প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ২৭ ডিসেম্বর, ২০২৫
একটি রাষ্ট্রের মেরুদণ্ড হলো শিক্ষা, আর সেই শিক্ষার ভিত্তি গড়ে দেয় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। কিন্তু যখন এই প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরেই ন্যায়বিচারের কণ্ঠরোধ করা হয়, তখন তা শুধু একজন ব্যক্তির ওপর আঘাত নয়, বরং পুরো প্রশাসনিক ব্যবস্থার ওপর এক কলঙ্কজনক অধ্যায় হয়ে দাঁড়ায়। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলা বা অন্যায়ের প্রতিবাদ করা কি অপরাধ? প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অধীনস্থ কার্যালয়ের অনেক কর্মচারীর জীবন আজ সেই প্রশ্নই তুলছে। বারবার মিথ্যা বিভাগীয় মামলা এবং মৃত মানুষকে সাক্ষী বানিয়ে তদন্তের নামে যে প্রহসন চলছে, তা যেন কোনো অন্ধকার যুগের গল্প। এটি শুধু একজন কর্মচারীর দুর্দশা নয়, বরং সৎ কর্মচারীদের মনোবল ভেঙে দেওয়ার এক পরিকল্পিত নীলনকশা।
এক ধরনের অসৎ চক্রের সাহায্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন অধিদপ্তরে গায়েবী বিভাগীয় মামলার মহোৎসব বিরাজ করছে। মামলাবাজি জগতের নতুন এসংস্করণে এগিয়ে রয়েছে মিরপুরে-২ এ অবস্থিত প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। এ অধিদপ্তর কেন্দ্রিক নতুন করে আবির্ভূত হওয়া একটি বিশেষ সিন্ডিকেটের ছত্রছায়ায় দেশব্যাপী নিজেদের আস্থাভাজন অসাধু কর্মচারীদের চাহিদা মতো দপ্তরে পোস্টিং প্রদান করতে এবং তাদের কর্মকাণ্ডে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে এমন সৎ ও নিষ্ঠাবান কর্মচারীকে সরিয়ে দিতে নবউদ্ভাবিত মামলা জগতের এ সংস্করণটি আবিষ্কার করা হয়েছে বলে মনে করেন ওয়াকিবহাল মহল। মিথ্যা মামলায় জর্জরিত হয়ে অবশেষে বিচারিক আদালতে খালাস প্রাপ্ত ভুক্তভোগী ও রেহাই পাচ্ছে না এসব গায়েবী মামলা হতে। খালাস প্রাপ্ত একই অভিযোগে একাধিক মিথ্যা বিভাগীয় মামলা-সহ এ ধরনের ‘মরার উপর খাঁড়ার ঘা’ এ অনেকে এরইমধ্যে সর্বস্বান্ত হয়েছেন।
এ কুচক্রী মহল বিভিন্ন ফন্দি এটেও তাদের টার্গেটকৃত কর্মচারীকে ঘায়েল করে খায়েশ মেটাতে ব্যর্থ হয়ে অবশেষে ফ্যাসিস্ট তকমা দিয়েও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে সক্ষম হচ্ছে। নানা ক্ষেত্রে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে চক্রটি নিজেদের আজ্ঞাবাহক তথাকথিত একজনকে আবেদনকারী সাজিয়ে, অলীক কলঙ্ক লেপন করার জন্য আবেদনপত্র অধিদপ্তরটির শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তার কাছে প্রেরণ করে, বর্তমান সময়ে শক্তিশালী চক্রটি কল করে তাৎক্ষণিকভাবে কর্মকর্তাকে প্রলুব্ধ করে বিভাগীয় মামলা রুজু করে নিচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রে কর্মকর্তা আবেদনপত্র না পড়ে ও সংশ্লিষ্ট শাখা কে কল করে ভুয়া আবেদনের বিবাদীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা রুজু করার জন্য নির্দেশনা প্রদান করছেন। অভিজ্ঞ মহল এ অশুভ কর্মকাণ্ড এখনই বন্ধ করা না হলে দেশব্যাপী সকল অধিদপ্তরে নব-উদ্ভাবিত এ অপকর্ম দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে তারা শঙ্কিত।
যদিও,তদন্ত হলো কোনো ঘটনা বা বিষয়ের সত্যতা উদ্ঘাটনের জন্য পদ্ধতিগতভাবে তথ্য সংগ্রহ, অনুসন্ধান এবং পরীক্ষা করার প্রক্রিয়া। এর মাধ্যমে কোনো অপরাধ, সমস্যা, বা ঘটনার সঙ্গে জড়িত তথ্য এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর গভীর বিশ্লেষণ করা হয়। অভিযোগ তদন্তের জন্য সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ অনুসরণ করা হয়, এই অধিদপ্তরের ক্ষেত্রে যা মূলত একটি বিশেষ্য। অধিদপ্তরটির তদন্ত প্রক্রিয়ার মধ্যে কাগজে কলমে আছে অভিযোগ গ্রহণ, তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ বা তদন্ত কমিটি গঠন, অভিযোগপত্র ও বিবরণী প্রেরণ এবং অভিযুক্তের জবাব গ্রহণ করা। তদন্ত কর্মকর্তা বা কমিটি সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করে এবং প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন, যার ভিত্তিতে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হয়। যা এ অধিদপ্তরের ক্ষেত্রে কথার কথা হিসেবে বিবেচিত।
প্রতিহিংসার বিষাক্ত ছোবল- প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের একদল অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারী সিন্ডিকেট করে সাধারণ কর্মচারীদের জিম্মি করে রেখেছে। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে নিজ জেলা থেকে শত শত কিলোমিটার দূরে বদলি করাকে তারা শাস্তির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। যখন ভুক্তভোগীরা আইনি প্রতিকার পেতে প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের দ্বারস্থ হন এবং আদালত বদলি স্থগিত করেন, তখন শুরু হয় চরম প্রতিহিংসা। এই আইনি লড়াইকে ব্যক্তিগত অপমান হিসেবে নিয়ে কয়েকশ’ কর্মচারীর বিরুদ্ধে একের পর এক বিভাগীয় মামলা ঠুকে দেওয়া হচ্ছে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে নোয়াখালী জেলার হাতিয়া উপজেলার ডাটা এন্ট্রি অপারেটর চাকায়েত হোসেনের জীবন আজ সেই প্রশ্নই তুলছে। চাকায়েত হোসেনের ক্ষেত্রে যা ঘটছে, তা প্রশাসনিক নিষ্ঠুরতার চরম সীমা অতিক্রম করেছে। তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ায় তাকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে। অতীতে তার করা অভিযোগ তদন্ত করতে গিয়ে কর্মকর্তারা নিঝুম দ্বীপে ভ্রমণ করে আমোদণ্ডপ্রমোদ করেছেন এবং অভিযুক্তের শিখিয়ে দেওয়া কথা অনুযায়ী প্রতিবেদন দাখিল করেছেন। এটি তদন্ত নয়, বরং দুর্নীতির সুরক্ষাকবচ।
সর্বশেষ প্রহসন : মৃত মানুষের সাক্ষ্য ও কাল্পনিক অভিযোগ- সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনাটি ঘটেছে অতি সম্প্রতি। গত ১৭/১২/২০২৫ তারিখে ১০৬৫ নম্বর স্মারক মূলে তদন্ত ও শৃঙ্খলা শাখা থেকে একটি চিঠি ইস্যু করা হয়েছে, যেখানে ২৩/১২/২০২৫ তারিখে তদন্ত করা হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, এই তদন্তের ভিত্তি হলো একটি কাল্পনিক আবেদন এবং এতে এমন ব্যক্তিকে সাক্ষী করা হয়েছে যারা অনেক আগেই মৃত্যুবরণ করেছেন। মৃত মানুষ কবর থেকে উঠে এসে সাক্ষ্য দেবে- এমন হাস্যকর ও অমানবিক নাটকের মাধ্যমে একজন সরকারি কর্মচারীকে মানসিক ও সামাজিকভাবে বিপর্যস্ত করার চেষ্টা চলছে। প্রশাসনিক এই নিপীড়নের মুখে কর্মচারীরা শুধু অসহায় দর্শক হয়ে থাকতে পারেন না। তাদের করণীয়গুলো হলো-
আইনি সুরক্ষা গ্রহণ : ট্রাইব্যুনালের আদেশ অমান্য করা বা হয়রানিমূলক মামলা করলে সরাসরি উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন দায়ের করা উচিত। বিশেষ করে ‘মৃত সাক্ষী’ ও ‘কাল্পনিক অভিযোগের’ বিষয়টি আদালতের নজরে আনা জরুরি।
প্রামাণ্য দলিল সংরক্ষণ : প্রতিটি হয়রানিমূলক চিঠি, স্মারক নম্বর এবং পূর্ববর্তী তদন্তের অসংগতিগুলো ডিজিটাল ও হার্ডকপি আকারে সংরক্ষণ করতে হবে।
সম্মিলিত প্রতিবাদ : এককভাবে লড়াই করা কঠিন। ভুক্তভোগী কর্মচারীদের একটি ফোরাম গঠন করে মন্ত্রণালয় ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে স্মারকলিপি প্রদান করা উচিত।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের দ্বারস্থ হওয়া : যেহেতু এটি মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন এবং মানসিক নির্যাতন, তাই বাংলাদেশ জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দায়ের করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান- সুশাসন ও ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণ : সরকার যেখানে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ ও ‘দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন’ গড়ার অঙ্গীকার করেছে, সেখানে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের এই অরাজকতা সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করছে। সরকারের উচিত-
উচ্চপর্যায়ের বিচারবিভাগীয় তদন্ত : প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের তদন্ত ও শৃঙ্খলা শাখার কর্মকর্তাদের কার্যক্রম খতিয়ে দেখতে একটি নিরপেক্ষ কমিশন গঠন করা।
হয়রানিমূলক বদলি বন্ধ করা : বদলি নীতিমালাকে ডিজিটাল ও স্বয়ংক্রিয় করা, যাতে ব্যক্তিগত আক্রোশে কাউকে দূরে পাঠানো না যায়।
সুরক্ষা আইন প্রয়োগ : ‘জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশকারী (সুরক্ষা) আইন, ২০১১’ এর যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা, যাতে চাকায়েত হোসেনের মতো প্রতিবাদকারীরা নিরাপত্তা পান।
মন্ত্রণালয় হলো অধিদপ্তরের অভিভাবক। তাদের করণীয়-
তদন্ত স্থগিত ও পুনঃপর্যবেক্ষণ : ১৭/১২/২০২৫ তারিখের ১০৮৫ নম্বর স্মারকের তদন্তটি অবিলম্বে স্থগিত করা এবং অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ে নিরপেক্ষ টিম পাঠানো।
অসাধু কর্মকর্তাদের শাস্তি : যারা মৃত মানুষকে সাক্ষী বানিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেছে, তাদের চিহ্নিত করে সাময়িক বরখাস্ত করা।
বিভাগীয় মামলার স্বচ্ছতা : কেন একই বিষয়ে বারবার মামলা দেওয়া হচ্ছে এবং কেন মামলা খারিজ হওয়ার পরও হয়রানি চলছে, তার কৈফিয়ত তলব করা।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর কর্তৃপক্ষের করণীয়- অধিদপ্তরের শীর্ষ কর্মকর্তাদের মনে রাখা উচিত, প্রতিষ্ঠানটি কোনো ব্যক্তির জমিদারী নয়। তাদের উচিত- প্রতিহিংসা ত্যাগ করা: কর্মচারীদের শত্রু না ভেবে সহকর্মী হিসেবে গণ্য করা। তদন্ত প্রক্রিয়ার আধুনিকায়ন: তদন্তের নামে ভ্রমণ বা পিকনিক বন্ধ করে ভিডিও রেকর্ডসহ স্বচ্ছ তদন্ত নিশ্চিত করা। আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া : প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের রায়কে চ্যালেঞ্জ না করে তা মেনে নেওয়ার সংস্কৃতি গড়ে তোলা।
পরিশেষে বলতে চাই, চাকায়েত হোসেনরা সাধারণ কর্মচারী হতে পারেন, কিন্তু তাদের লড়াই আজ হাজারও লাঞ্ছিত সরকারি কর্মচারীর প্রতীক। যখন রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে মৃত মানুষের নামে চিঠি ইস্যু করা হয়, তখন বুঝতে হবে সেই ব্যবস্থার পচন কত গভীরে। এই অমানবিক হয়রানি শুধু চাকায়েত হোসেনের পরিবারকে ধ্বংস করছে না, বরং সৎ ও যোগ্য তরুণদের সরকারি চাকরিতে আসার পথকে রুদ্ধ করছে। আমরা আশা করি, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাদের বিবেক জাগ্রত করবেন। তদন্ত যেন হয়রানির নতুন অস্ত্র না হয়ে সত্য উদ্ঘাটনের মাধ্যম হয়। অন্যায়ের দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া এই কর্মচারীদের আর্তনাদ যেন সচিবালয়ের করিডোর পেরিয়ে নীতিনির্ধারকদের কানে পৌঁছায়।
ড. মো. আনোয়ার হোসেন
প্রাবন্ধিক ও কথা সাহিত্যিক