প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ২৭ ডিসেম্বর, ২০২৫
দেশের বিদ্যুৎ খাতের জন্য মরণফাঁদ হয়ে দাঁড়িয়েছে ভারতীয় শিল্পগোষ্ঠী আদানি গ্রুপের সঙ্গে সম্পাদিত বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি। এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে যে ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে, তা কেবল উদ্বেগজনকই নয়, বরং রাষ্ট্রীয় সম্পদের চরম অপচয়ের এক দলিল। প্রতিবেদনের তথ্যমতে, আদানির বিদ্যুৎ কিনতে গিয়ে গত দুই বছরে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা লোকসান গুনেছে। ২০১৭ সালে সম্পাদিত এই চুক্তির শুরু থেকেই স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন ছিল। বর্তমান পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, আদানির বিদ্যুতের দাম বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র, এমনকি ভারতের অন্যান্য কেন্দ্রের তুলনায় অনেক বেশি। যেখানে ভারতের মধ্যপ্রদেশে অন্য একটি কোম্পানি প্রতি ইউনিট মাত্র ৮ টাকা ২৫ পয়সায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে, সেখানে আদানির কাছ থেকে পিডিবিকে কিনতে হচ্ছে ১৪ টাকা ৮৬ পয়সা দরে। এমনকি নেপাল থেকে আমদানি করা বিদ্যুতের দামও আদানির চেয়ে প্রায় অর্ধেক কম।
আদানির এই চুক্তির সবচেয়ে বড় গলার কাঁটা হলো ‘ক্যাপাসিটি চার্জ’ এবং ‘কয়লার উচ্চমূল্য’। কোনো বিদ্যুৎ না কিনলেও পিডিবিকে প্রতি মাসে ৪৫০ কোটি টাকার বেশি ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে। ২৫ বছরের এই চুক্তিতে শুধু ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ আদানিকে দিতে হবে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকার বেশি-যা দিয়ে অনায়াসেই তিনটি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব। এর ওপর রয়েছে কয়লার দাম নিয়ে কারসাজি। অন্যান্য কেন্দ্র যেখানে প্রতি টন কয়লা ৭১ থেকে ৭৩ ডলারে কিনছে, সেখানে আদানির নিজস্ব খনির কয়লার জন্য পিডিবিকে দিতে হচ্ছে প্রায় ৭৭ ডলার। জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের মতে, এ চুক্তিটি দেশের জন্য একটি বড় ‘চ্যালেঞ্জ’। যেখানে দেশের নিজস্ব উৎপাদন সক্ষমতা ২৮ হাজার মেগাওয়াটের বেশি, সেখানে মাত্র ১৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের জন্য পুরো দেশকে এভাবে জিম্মি করার কোনো যৌক্তিকতা থাকতে পারে না।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে এই অসম চুক্তির বিষয়টি নিয়ে কঠোর অবস্থানে যেতে হবে। পিডিবি চেয়ারম্যান বিষয়টি সরকারকে অবগত করেছেন, যা ইতিবাচক। তবে শুধু অবগত করাই যথেষ্ট নয়; দেশের আইন ও আন্তর্জাতিক রীতি মেনে এই চুক্তি পুনঃমূল্যায়ন বা প্রয়োজনে বাতিলের আইনি পথ খুঁজতে হবে। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে আদানির সঙ্গে নতুন করে দরকষাকষি করতে হবে, যাতে বিদ্যুতের দাম যৌক্তিক পর্যায়ে নেমে আসে। জাতীয় স্বার্থকে তুচ্ছ করে কোনো বিশেষ গোষ্ঠীকে তোষণ করার নীতি থেকে সরে এসে বিদ্যুৎ খাতকে দুর্নীতি ও লোকসানের হাত থেকে রক্ষা করাই এখন সময়ের প্রধান দাবি। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অদক্ষতা নাকি দুর্নীতির কারণে এমন অসম চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল, তাও খতিয়ে দেখতে হবে।