প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ০১ জানুয়ারি, ২০২৬
বাংলাদেশের ভৌগোলিক বৈচিত্র্য, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের অন্যতম অনন্য অঞ্চল হলো পার্বত্য চট্টগ্রাম। খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবান- এই তিন জেলা শুধু পাহাড়, নদী ও বনঘেরা প্রকৃতির জন্যই নয়, বরং সম্ভাবনাময় পর্যটন শিল্প ও স্থানীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নের এক বিশাল ক্ষেত্র হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক পরিকল্পনা, টেকসই নিরাপত্তা এবং সমন্বিত উন্নয়ন উদ্যোগ গ্রহণ করা গেলে পার্বত্য চট্টগ্রাম হতে পারে দেশের অন্যতম প্রধান পর্যটন ও আঞ্চলিক অর্থনৈতিক কেন্দ্র।
পর্যটন শিল্প ও জনপ্রিয় গন্তব্য : গত এক দশকে পার্বত্য চট্টগ্রামে পর্যটনের আগ্রহ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। রাঙামাটির কাপ্তাই লেক, শুভলং ঝর্ণা, ঝুলন্ত সেতু, রাজবন বিহার; বান্দরবানের নীলগিরি, নীলাচল, নাফাখুম জলপ্রপাত, বগালেক, কেওক্রাডং, চিম্বুক পাহাড়; এবং খাগড়াছড়ির আলুটিলা গুহা, রিছাং ঝর্ণা, সাজেক ভ্যালি, দেবতাখুম- এসব গন্তব্য দেশীয় পর্যটকদের পাশাপাশি বিদেশি ভ্রমণকারীদের কাছেও দিন দিন পরিচিত হয়ে উঠছে। বিশেষ করে সাজেক ভ্যালি ও বগালেক বর্তমানে দেশের শীর্ষ পর্যটন গন্তব্যগুলোর মধ্যে স্থান করে নিয়েছে। শীত মৌসুমে প্রতিদিন হাজারো পর্যটকের আগমন স্থানীয় পরিবহন, হোটেল-রিসোর্ট, রেস্তোরাঁ ও ক্ষুদ্র ব্যবসায় সরাসরি অর্থনৈতিক সঞ্চালন তৈরি করছে।
দেশি-বিদেশি পর্যটক ও অর্থনৈতিক প্রভাব : পর্যটন শিল্প পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থানীয় অর্থনীতিতে বহুমাত্রিক প্রভাব ফেলছে। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অনেকেই এখন হোমস্টে, হস্তশিল্প, পরিবহন, গাইড সার্ভিস ও ক্ষুদ্র ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন। নারী উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণও ধীরে ধীরে বাড়ছে, যা সামাজিক ক্ষমতায়নের একটি ইতিবাচক দিক। বিদেশি পর্যটকদের আগমন এখনও কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় না হলেও সম্ভাবনা স্পষ্ট। অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজম, ইকো-ট্যুরিজম ও কালচারাল ট্যুরিজমের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম দক্ষিণ এশিয়ার একটি আকর্ষণীয় গন্তব্য হতে পারে। তবে এর জন্য প্রয়োজন আন্তর্জাতিক মানের অবকাঠামো, নিরাপত্তা নিশ্চয়তা এবং নিরবচ্ছিন্ন প্রশাসনিক সমন্বয়।
বাঁধা ও বাস্তব চ্যালেঞ্জ : সম্ভাবনার পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রামের পর্যটন শিল্পে রয়েছে নানা সীমাবদ্ধতা। যোগাযোগ ব্যবস্থার দুর্বলতা, পরিকল্পনাহীন অবকাঠামো উন্নয়ন, পরিবেশগত ঝুঁকি, মৌসুমি দুর্ঘটনা এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ- নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট উদ্বেগ। কিছু এলাকায় বিচ্ছিন্ন সন্ত্রাসী তৎপরতা, চাঁদাবাজি ও অবৈধ অস্ত্রের উপস্থিতি পর্যটনবান্ধব পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। একই সঙ্গে ভূমি বিরোধ, পাহাড় ধস, বন উজাড় ও অপরিকল্পিত রিসোর্ট নির্মাণ দীর্ঘমেয়াদে পরিবেশ ও পর্যটন- উভয়ের জন্যই হুমকি হয়ে উঠছে। এছাড়া পর্যটন ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় জনগোষ্ঠীর পর্যাপ্ত সম্পৃক্ততা ও দক্ষতা উন্নয়ন না হওয়াও একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
ভবিষ্যৎ পর্যটন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের সম্ভাবনা : সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি ও সমন্বিত উদ্যোগ থাকলে পার্বত্য চট্টগ্রাম হতে পারে বাংলাদেশের টেকসই পর্যটনের রোল মডেল। ইকো-ট্যুরিজম, কমিউনিটি-ভিত্তিক পর্যটন এবং পরিবেশবান্ধব অবকাঠামো উন্নয়ন এই অঞ্চলের জন্য সবচেয়ে উপযোগী পথ। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে আধুনিক রিসোর্ট, প্রশিক্ষিত ট্যুর গাইড, ডিজিটাল বুকিং ব্যবস্থা এবং আন্তর্জাতিক মানের সেবা চালু করা গেলে কর্মসংস্থান বাড়বে, রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পাবে এবং স্থানীয় জীবনমান উন্নত হবে। একই সঙ্গে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন হলে পর্যটনের সুফল আরও বিস্তৃতভাবে সমাজে ছড়িয়ে পড়বে।
নিরাপত্তা বাহিনীর অনিবার্য ভূমিকা : পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থিতিশীলতা ও পর্যটন বিকাশে নিরাপত্তা বাহিনীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দীর্ঘদিন ধরে দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে নিরাপত্তা, যোগাযোগ সহায়তা, মানবিক কার্যক্রম এবং উন্নয়ন সহযোগিতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। পর্যটনবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতি শুধু অপরাধ দমনেই নয়, বরং পর্যটকদের আস্থা ও মানসিক নিরাপত্তা তৈরিতেও কার্যকর। অনেক দুর্গম পর্যটন কেন্দ্রে সড়ক, সেতু, মেডিকেল ক্যাম্প ও উদ্ধার কার্যক্রমে নিরাপত্তা বাহিনীর অবদান স্থানীয় জনগণের জীবনমান উন্নয়নে সহায়ক হয়েছে। তবে দীর্ঘমেয়াদে টেকসই উন্নয়নের জন্য নিরাপত্তা ব্যবস্থার পাশাপাশি রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর আস্থাভিত্তিক অংশগ্রহণ অপরিহার্য।
অপরিহার্য বিষয় হলো, পার্বত্য চট্টগ্রাম শুধু একটি ভূখণ্ড নয়- এটি সম্ভাবনার এক বিশাল ভাণ্ডার। পর্যটন শিল্পকে কেন্দ্র করে স্থানীয় ও জাতীয় অর্থনীতিতে নতুন গতি সঞ্চার করার সুযোগ এখানে সুস্পষ্ট। প্রয়োজন সমন্বিত পরিকল্পনা, পরিবেশ সংরক্ষণ, নিরাপত্তা জোরদার এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে উন্নয়নের মূল অংশীদার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা। সুদৃষ্টি ও সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা গেলে পার্বত্য চট্টগ্রাম শুধু পর্যটনের স্বর্গভূমিই নয়, বরং বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়নের এক উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে উঠতে পারে।
এম মহাসিন মিয়া
সাংবাদিক ও লেখক