প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ০১ জানুয়ারি, ২০২৬
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ‘আপসহীন’ শব্দটি কোনো বিশেষণের চেয়ে বেশি একটি পরিচয়ে পরিণত হয়েছে। আর এই পরিচয়ের সমার্থক নাম বেগম খালেদা জিয়া। দীর্ঘ দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের ভূ-রাজনীতি, গণতন্ত্র রক্ষা এবং আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তিনি যে অনড় অবস্থান প্রদর্শন করেছেন, তার এক অভূতপূর্ব প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই ২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, সত্তরোর্ধ্ব এক নেত্রীর আদর্শের সঙ্গে একুশ শতকের ‘জেন-জি’ বা প্রজন্মের জেন-জি-র কী সম্পর্ক? কিন্তু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, এই দুই শক্তির মাঝখানে রয়েছে এক অভিন্ন সুতো- আর তা হলো ‘আপসহীন দেশপ্রেম’। আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে একা ঢাল হয়ে দাঁড়ানো বেগম খালেদা জিয়া শুধু একজন রাজনৈতিক নেত্রী নন, তিনি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের অতন্দ্র প্রহরী ছিলেন। ১৯৮১ সালে স্বামী প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাহাদাতের পর যখন দেশের রাজনীতি এক অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছিল, তখন তিনি অন্দরমহল থেকে বেরিয়ে এসে হাল ধরেছিলেন। সেই থেকে শুরু করে আজ অবধি, আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তিনি কখনও মাথানত করেননি।
বাংলাদেশের লাল-সবুজের ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের প্রতি ইঞ্চি মাটির সঙ্গে তার সম্পর্ক নিবিড়। যখনই কোনো অপশক্তি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে চ্যালেঞ্জ করেছে, বেগম জিয়া সেখানে রাজপথের ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছেন। তার ওপর দিয়ে কম ঝড় বয়ে যায়নি। বারবার কারাবরণ, মিথ্যা মামলা, এমনকি দেশের বাইরে চলে যাওয়ার জন্য প্রচণ্ড চাপ- সবকিছুই তিনি উপেক্ষা করেছেন শুধু দেশের মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশই আমার শেষ ঠিকানা। এই দেশের বাইরে আমার কোনো ঠিকানা নেই।’ এই একটি বাক্যই তার রাজনৈতিক দর্শন এবং দেশপ্রেমের গভীরতা বোঝানোর জন্য যথেষ্ট।
জেন-জি ও খালেদা জিয়া- চেতনার সমান্তরাল রেখা : ২০২৪ সালের জুলাই মাস বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। যে তরুণ প্রজন্মকে অনেকে রাজনীতি-বিমুখ মনে করতেন, সেই ‘জেন-জি’ দেখিয়ে দিয়েছে দেশের প্রয়োজনে তারা কতটা ভয়ংকর এবং আপসহীন হতে পারে। এই প্রজন্মের বিপ্লবী স্পৃহা এবং বেগম জিয়ার দীর্ঘ লড়াইয়ের মধ্যে রয়েছে এক শতভাগ মেলবন্ধন। জুলাই অভ্যুত্থানে অন্যতম বিপ্লবী নেতা শহিদ ওসমান হাদির একটি শেষ ইচ্ছা ছিল- বেগম জিয়ার দোয়া নেওয়া। এটি কোনো সাধারণ ইচ্ছা ছিল না; এটি ছিল এক প্রজন্মের আদর্শিক উত্তরাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা। হাদি হয়তো বেগম জিয়ার দোয়া সশরীরে নিয়ে যেতে পারেননি, কিন্তু আজ তার রক্ত আর বেগম জিয়ার ত্যাগ যেন একই বিন্দুতে মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে।
জেন-জি তরুণরা কোনো আধিপত্যবাদের মদদপুষ্ট স্বৈরাচারের সঙ্গে আপস করেনি। আবু সাঈদ থেকে শুরু করে মুগ্ধ- প্রতিটি শহিদের চেহারায় সেই একই তেজ ছিল যা বেগম জিয়াকে তিন দশক ধরে টিকিয়ে রেখেছে। বন্দুকের নলের সামনে বুক পেতে দেওয়া আর বছরের পর বছর অন্ধকার কারাপ্রকোষ্ঠে তিলে তিলে ক্ষয় হওয়া- দুটিই আসলে একই চেতনার বহিঃপ্রকাশ: ‘দেশ আগে, ক্ষমতা বা জীবন পরে’।
পল্লিজননী থেকে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু : বেগম জিয়ার বেড়ে ওঠা এদেশের মাটির খুব কাছাকাছি। পল্লিগ্রামের সাধারণ এক নারী থেকে তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাংলার রাজনীতির উজ্জ্বলতম নক্ষত্র। আট-দশজন সাধারণ বাঙালি নারীর মতোই তার জীবনযাত্রা ছিল সাদামাটা।
