
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, গত ১৫ বছরে তিস্তার একফোঁটা পানি আনতে পারেনি আওয়ামী লীগ সরকার। শুধু তিস্তা না যে কয়টা নদী আছে সেখান থেকেও পানি আনতে পারেনি। আমরা গত ১৫ বছর লড়াই করছি ফ্যাসিবাদী হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে। আমাদের ছেলেরা লড়াই করছে। ভারত পানি দেয় না আর আমাদের দেশের শত্রু শেখ হাসিনা দিল্লিতে রাজার হালে বসায় রাখছে ভারত। সেখান থেকে বিভিন্ন ধরনের হুকুমদারি করছে।
তিনি আরো বলেন- পানির যখন প্রয়োজন নেই, ভারত তখন পানি ছেড়ে দেয়, তখন নদী পারের মানুষের কষ্ট বেড়ে যায়। আর যখন খরা মৌসুম তখন আর পানি দেয় না ভারত। তিস্তা পারের মানুষের দুঃখ কখনো শেষ হয় না। এই সরকারে পরিষ্কার করে বলতে চাই, অন্তর্বর্তী সরকার কথায় তো বলেন, আপনারা নিরপেক্ষ, নিরপেক্ষ কিন্তু এই জায়গায় থাকলে চলবে না।গতকাল সোমবার দুপুরে তিস্তা পানি ন্যায্য হিস্যা আদায় ও তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবিতে রংপুরের গঙ্গাচড়া সড়ক সেতুর পয়েন্টে জনতার সমাবেশে এসব কথা বলেন তিনি। তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক ও বিএনপির রংপুর বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক, সাবেক মন্ত্রী আসাদুল হাবিব দুলুর সভাপতিত্বে বক্তব্য দেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক (রংপুর বিভাগ) আব্দুল খালেক, বেবি নাজনিন, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পাটির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (জাফর) সভাপতি মোস্তফা জামাল হায়দার, জেলা বিএনপির আহ্বায়ক সামসুজ্জামান সামু, কাউনিয়া বিএনপির সভাপতি এমদাদুল হক ভরসা প্রমুখ । তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক আসাদুল হাবিব দুলু বলেন, তিস্তার দুই তীরে ২৪২ কিলোমিটার ও ৩৬০ কিলোমিটার অববাহিকায় এখন হাহাকার অবস্থা প্রতিবছর তিস্তা অববাহিকার দুই পাড়ে বিশ হাজার মানুষ উদ্বাস্ত হয়। প্রতিবছর ক্ষতি হয় ১ লাখ কোটি টাকারও বেশি। এ কারণে উত্তরের অর্থনীতি পঙ্গু। তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়নের পাশাপাশি মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে তিস্তানদীকে ঘিরে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ফিরে আসবে এই অঞ্চলে। পাশাপাশি এই অঞ্চলের দুই কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা জীববৈচিত্র্য এবং পরিবেশ রক্ষা হবে। ‘জাগো বাহে-তিস্তা বাঁচাই’ স্লোগান নিয়ে তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলনের ব্যানারে এই কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছে বিএনপি ও তার মিত্ররা। আন্দোলন কর্মসূচির অংশ হিসেবে তিস্তা নদীবেষ্টিত লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, রংপুর ও গাইবান্ধা জেলার ১১টি পয়েন্টে সমাবেশ, পদযাত্রা, সাংস্কৃতিক পরিবেশনা করবে তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলন কমিটি। এর মধ্যে রংপুরের কাউনিয়া রেলসেতু ও গঙ্গাচড়া মহিপুর বাজার সংলগ্ন তিস্তা নদীর বুকে রংপুরের কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। জানা যায়, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান আজ মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ৫ জেলার ১১টি পয়েন্টে ভার্চুয়ালি যুক্ত হবেন। সমাবেশের বিভিন্ন স্পটগুলোতে পৃথক পৃথকভাবে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন- বিএনপি স্থায়ী কমিটি সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বীর বিক্রম, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু, শামসুজ্জামান দুদু, জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক এবং গণসংহতি আন্দোলন প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি। সরেজমিনে দেখা যায়, তিস্তা নদীর চরাঞ্চলে ৪৮ ঘণ্টার অবস্থান কর্মসূচির জন্য ১১ পয়েন্টের নদীর দুই পারে বাঁশের খুঁটিতে সামিয়ানা টানিয়ে বানানো হয়েছে তাঁবু। যেখানে রাত যাপন করবে আন্দোলনে যোগ দেয়া মানুষরা। তার পাশেই তৈরি করা হয়েছে মঞ্চ। সকাল