ঢাকা শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

থমথমে পরিবেশে হল ছাড়ছেন শিক্ষার্থীরা

থমথমে পরিবেশে হল ছাড়ছেন শিক্ষার্থীরা

খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবিতে সাধারণ শিক্ষার্থী ও ছাত্রদলের মধ্যে দ্বন্দ্ব, সংঘর্ষ ও উত্তেজনার পারদ বেড়েই চলেছে। গত দুই দিন ধরে ক্যাম্পাসে দফায় দফায় ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। যা কুয়েটের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে। এতে কমপক্ষে শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন।

জানা গেছে, সাধারণ শিক্ষার্থী ও ছাত্রদলের সংঘর্ষে ক্যাম্পাসে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। বাধ্য হয়ে, কুয়েট কর্তৃপক্ষ ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ক্যাম্পাস বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে। এতে কিছু শিক্ষার্থী ক্যাম্পাস ছেড়েছেন। গতকাল বুধবার ক্যাম্পাস বন্ধের তথ্য নিশ্চিত করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা বিভাগের কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) শাহাদুজ্জামান শেখ।

গতকাল বুধবার দুপুরের মধ্যে কুয়েট উপাচার্যের পদত্যাগসহ পাঁচ দফা দাবি জানানো হলেও, তা বাস্তবায়ন না হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবনগুলোয় তালা ঝুঁলিয়ে দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে শিক্ষার্থীরা বলেন, উপাচার্যের পদত্যাগসহ পাঁচ দাবি বাস্তবায়নে আমরা আল্টিমেটাম দিয়েছিলাম। সে ব্যাপারে প্রশাসন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। তাই সাধারণ শিক্ষার্থীরা অনির্দিষ্টকালের জন্য প্রশাসনিক ভবন, একাডেমিক ভবন ও বিভাগে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে।

এদিকে গত মঙ্গলবার রাতে কুয়েট উপাচার্য মুহাম্মদ মাছুদ অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাকেন্দ্রের দোতলায় ভর্তি করানো হয়। তিনি সেখানে চিকিৎসাধীন আছেন। কুয়েটের পরিবেশ কিছুটা থমথমে বিরাজ করলেও কুয়েটের বাইরের দোকানপাট গতকাল খুলেছে। আর প্রধান ফটকের সামনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অবস্থান নিয়েছেন। সেনাবাহিনীর সদসদের টহল দিতে দেখা গেছে। ক্যাম্পাসের বাইরে বিভিন্ন বাসাবাড়িতে যারা ভাড়া রয়েছেন তাদের ভেতর আতঙ্ক বিরাজ করছে এবং শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা উদ্বিগ্ন রয়েছেন। গত মঙ্গলবার দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্ত থেমে থেমে সংঘর্ষ চলে। ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবিকে কেন্দ্র করে ছাত্রদল ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনায় শতাধিক আহত হন। গতকাল রাতে ক্যাম্পাসের মেডিকেল সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন শিক্ষার্থীরা। সেখানে পাঁচ দফা দাবি জানানো হয়। দাবিগুলো হচ্ছে- বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারবেন না এবং থাকলে আজীবন বহিষ্কারের বিধান রেখে অধ্যাদেশ জারি, ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা, বহিষ্কারসহ ব্যবস্থা নেয়া, ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ক্যাম্পাসের বাইরে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের রাখা, আহত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসার ব্যয় প্রশাসন থেকে বহন করা এবং ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে ক্ষমা চেয়ে উপাচার্য, সহ-উপাচার্য ও ছাত্রকল্যাণ পরিচালকের পদত্যাগ।

কুয়েটের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ছাত্ররাজনীতি নিয়ে ক্যাম্পাসে লিফলেট বিতরণ করেন ছাত্রদলের কিছু নেতাকর্মী। এর পরিপ্রেক্ষিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ‘ছাত্ররাজনীতির ঠিকানা, এই কুয়েটে হবে না’, ‘দাবি মোদের একটাই, রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাস চাই’, ‘এই ক্যাম্পাসে হবে না, ছাত্ররাজনীতির ঠিকানা’সহ বিভিন্ন স্লোগান দিতে দিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো প্রদক্ষিণ করেন। এ সময়ে কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের সামনে দুপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ লাগে।

কুয়েট ক্যাম্পাসের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কাজ করছেন। এ ব্যাপারে বিজিবির খুলনার সেক্টর কমান্ডার লে. কর্নেল খুরশিদ আনওয়ার বলেন, কুয়েটের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিজিবি, পুলিশসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী সেখানে অবস্থান করছে। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ক্যাম্পাসের বাইরে অবস্থান করায় ভেতরের পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে কুয়েট প্রশাসনকে। এ ব্যাপারে কুয়েটের উপাচার্য মোহাম্মদ মাছুদের মোবাইল ফোনে একাধিকবার ফোন করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ থাকবে। রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকার সম্পৃক্ততা পেলে শিক্ষার্থীদের আজীবন বহিষ্কার ও ছাত্রত্ব বাতিল করা হবে। শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরাও কোনো ধরনের রাজনৈতিক সংগঠনের কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারবেন না। গতকাল বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের ৯৩তম সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়েছে। এছাড়াও সংঘর্ষের ঘটনা তদন্ত করতে কুয়েটের সিন্ডিকেটের সভায় কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক এমএমএ হাসেমকে প্রধান করে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তিন কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেবে তদন্ত কমিটি। সভায় সিদ্ধান্ত হয়, গতকালের ঘটনায় জড়িত বহিরাগতদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন মামলাসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। আর জড়িত শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িক বহিষ্কার করবে। আহত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা ব্যয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বহন করবে। ক্যাম্পাস এলাকায় নিরাপত্তা নিশ্চিতে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

অবস্থানরত শিক্ষার্থীদের একজন ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সিয়াম বলেন, আমাদের দাবি হচ্ছে, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা, উপাচার্যের পদত্যাগসহ পাঁচ দফা। আমাদের মূল দাবি, এখন যারা ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি ফিরিয়ে আনার জন্য কাজ করছিলেন, তাদের বহিষ্কার করতে হবে। ভিসি স্যারকে পদত্যাগ করতে হবে। উনি আমাদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। ঘটনা ঘটার কিছুক্ষণ আগে উনি আমাদের নিরাপত্তা দেয়ার কথা বলেছেন, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছেন। বহিরাগত ব্যক্তিরা ক্যাম্পাসে ঢুকে দা-ছুরি নিয়ে আক্রমণ করেছেন আমাদের ব্যাচমেট, জুনিয়র ও সিনিয়রদের ওপর। অনেকে আহত হয়েছেন। অথচ ভিসি স্যার বলছেন, তিনি ব্যর্থ নন। তিনি জাস্ট দুই ঘণ্টা লেট করেছিলেন। উনি যদি ক্যাম্পাসে ছাত্রদের নিরাপত্তা দিতে না পারেন, তাহলে এমন কোনো ভিসি কুয়েট ক্যাম্পাসে দরকার নেই। এরকম ভিসির আন্ডারে আমরা কুয়েটকে দেখতে চাই না।

গতকাল খুলনা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য দিয়েছেন ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি আবু আফসান মো. ইয়াহিয়া। তিনি বলেন, কুয়েট শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনার সঙ্গে ছাত্রদল জড়িত নয়। এরইমধ্যে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীদের বয়ান, সংবাদমাধ্যমে আসা প্রতিবেদন এবং ছবি, ভিডিও ফুটেজ পাওয়া প্রমাণের ভিত্তিতে আমরা যতটুকু জানতে পেরেছি, সে অনুযায়ী মঙ্গলবারের এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সূত্রপাত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে একটি মিছিল থেকে রাহুল জাবেদ, ইফাজ ও ইউসুফ নামের তিনজন ছাত্রদল সমর্থকের ওপর অতর্কিত হামলার মধ্য দিয়ে শুরু। ছাত্রদল শুরু থেকেই ইতিবাচক রাজনীতি করে আসছে। সংকটটা তখনই প্রকট হবে যদি আপনি জুলাই-আগস্টের স্প্রিটের সঙ্গে না যান। ছাত্রদল সবসময় জুলাই-আগস্টের স্প্রিটকে ধারণ করে প্রতিটি ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি করতে চায়। আমরা একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ চাই। যেখানে সব দলের মতামতের প্রতিফলন ঘটবে। ছাত্রলীগের মতো একটি দলই রাজনীতি করবে বাকিদের যদি রাজনীতি করতে না দেন তাহলে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে যারা শহীদ হয়েছেন, সেই শহীদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করা হবে। সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রদলের সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শ্যামল মালুম বলেন, কুয়েটে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কমিটি রয়েছে। এটি সম্পূর্ণ একটি রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন। তারা রাজনৈতিক দল গঠন করে আগামীতে নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তারা কুয়েটে নিজেদের কার্যক্রম চালু রেখে কোন মুখে দাবি করে তারা এখানে ছাত্র রাজনীতি চালু করতে দেবে না। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্যাডে হাসনাত আব্দুল্লাহ এবং আরিফ সোহেল স্বাক্ষরিত ৭৪ সদস্যবিশিষ্ট কুয়েটের একটি কমিটি প্রকাশিত হয়েছে। সেই কমিটির মাধ্যমে স্পষ্ট প্রকাশ পায় যে, সেখানে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালু আছে। কুয়েট শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রদল নেতাকর্মীদের সংঘর্ষের সময় ধারালো অস্ত্র হাতে অবস্থান নেয়া খুলনার দৌলতপুর থানা যুবদলের সহ-সভাপতি মাহবুবুর রহমানকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। দলীয় শৃঙ্খলা পরিপন্থি কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে গত মঙ্গলবার রাতে কেন্দ্রীয় যুবদলের দপ্তর সম্পাদক নুরুল ইসলাম সোহেল স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে মাহবুবকে যুবদল থেকে বহিষ্কার করা হয়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত