিজিটাল দুনিয়ার অন্ধ দিকগুলো এখন বাস্তব জীবনের অপরাধে রূপ নিচ্ছে।

কিশোর অপরাধের ঘটনাগুলো গণমাধ্যমে যেভাবে প্রচার হয়, তা অনেক সময় অজান্তেই অপরাধীদের ‘হিরোইজম’ বা খ্যাতি এনে দেয়। বিস্তারিত অপরাধ কৌশল এবং গ্যাং লিডারদের পরিচয়ের প্রচার অনেক নতুন কিশোরকে এই পথে আসতে উৎসাহিত করে। গণমাধ্যমের উচিত অপরাধের প্রতিবেদন করার সময় সংবেদনশীলতা বজায় রাখা, শুধু ভীতি ছড়ানো নয়, বরং অপরাধের সামাজিক কারণ ও পুনর্বাসনের দিকগুলো তুলে ধরা। অপরাধীদের পরিচয় প্রকাশের ক্ষেত্রে কঠোর নীতিমালা অনুসরণ করা জরুরি, যাতে তাদের ভবিষ্যতের পুনর্বাসনের পথ কঠিন না হয়।

কিশোর অপরাধীদের বিচারের জন্য বাংলাদেশে শিশু আইন, ২০১৩ কার্যকর আছে, কিন্তু এর কার্যকর প্রয়োগ ও অবকাঠামোর অপ্রতুলতা একটি বড় সমস্যা। দেশের জনসংখ্যার তুলনায় কিশোর সংশোধনাগার এবং জুভেনাইল কোর্ট বা শিশু আদালতের সংখ্যা খুবই কম। ফলে আটক কিশোরদের অনেক সময় প্রাপ্তবয়স্কদের সঙ্গে একই হাজতে রাখা হয়, যা তাদের অপরাধপ্রবণতা আরও বাড়িয়ে দেয়। বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতার কারণে অনেক কিশোর বিচারের আগেই গুরুতর অপরাধীদের সংস্পর্শে এসে আরও বেশি অপরাধী হয়ে ওঠে। কিশোর অপরাধ দমন নয়, বরং পুনর্বাসন ও সংশোধনে জোর দিতে আইন ও বিচার ব্যবস্থায় বড় ধরনের বিনিয়োগ প্রয়োজন।

বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় নৈতিক শিক্ষা আজ প্রায় বিলুপ্ত। পরীক্ষার চাপ, নম্বরের প্রতিযোগিতা ও বেসরকারি কোচিং সংস্কৃতি শিক্ষাকে মেশিনগত করে তুলেছে। শিক্ষকরা এখন আর শিশুর চরিত্র গঠনে তেমন ভূমিকা রাখতে পারেন না। ফলে কিশোররা জ্ঞান অর্জন করছে, কিন্তু মানবিক মূল্যবোধ হারাচ্ছে। স্কুলে যদি নৈতিক শিক্ষা ও কাউন্সেলিং সেবা জোরদার করা যায়, তবে অনেক অপরাধই শুরু হওয়ার আগেই থামানো সম্ভব।

কিশোরদের শারীরিক ও মানসিক শক্তিকে ইতিবাচক পথে চালিত করার সবচেয়ে বড় মাধ্যম হলো খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক চর্চা। কিন্তু নগরায়ণ এবং জমির বাণিজ্যিকীকরণের কারণে গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত খেলার মাঠগুলো প্রায় বিলুপ্ত। স্কুলগুলোতেও খেলাধুলার চেয়ে পরীক্ষার ফলাফলের ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়। এই সৃজনশীল আউটলেটের অভাব কিশোরদের মধ্যে হতাশা তৈরি করে এবং তারা দলবদ্ধভাবে সময় কাটাতে সহজ ও ক্ষতিকর উপায় (যেমন গ্যাং তৈরি বা মাদকাসক্তি) বেছে নেয়। ২০২৫ সালের জরিপ অনুযায়ী, ঢাকার মাত্র ২০ শতাংশ স্কুলে খেলার মাঠ রয়েছে। সুস্থ সমাজ গঠনে মাঠের সংখ্যা বাড়ানো এবং সাংস্কৃতিক চর্চা বাধ্যতামূলক করা জরুরি। কিশোর অপরাধ দমন শুধু আইনের দায়িত্ব নয়, সমাজেরও। রাষ্ট্রকে শিশু সুরক্ষা নীতি, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা ও সচেতনতা কার্যক্রমকে একসঙ্গে কার্যকর করতে হবে। স্থানীয় প্রশাসন, শিক্ষক, অভিভাবক ও ধর্মীয় নেতাদের সমন্বিত প্রচেষ্টা অপরাধ প্রতিরোধে ভূমিকা রাখতে পারে। বর্তমানে বাংলাদেশে কিশোর অপরাধীদের পুনর্বাসন কেন্দ্র থাকলেও সেগুলোর অবস্থা করুণ। সেখানে প্রকৃত কাউন্সেলিং বা মানসিক পুনর্গঠন কার্যক্রম প্রায় অনুপস্থিত।

কিশোররা জন্মগতভাবে অপরাধী নয়। তাদের গড়ে তোলে সমাজ, পরিবার ও শিক্ষা। যদি আমরা তাদের মানসিক জগৎ বুঝে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারি, তবে অপরাধের এই ধারা থামানো সম্ভব। সমাজকে বুঝতে হবে শাস্তির চেয়ে ভালোবাসা, বিচারকের চেয়ে পথপ্রদর্শক বেশি কার্যকর। প্রতিটি শিশুর মধ্যে লুকিয়ে আছে সম্ভাবনার আলো, শুধু দরকার সেই আলো জ্বালিয়ে তোলার সঠিক পরিবেশ।

মো. নূর হামজা পিয়াস

শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত