ঢাকা শুক্রবার, ২০ জুন ২০২৫, ৬ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

এবার বিএনপির দুই টার্গেট

এবার বিএনপির দুই টার্গেট

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত বছরের ৫ আগস্ট স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিএনপি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে দ্রুত ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে কিছুটা সংস্কার কাজসম্পন্ন হবার পর নির্বাচন হবে। এর সঙ্গে জামায়াত ইসলামীসহ বেশ কিছু রাজনৈতিক দলও একমত পোষণ করেছে। এর মধ্যে আলোচনায় এসেছে স্থানীয় সরকার নির্বাচন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একটি অংশসহ বেশ কিছু রাজনৈতিক দল যাচ্ছে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হোক। আবার বিএনপিসহ অনেক রাজনৈতিক দল চাচ্ছে আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে পরে স্থানীয় সরকার নির্বাচন। এরই ধারাবাহিকতায় দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে আসা বিএনপি এবার দুটি টার্গেট নিয়ে সামনের দিকে এগোচ্ছে।

প্রথম টার্গেটটি হচ্ছে দ্রুত সময়ে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আদায় করা এবং দ্বিতীয় টার্গেটটি হচ্ছে দলকে সুসংগঠিত করে নির্বাচনি প্রচার-প্রচারনা চালিয়ে যাওয়া। এ লক্ষে দলটির নেতাকর্মীরা দৌড়ঝাঁপও শুরু করে দিয়েছে। এরই মধ্যে দলটি দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রধান উপদেষ্টা ও নির্বাচন কমিশনের কাছে দাবি জানিয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্য নির্বাচন কমিশনারদের সঙ্গে বৈঠকও করেছে বিএনপি।

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন চলতি বছরের ডিসেম্বরে হতে পারে বলে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। সম্প্রতি রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকও করে বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, প্রধান উপদেষ্টা এবং তার সঙ্গে যারা আছেন তারা আমাদের আশ্বস্ত করেছেন, অতি দ্রুত তারা নির্বাচনের ব্যবস্থা করছেন। তিনি (প্রধান উপদেষ্টা) বলেছেনও ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন ব্যবস্থা করার জন্য কাজ করছেন। মির্জা ফখরুল বলেন, আমরা আশা করব, জনগণের যে প্রত্যাশা আছে, একটা রোডম্যাপ ঘোষণা করবেন তিনি। সেটার মধ্য দিয়ে ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন সম্পন্ন হবে বলে আমরা প্রত্যাশা করছি।

এর আগে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে অনুষ্ঠিত সংলাপে বিএনপি আগামী নির্বাচনের রোডম্যাপ দাবি করলেও জামায়াত গুরুত্ব দিয়েছে সংস্কারে। ওই সময় অনুষ্ঠিত সংলাপে নানা সংস্কার প্রস্তাব তুলে ধরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। ওই সময় সংলাপ শেষে জামায়াতের আমীর ডা. শফিকুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, আমাদের দেওয়া দু’টি রোডম্যাপের মধ্যে একটি হবে সংস্কারের, আরেকটি নির্বাচনের। সংস্কার সফল হলেই নির্বাচন সফল হবে। যদিও বৈষম্যবিরোধী ছাত্রনেতারা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন- আগে সংস্কার ও আওয়ামী লীগের বিচার, তারপর নির্বাচন। এছাড়াও বিএনপি ছাড়া অন্যান্য অনেক রাজনৈতিক দল আগে সংস্কার অথবা আওয়ামী লীগের হত্যা ও দুর্নীতির বিচার চাচ্ছে।

সূত্রমতে, জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে তৃণমূল পর্যায়ের সংগঠনকে ঢেলে সাজাতে কাজ করছে বিএনপি। এই লক্ষ্যে মাঠপর্যায়ে দল পুনর্গঠন ও সংগঠনকে শক্তিশালী করতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন দলটির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন এমনকি ওয়ার্ড পর্যায়ে দেওয়া হচ্ছে নতুন কমিটি। চলতি ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতে একদিনেই ১৩ জেলায় নতুন আহ্বায়ক কমিটি দেওয়া হয়েছে। জেলায় জেলায় চলছে সম্মেলন। বেশ কয়েকটি জেলায় সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটিও করা হয়েছে। এসব কমিটিতে সাবেক ছাত্রদল ও যুবদল নেতাদের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় স্থান দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিগত আন্দোলন সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে তরুণ নেতৃত্ব। স্থবির ও গুটিয়ে যাওয়া বিএনপির আন্দোলন চাঙ্গা হওয়ার পেছনে তরুণ নেতাদের ভূমিকা ছিল অতুলনীয়। মাঠ পর্যায়ের কর্মী-সমর্থকদের সংগঠিত করতেও অগ্রণী অবস্থান তাদের। দলের বিভিন্ন কর্মসূচিকে সফল করতে উদ্যোগী রয়েছেন তরুণ নেতারা। তাই বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের কমিটিতে স্থান পাচ্ছেন বিগত আন্দোলন সংগ্রামে ভূমিকা রাখা ছাত্রদলের সাবেক নেতারা।