পরিধানে চিরায়ত বাংলার শাড়ি, মাথায় আঁচল- তাকে দেখলে মনে হতো যেন গ্রামবাংলার কোনো মমতাময়ী মা তার বিশাল আঁচলে গোটা দেশটাকে আগলে রেখেছেন। মেজর জিয়ার মৃত্যুর পর তিনি যখন রাজনীতিতে আসেন, তখন তার প্রধান লক্ষ্যই ছিল স্বামী প্রদর্শিত ‘বাংলাদেশপন্থি’ রাজনীতিকে এগিয়ে নেওয়া। তিনি শুধু একজন নেত্রী হিসেবে নয়, বরং একজন অভিভাবক হিসেবে দেশের মানুষকে মমতায় আগলে রেখেছিলেন। তার এই মমতা আর দেশপ্রেমই তাকে বাংলাদেশের তিনবারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত করেছে। বিস্ময়কর হলেও সত্য, তিনি তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে ১৮ বার নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন এবং একবারের জন্যও পরাজিত হননি। এটি শুধু রাজনৈতিক সাফল্য নয়, বরং জনগণের সঙ্গে তার আত্মার সম্পর্কের এক অকাট্য প্রমাণ।
নির্যাতনের কালো অধ্যায় ও আপসহীন নেতৃত্ব : ২০০৯ সালে ক্ষমতা দখলের পর স্বৈরাচারী হাসিনা সরকার বেগম জিয়ার ওপর যে নির্মম নির্যাতন চালিয়েছে, তা বিশ্ব ইতিহাসে বিরল। দুইশো বছরের পুরোনো পরিত্যক্ত কারাগারে তাকে একাকী বন্দি রাখা হয়েছিল। এই চরম মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের মধ্যেই তিনি তার কনিষ্ঠ পুত্র আরাফাত রহমান কোকোকে হারান। একজন মায়ের কাছে সন্তানের লাশের চেয়ে ভারি কিছু হতে পারে না। তবুও তিনি বিদেশের মাটিতে নির্বাসিত বড় ছেলে তারেক রহমানের অভাব আর কোকোর মৃত্যুশোক বুকে চেপে লড়াই চালিয়ে গেছেন।
এই কঠিন সময়ে তার পাশে বিশ্বস্ত রাজনৈতিক সঙ্গী হিসেবে ছিলেন জামায়াতসহ বিরোধী জোটের নেতাকর্মীরা। হাসিনা সরকার একে একে তার বিশ্বস্ত সহচরদের বিচারিক হত্যার মাধ্যমে শেষ করে দিলেও বেগম জিয়া তার আদর্শ থেকে এক চুলও বিচ্যুত হননি। নিজের স্বামীর ভিটা থেকে তাকে উচ্ছেদ করা হয়েছে, তার স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি ভেঙে দেওয়া হয়েছে, তবুও তিনি অশুভ শক্তির সাথে হাত মেলাননি।
সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং জেন-জির উন্মাদনা : বেগম জিয়া দেশকে ভালোবেসেছেন উন্মাদের মতো। আর এই একই ‘পজিটিভ উন্মাদনা’ আমরা দেখেছি জুলাইয়ের রাজপথে। তরুণদের স্লোগান ছিল- জন্মভূমি অথবা মৃত্যু’। দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় বেগম জিয়া যেমন সবকিছু হারিয়েও মাথা নিচু করেননি, জেন-জি প্রজন্মও তেমনি জীবন দিয়ে দেশকে স্বৈরাচারমুক্ত করেছে। প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় ২ হাজার ছাত্র-জনতা, যার সিংহভাগই এই প্রজন্মের। তাদের রক্তে কেনা ২৪-এর ‘৩৬ জুলাই’ (৫ই আগস্ট) নতুন বাংলাদেশের যাত্রা শুরু করেছে। বেগম জিয়া এবং জেন-জি- উভয়ই প্রমাণ করেছে যে, যখন লক্ষ্য হয় দেশের মুক্তি, তখন কোনো নির্যাতন বা মৃত্যুভয়ই বড় হয়ে দাঁড়ায় না। তারা যেন একে অপরের প্রতিচ্ছবি। একজন জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও দেশের মাটিকে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন, অন্যজন জীবনের শুরুতেই সেই মাটির জন্য প্রাণ দিতে দ্বিধা করেনি।
অবশেষে, গত ৩০ ডিসেম্বর বাংলাদেশের স্বাধীন ও গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী, আপসহীনতার প্রতীক বেগম খালেদা জিয়া আমাদের ছেড়ে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন। তার প্রয়াণে আজ সমগ্র বাংলাদেশ শোকস্তব্ধ। তরুণ প্রজন্ম তাদের সবচেয়ে প্রিয় এবং অভিভাবকতুল্য নেত্রীকে হারিয়েছে। কিন্তু মৃত্যু কি আসলেই সব শেষ করে দেয়?
বেগম জিয়ার এই দীর্ঘ সংগ্রাম, আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে তার অনমনীয় অবস্থান এবং গণতন্ত্রের জন্য তার আত্মত্যাগ- সবই এখন জেন-জি প্রজন্মের হাতে আমানত। তার এই আপসহীন মনোভাব তরুণদের হৃদয়ে এক মশাল হয়ে জ্বলবে। বাংলাদেশ যতকাল থাকবে, লাল-সবুজের মানচিত্র যতকাল টিকে থাকবে, বেগম খালেদা জিয়ার নাম ততকাল শ্রদ্ধার সাথে উচ্চারিত হবে।
জেন-জি প্রজন্ম তাদের নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রতিটি ধাপে বেগম জিয়ার এই আপসহীন চেতনাকে ধারণ করবে। আধিপত্যবাদের শৃঙ্খল ভেঙে একটি স্বাধীন, সার্বভৌম ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার যে স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন, সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের দায়িত্ব এখন এই প্রজন্মের কাঁধে। তিনি শারীরিকভাবে নেই; কিন্তু তার আদর্শের মৃত্যু নেই।
আব্দুল কাদের জীবন
শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