থেকেই বিভিন্ন এলাকা থেকে এই কর্মসূচিতে যোগ দেয়ার জন্য দলে দলে আসছে মানুষজন। এরই মধ্যে প্রতিটি পয়েন্টে পৌঁছে গেছে সাংস্কৃতিক কর্মীরা। তারা প্রস্তুত এই দুইদিনের আয়োজনকে নাচ গান আর নাটিকার মাধ্যমে জমিয়ে তুলতে। গতকাল সোমবার সকাল থেকে রংপুরের কাউনিয়া রেলসেতু ও গঙ্গাচড়া মহিপুর সেতু পয়েন্টে ‘জাগো বাহে, তিস্তা বাঁচাই’ কর্মসূচিতে যোগ দিতে খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে আসতে দেখা যায় নদীপাড়ের হাজারো মানুষকে। এ কর্মসূচিতে যোগ দিতে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কৃষক, কৃষানি, জেলে-তাঁতী, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি দলমত নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষের ঢল নামে।
তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা ও মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবিতে উত্তরের ১১টি স্থানে অভিনব প্রতিবাদ শুরু হয়েছে। ‘জাগো বাহে তিস্তা বাঁচাই’ স্লোগানে মুখর তিস্তা নদীর পাড়, যেখানে হাজার হাজার মানুষ অংশ নিয়েছেন এই ব্যতিক্রমী কর্মসূচিতে। আন্দোলনে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাসহ বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের কর্মীরাও যুক্ত হয়েছেন। গতকাল সোমবার সকাল থেকেই ‘জাগো বাহে তিস্তা বাঁচাই স্লোগানে প্রকম্পিত তিস্তার দুই তীর। শুকিয়ে যাওয়া তিস্তায় জেগে ওঠা চরে জড়ো হয়েছেন উত্তরবঙ্গের হাজারো মানুষ। কেউ হেঁটে, কেউবা নৌপথে এসে মিছিলে যোগ দিচ্ছেন। তিস্তা ব্রিজের নিচে ‘তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলন’ ব্যানারে অনুষ্ঠিত হয়েছে প্রতিবাদ সমাবেশ।
আন্দোলনকারীরা বলছেন, আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে ভারত উজানে বাঁধ নির্মাণ করায় তিস্তার পানির প্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে, আর এর ফলে বাংলাদেশের কৃষি ও পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। তারা দাবি করছেন, তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা না পেয়ে হাজার হাজার কৃষক ও সাধারণ মানুষ ক্ষতির মুখে পড়ছেন।
১১ জেলায় একযোগে প্রতিবাদ : লালমনিরহাট, রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম ও নীলফামারীসহ উত্তরাঞ্চলের ১১টি স্থানে একযোগে এই দুদিনব্যাপী প্রতিবাদ কর্মসূচি চলছে। তিস্তার ২৪২ কিলোমিটার বিস্তীর্ণ অববাহিকাজুড়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে পদযাত্রা। এই প্রতিবাদে সম্পৃক্ত মানুষের অভিযোগ, ভারত একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে লাখ লাখ মানুষকে দুর্দশার মুখে ঠেলে দিচ্ছে। তারা বলছেন, ভারতের আগ্রাসন রুখতে এখনই আমাদের সোচ্চার হতে হবে, নইলে ভবিষ্যৎ আরো অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।
আন্দোলনে আসা একজন বলেন, শুকনা মৌসুমে আমরা ন্যায্য পানি পাচ্ছি না। আরেকজন বলেন, যখন আমাদের পানি প্রয়োজন হয় না তখন ইন্ডিয়া আমাদের পানি দিয়ে প্লাবিত করে দেয়। আন্দোলনে আসার কারণ জানিয়ে একজন বলেন, আন্দোলন করার একটাই উদ্দেশ্য হলো, আমাদের পানির দরকার।
বিএনপি নেতাদের সংহতি : সোমবার দুপুর ২টায় তিস্তা পাড়ের প্রধান সমাবেশে উপস্থিত হন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এছাড়া, আন্দোলনের অন্যান্য স্থানে বিএনপির নেতারাসহ একদফা আন্দোলনের শরিক রাজনৈতিক নেতারাও সংহতি প্রকাশ করেন।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ : এই আন্দোলনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মহলে তিস্তা নদীর সংকট তুলে ধরা এবং বিশ্ব সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করাই আয়োজকদের অন্যতম লক্ষ্য। আয়োজকরা মনে করছেন, আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করা গেলে ভারত ন্যায্য হিস্যা দিতে বাধ্য হবে এবং তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথ সুগম হবে। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত এই আন্দোলন অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছেন আন্দোলনকারীরা।