এদিকে, দ্রুত নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ও পতিত ফ্যাসিবাদের নানা ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় দেশের ৬৪ জেলায় ৮ দিনের সমাবেশ কর্মসূচি পালন করছে বিএনপি। গত ১২ ফেব্রুয়ারি শুরু হওয়া এ কর্মসূচী শেষ হবে আগামী ২৫ ফেব্রুয়ারি। এ কর্মসূচিতে দলটি একদিকে সরকারকে দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য চাপ দিচ্ছে অপরদিকে দলটির সম্ভাব্য এমপি প্রার্থীরা তাদের প্রচার-প্রচারনা চালাচ্ছেন।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, আজকে পুরো জাতি অস্থিরতার মধ্যে আছে। নির্বাচন দিয়ে অস্থিরতা দূর করুন। আর একটি রাজনৈতিক দলকে বলব এমন কিছু বলবেন না যেন দেশ আবারও অস্থির হয়ে উঠে। সংস্কারের কথা বলে অনেকে নির্বাচন পেছানোর কথা বলছেন। সংস্কার সাধারণ মানুষ কয়জন বুঝে? দুইবেলা ভাত, মাথার গোঁজার ঠাঁই, চিকিৎসা, শিক্ষা এবং শান্তি চায় মানুষ। জনগণের কাছে এই মৌলিক অধিকারগুলোই হচ্ছে সংস্কার। বিএনপির এই শীর্ষনেতা বলেন, ৭১ দেশ স্বাধীন করেছিলাম, পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ ভালো কিছু উপহার দিতে পারে নাই। তারই কন্যা সংসদ, বিচার বিভাগ, নির্বাচনিব্যবস্থা, ভোটাধিকার, অর্থনীতি সব ধ্বংস করে দিয়েছে। এ থেকে দেশকে সুস্থ ধারায় ফিরে আনতে তারেক রহমান স্লোগান দিয়েছেন টেকব্যাক বাংলাদেশ। আরেকটি স্লোগান দিয়েছে ফয়সালা হবে রাজপথে। রাজপথেই ফয়সালা হয়েছে। হাসিনা পালিয়েছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, জনগণের প্রত্যাশা হচ্ছে, সরকার নির্বাচন কেন্দ্রীয় প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষ করে দ্রুততম সময়ে নির্বাচন দেবে। জনগণের রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির একই প্রত্যাশা। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বরেছেন, আমাদের চাওয়ার কিছু নেই। বাংলাদেশের মানুষ ভোট দিতে চায়। তারা ভোট দিয়ে তাদের নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতায় দেখতে চায়, যে সরকার তাদের (জনগণের) কাছে দায়বদ্ধ থাকবে, তাদের কাছে জবাবদিহি করবে। তিনি বলেন, বিএনপির লক্ষ্য হচ্ছে রাষ্ট্রের মালিকানা জনগণের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া। সেটার একমাত্র পথ হচ্ছে নির্বাচন। জনগণ সিদ্ধান্ত নেবে আগামী দিনের বাংলাদেশ কোন পথে যাবে বা কীভাবে চলবে। এটার জন্য মানুষ জীবন দিয়েছে, খুন, গুম হয়েছে। আমীর খসরু আরো বলেন, আমরা শান্তিপূর্ণ পরিবেশে উদার গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে যেতে চাই। অনেক সংঘর্ষ হয়েছে, দেশের মানুষ অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেই সাংঘর্ষিক রাজনীতি বাংলাদেশে আর যেন ফিরে না আসে, সেই চেষ্টা করে যাচ্ছি। সেটা সফল হবে, একমাত্র দ্রুত একটা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলটির আরেক স্থায়ী কমিটির সদস্য বলেন, ?‘২০২৫ সালে মধ্যে যদি সরকার নির্বাচনের তারিখ অর্থাৎ রোডম্যাপ ঘোষণা করে, তাহলে নির্বাচন প্রক্রিয়া যুক্ত হয়ে যাবে বিএনপি। পাশাপাশি সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে যাবে। আর সরকার যদি নির্বাচন বিলম্বিত করতে চায়, সেই ক্ষেত্র আমরা নির্বাচনের জন্য বক্তব্য, বিবৃতি, সারাদেশে সভা-সমাবেশের মাধ্যমে সরকারের ওপর সহনীয় চাপ তৈরি করবো। এছাড়া সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা এবং বৈঠক হলে সেখানে বারবার নির্বাচনের তাগাদা দেওয়া হবে।’ বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন না পরে জাতীয় সংসদ নির্বাচন এই বিতর্কে আমার মনে হয়, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অংশগ্রহণ করা উচিত নয়। বরং এই সরকারকে প্রথমেই জনগণের ক্ষমতা জনগণকে ফিরিয়ে দিতে হবে। জনগণ তাদের নিরপেক্ষ ভোটের মাধ্যমে যে সরকার গঠন করবে তারাই নির্ধারণ করবে যে, স্থানীয় সরকার নির্বাচন বা অন্যান্য নির্বাচন কখন হবে।

বিএনপির আরেকটি সূত্র বলেছে, একটা বিষয় এখন পরিষ্কার নয় যে সরকার আগে জাতীয় নির্বাচন নাকি স্থানীয় সরকার নির্বাচন দেবে। দেশের একটা পক্ষ চাচ্ছে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন। যদিও নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন তাদের ভাবনায় নেই। তাই নির্বাচন কেন্দ্রিক সরকারের নীতির অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে বিএনপিকে। সেটার ওপর নির্ভর কবরে বিএনপির আগামী দিনের পরিকল্পনা কী হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত