ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০১ জানুয়ারি ২০২৬, ১৭ পৌষ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

খিরার বাম্পার ফলন ও কৃষি অর্থনীতির নতুন দিগন্ত

খিরার বাম্পার ফলন ও কৃষি অর্থনীতির নতুন দিগন্ত

উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার সিরাজগঞ্জ মূলত ধান ও পাটের জন্য পরিচিত হলেও, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জেলাটি সবজি চাষে বিপ্লব ঘটিয়ে চলেছে। বিশেষ করে চলতি মৌসুমে সিরাজগঞ্জে খিরার যে অভাবনীয় বা ‘বাম্পার’ ফলন হয়েছে, তা শুধু স্থানীয় কৃষকদের ভাগ্যবদল করেনি, বরং দেশের কৃষি অর্থনীতিতে এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে। যমুনার পলিবিধৌত উর্বর মাটি আর কৃষকদের নিরলস পরিশ্রমের ফসল হিসেবে মাঠের পর মাঠ এখন সবুজে ঘেরা খিরার সমারোহে ভরে উঠেছে।

অর্থনীতির নতুন চালিকাশক্তি : সিরাজগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এবার জেলায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি জমিতে খিরার আবাদ হয়েছে। বিশেষ করে শাহজাদপুর, উল্লাপাড়া ও তাড়াশ উপজেলায় খিরার চাষ এখন প্রধান অর্থকরী ফসলে পরিণত হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকা এবং পোকাণ্ডমাকড়ের উপদ্রব কম হওয়ায় ফলন হয়েছে আশাতীত। বর্তমানে প্রতিদিন শত শত মণ খিরা স্থানীয় বাজার ছাড়িয়ে রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে যাচ্ছে। এতে একদিকে যেমন কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন, অন্যদিকে স্থানীয় পর্যায়ে প্রচুর কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে।

কেন এই সাফল্য? খিরা চাষে এই সাফল্যের পেছনে বেশ কিছু কার্যকর কারণ রয়েছে।

স্বল্প সময় ও কম খরচ: খিরা একটি স্বল্পমেয়াদি ফসল। বীজ বপনের ৪৫ থেকে ৫০ দিনের মধ্যেই ফলন পাওয়া শুরু হয়। ধান বা অন্যান্য ফসলের তুলনায় এতে খরচ কম কিন্তু মুনাফা অনেক বেশি।

পলি মাটির গুণাগুণ : যমুনা নদীর অববাহিকায় পলিযুক্ত মাটি খিরা চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। এই মাটিতে সারের ব্যবহার কম লাগলেও ফলন হয় প্রচুর।

কৃষি বিভাগের সহায়তা : স্থানীয় কৃষি অফিসের মাঠ পর্যায়ের পরামর্শ, উন্নত মানের বীজের সরবরাহ এবং রোগবালাই দমনে সঠিক দিকনির্দেশনা কৃষকদের উৎসাহিত করেছে।

বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলো : বাম্পার ফলন কৃষকদের মুখে হাসি ফোটালেও কিছু মৌলিক সমস্যা এখনও রয়ে গেছে। প্রতি বছর ভরা মৌসুমে যখন সরবরাহ অনেক বেড়ে যায়, তখন অনেক সময় কৃষকরা ন্যায্য মূল্য পান না। পাইকারি বাজারের সিন্ডিকেট এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যে প্রান্তিক চাষিরা অনেক সময় বঞ্চিত হন। এছাড়া খিরা একটি পচনশীল পণ্য হওয়ার কারণে এটি সংরক্ষণের জন্য বিশেষায়িত হিমাগার বা আধুনিক বাজারজাতকরণ ব্যবস্থার অভাব প্রকটভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে।

আমাদের করণীয় : সিরাজগঞ্জের এই খিরা বিপ্লবকে টেকসই করতে হলে সরকারকে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। হিমাগার স্থাপন: পচনশীল সবজি সংরক্ষণের জন্য সিরাজগঞ্জের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে হিমাগার স্থাপন জরুরি। সরাসরি বাজারজাতকরণ: কৃষকরা যাতে সরাসরি বড় বড় কোম্পানির কাছে বা শহরের আড়তে পণ্য পাঠাতে পারেন, সেজন্য যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও মধ্যস্বত্বভোগীদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। রপ্তানি সম্ভাবনা: বিদেশের বাজারে বাংলাদেশের খিরার চাহিদা তৈরির জন্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প গড়ে তোলা যেতে পারে। খিরা থেকে আচার বা সালাদ তৈরির উপকরণ তৈরির কারখানা স্থাপন করলে তা অর্থনীতির মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। সিরাজগঞ্জের খিরা চাষ এখন আর শুধু পারিবারিক পুষ্টির চাহিদা মেটানোর বিষয় নয়, এটি এখন একটি বাণিজ্যিক ব্র্যান্ড। কৃষকদের এই পরিশ্রম আর সাফল্যের ধারা অব্যাহত রাখতে প্রয়োজন সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা। আমরা আশা করি, সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এই সম্ভাবনাময় খাতটিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখবেন, যাতে সিরাজগঞ্জের খিরা জাতীয় অর্থনীতিতে আরও বড় অবদান রাখতে পারে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত