ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ সংগঠন হামাসের আকস্মিক সিদ্ধান্তের ইতিবাচক ফল দেখেছেন গাজাবাসী। সংগঠনটি জানিয়েছিল, যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন চলতে থাকলে শনিবার নির্ধারিত তিন ইসরায়েলির মুক্তি স্থগিত রাখবেন তারা। ফিলিস্তিনি সংবাদমাধ্যমগুলো জানাচ্ছে, হামাসের এই সিদ্ধান্তের পর ইসরায়েলি সেনারা গাজাবাসীদের ওপর হামলা বন্ধ রেখেছেন, তাদের চলাচলে বাধা তৈরি থেকে বিরত থেকেছেন এবং ত্রাণ সরবরাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেননি। এরপর নির্ধারিত বন্দিবিনিময়ে আবার সম্মত হয় হামাস। যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপের ষষ্ঠ পর্বে গতকার শনিবার এই তিন ইসরায়েলি মুক্তি পান। তারা হলেন- আলেক্সান্ডার ট্রুফানোভ, সাগুই ডেকেল-চেন এবং ইয়াইর হর্ন। দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসে বিধ্বস্ত ভবনগুলোর পাশে স্থাপিত একটি মঞ্চে তাদের রেডক্রসের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এসময় হামাসের আল-কাসসাম ব্রিগেডস এবং ইসলামিক জিহাদের আল-কুদস ব্রিগেডসের অস্ত্রসজ্জিত বিপুল যোদ্ধা উপস্থিত ছিলেন। বিনিময়ে ইসরায়েলি কারাগার থেকে ৩৬৯ ফিলিস্তিনি মুক্তি পেয়েছেন। হামাসের বন্দিবিষয়ক মিডিয়া অফিস জানিয়েছে, এসব ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ৩৬ জন যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত। বাকি ৩৩৩ জন মূলত ৭ অক্টোবরের হামলার পর গাজা থেকে আটক হয়েছিলেন। আলজাজিরা বলেছে, ৩৬৯ জনের মধ্যে ২৯ জন অধিকৃত পশ্চিমতীরের, ৭ জন অধিকৃত পূর্ব জেরুজালেমের। মুক্তির পর ২৪ জনকে মিসরে পাঠানো হবে; ৩৩৩ জন ফিরবেন গাজা উপত্যকায়। গত মাসে কার্যকর হওয়া যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপের শর্ত অনুযায়ী আরো ১৭ জন ইসরায়েলি বন্দিকে মুক্তি দেয়ার কথা, যাদের মধ্যে ৯ জন জীবিত বলে ধারণা করা হচ্ছে। শর্ত অনুযায়ী, ইসরায়েল আরো প্রায় দুই হাজার ফিলিস্তিনিকে মুক্তি দেবে, যাদের মধ্যে বহু হামাস যোদ্ধা রয়েছেন, যারা বিভিন্ন সময় ইসরায়েলে হামলার জন্য যাবজ্জীবন বা দীর্ঘ কারাদণ্ড ভোগ করছেন। এদিকে, যুদ্ধবিরতি চুক্তির পরবর্তী ধাপ নিয়ে অনিশ্চয়তা এখনো কাটেনি; এ-নিয়ে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হয়নি। তবে হামাস জানিয়েছে, দ্বিতীয় ধাপ নিয়ে ইসরায়েলের সঙ্গে পরোক্ষ আলোচনা আগামী সপ্তাহে শুরু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
গাজা উপত্যকায় যখন যুদ্ধবিরতির আওতায় বন্দিবিনিময় চলছে, তখন পশ্চিমতীরে ইসরায়েলি সেনাদের সঙ্গে তীব্র লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা। জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা সমন্বয় বিষয়ক কার্যালয় বলেছে, জেনিন গভর্নরেটে কয়েক সপ্তাহ ধরে যে তীব্র হামলা চলছে, এ-ধরনের হামলা কয়েক দশকের মধ্যে পশ্চিমতীরে আর দেখা যায়নি। আলজাজিরা অ্যারাবিক জানিয়েছে, বিভিন্ন ফ্রন্টে ইসরায়েলি সেনাদের বিরুদ্ধে লড়ছেন ফিলিস্তিনিরা। সংবাদমাধ্যমটি বলেছে, শুক্রবার সিলাত আল-হারিথিয়া শহরে বেশ কয়েকটি ইসরায়েলি সামরিকযানে এক্সপ্লোসিভ ডিভাইসের বিস্ফোরণ ঘটায় আল-কুদস ব্রিগেডসের জেনিন ব্যাটালিয়ন। এতে হতাহতের সঠিক সংখ্যা জানাতে পারেনি আলজাজিরা। ফিলিস্তিনি তথ্যকেন্দ্র জানিয়েছে, গত শুক্রবার জেনিনের পশ্চিমে ইয়াম্মুন শহরেও হানা দেয় ইসরায়েলি বাহিনী। তবে, সব ফ্রন্টে ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের তীব্র প্রতিরোধের মুখে পড়তে হচ্ছে ইসরায়েলি সেনাদের।
ইসরায়েলি সম্প্রচারমাধ্যম কান প্রকাশিত এক জরিপে দেখা গেছে, গাজায় হামাসের সঙ্গে আবার যুদ্ধ শুরু করার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন ৬১ শতাংশ ইসরায়েলি। দেশটির বেশিরভাগ নাগরিক বন্দিদের মুক্ত করতে চলমান বন্দিবিনিময় চুক্তির দ্বিতীয় ধাপ এগিয়ে নেয়ার পক্ষে। জরিপে দেখা গেছে, ৬১ শতাংশ ইসরায়েলি মনে করেন, হামাসের হাতে থাকা বাকি বন্দিদের মুক্ত করতে চুক্তির দ্বিতীয় ধাপ অব্যাহত রাখা উচিত। জরিপে ৬০০ অংশগ্রহণকারীকে প্রশ্ন করা হয়, ‘আমরা কি চুক্তির দ্বিতীয় ধাপে গিয়ে যুদ্ধ বন্ধ করব, নাকি সব বন্দিকে মুক্ত না করে আবার হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করব? জবাবে ৬১ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, ইসরায়েলকে বন্দিবিনিময়ের দ্বিতীয় ধাপ চালিয়ে যেতে হবে। ১৮ শতাংশ বলেছেন, যুদ্ধ এখনই আবার শুরু করা উচিত। আর ২১ শতাংশ এই বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত দেননি। জরিপের এই ফলাফল যুদ্ধের ভবিষ্যৎ নিয়ে ইসরায়েলি জনগণের বিভক্ত মতামতের প্রতিফলন ঘটাচ্ছে, যেখানে বন্দিদের মুক্তি এবং যুদ্ধবিরতি নিয়ে একটি কঠিন সিদ্ধান্তের সামনে রয়েছে সরকার।
সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গাজা দখল এবং ফিলিস্তিনিদের গাজা থেকে উচ্ছেদ করার পরিকল্পনা ঘোষণার পর আরব ও মুসলিম বিশ্বজুড়ে প্রতিবাদ ও নিন্দার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। ট্রাম্পের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে আরব সম্মেলন আয়োজনের ঘোষণা দেয় মিসর। পাশাপাশি, গাজা সংকট নিয়ে ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থা বা ওআইসির পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের জরুরি বৈঠক ডাকার সিদ্ধান্ত নেয় পাকিস্তান ও সৌদি আরব। এরই ধারাবাহিকতায় ২০ ফেব্রুয়ারি চারটি আরব দেশের নেতাদের নিয়ে একটি জরুরি সম্মেলনের আয়োজন করছে সৌদি আরব, যেখানে ট্রাম্পের গাজা দখলের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করা হবে। এই সম্মেলনের প্রস্তুতির বিষয়ে অবগত একটি সূত্র শুক্রবার এএফপিকে জানিয়েছে, সম্মেলনে মিসর, জর্ডান, কাতার এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের নেতারা উপস্থিত থাকবেন। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসও এতে অংশ নেবেন বলে নিশ্চিত করেছে সূত্রটি। খবরে বলা হয়, সাধারণত বিভিন্ন ইস্যুতে বিভক্ত আরব দেশগুলো ট্রাম্পের এই পরিকল্পনার বিরুদ্ধে এক ও অভিন্ন অবস্থান গ্রহণ করেছে। তারা মনে করছেন, ফিলিস্তিনিদের গণহারে বাস্তুচ্যুত করা হবে আত্মঘাতী, এটা মেনে নেয়া যায় না। এমন পরিস্থিতিতে সৌদি আরবসহ বেশ কয়েকটি দেশ বারবার দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের কথা বলছে, যেখানে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র ইসরায়েলের পাশাপাশি শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান করবে।
রয়টার্স জানিয়েছে, চার আরব দেশের বৈঠকে নানা খসড়া প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হবে। এ-সব প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে উপসাগরীয় দেশগুলোর নেতৃত্বে ফিলিস্তিন পুনর্গঠন তহবিল গঠন। পাঁচটি সূত্র সংবাদমাধ্যমটিকে বলেছে, হামাসকে পাশ কাটিয়ে একটি চুক্তি সম্পাদন করার কথা ভাবছেন তারা। সূত্র জানায়, ট্রাম্পের পরিকল্পনায় সৌদি আরব বেশি হতাশ। কারণ, ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য রিয়াদ ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের শর্ত আরোপ করে রেখেছে। রয়টার্স সৌদি আরব, মিসর, জর্ডানসহ আরব বিশ্বের ১৫টি সূত্রের সঙ্গে কথা বলেছে। তারা ট্রাম্পের পরিকল্পনার বিপরীতে একটি সমন্বিত প্রস্তাব আনার জন্য দ্রুত কাজ করার কথা বলেছেন। এর মধ্যে সৌদি আরব সরকারের সূত্র বলেছে, গাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে এরইমধ্যে কমপক্ষে চারটি খসড়া প্রস্তাব তৈরি হয়েছে। তবে এই মুহূর্তে মিসরের একটি খসড়া প্রস্তাব আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে। মিসরের প্রস্তাবে বলা হয়, একটি জাতীয় ফিলিস্তিনি কমিটি গঠন করে গাজার শাসন করা হবে, যাতে হামাসের কোনো সংশ্লিষ্টতা থাকবে না। ফিলিস্তিনিদের বিদেশে পুনর্বাসন না করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণে গাজা পুনর্গঠনের কাজ চালানো হবে। এর মধ্য দিয়ে দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের দিকে এগোতে হবে। সৌদি আরব, মিসর, জর্ডান, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ফিলিস্তিনের প্রতিনিধিরা এই প্রস্তাব পর্যালোচনা করতে রিয়াদে বসবেন। এরপর ২৭ ফেব্রুয়ারি পরিকল্পনাটি আরব সম্মেলনে উপস্থাপন করা হবে।