হামাসের হাতে আটক আরও ছয় ইসরায়েলি মুক্তি পেয়েছেন। গাজা যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপে সপ্তাম দফার এর বিনিময়ে ইসরায়েলি কারাগারে আটক ৬০২ জন ফিলিস্তিনিকে মুক্তি দেওয়ার কথা। গতকাল শনিবার সকালে দক্ষিণ গাজার রাফা শহর এবং মধ্যগাজার নুসেইরাত শরণার্থী শিবিরে স্থাপিত মঞ্চে রেডক্রস ক্রুদের কাছে বন্দিদের হস্তান্তর করা হয়। এ-সময় মুখোশ এবং মাথায় সবুজ ব্যান্ড পরা ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাদের হাতে ছিল রকেটচালিত গ্রেনেড লঞ্চারসহ ভারী অস্ত্র। দুই মঞ্চে বেশ কয়েকটি ব্যানার টানানো হয়। একটিতে লেখা ছিল- ‘আমরাই তুফান; আমরাই অটুট শক্তি।’ কুদস নেটওয়ার্ক জানিয়েছে, এ-সময় হামাস যোদ্ধারা স্বয়ংক্রিয় ইসরায়েলি অস্ত্রও বহন করছিলেন, যে-সব অস্ত্র তারা ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে অভিযানের সময় জব্দ করেছিলেন। মঞ্চের কিছু দূরে সাধারণ গাজাবাসীদের ভিড় দেখা যায়; সেখানে শিশুরাও ছিল। গত মাসে কার্যকর হওয়া যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপে যে ৩৩ ইসরায়েলি বন্দির মুক্তি পাওয়ার কথা, তাদের মধ্যে শেষ জীবিত ছয়জনকে এ-দিন মুক্তি দেওয়া হয়। মুক্তি পাওয়া ইসরায়েলিরা হলেন- ২৭ বছর বয়সী এলিয়া কোহেন, ৪০ বছর বয়সী তাল শোহাম, ২২ বছর বয়সী ওমর শেম টভ, ২৩ বছর বয়সী ওমর ওয়েনকার্ট, ৩৬ বছর বয়সী হিশাম আল-সায়েদ এবং ৩৯ বছর বয়সী আভেরা মেঙ্গিস্টু। এদের মধ্যে প্রথম চারজনকে ৭ অক্টোবরের আল-আকসা ফ্লাড অভিযানে আটক করা হয়। শেষের দুইজন প্রায় এক দশক আগে গাজায় অনুপ্রবেশের পর থেকে হামাসের হেফাজতে ছিলেন।
এদিকে, শিরি বিবাস নামে এক ইসরায়েলি নারীর লাশ নিয়ে হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে আবার যুদ্ধ বাঁধার শঙ্কা তৈরি হয়েছিল। বৃহস্পতিবার হামাস ও ইসলামিক জিহাদ ইসরায়েলকে চারজনের লাশ ফেরত দেয়। তবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে ইসরায়েল জানায়, চারজনের মধ্যে একজনের লাশ তাদের জিম্মি শিরি বিবাসের নয়। এটি গাজার অজ্ঞাত কোনো এক নারীর লাশ। এই ‘ভুল লাশ’ পাঠানো নিয়ে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয়। শুক্রবার রাতে ইসরায়েলে আরেকটি লাশ পাঠায় হামাস। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানা গেছে, এটি সেই নিহত বন্দি শিরি বিবাসের লাশ। বিবাসের পরিবারও বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। ইনস্টাগ্রামে এক পোস্টে তারা বলেছেন, ফরেনসিক ইনস্টিটিউটের বিশেষজ্ঞরা শিরি বিবাসের লাশ শনাক্ত করেছেন। এরআগে বন্দিবিনিময়ের ধারাবাহিকতায় বৃহস্পতিবার শিরি বিবাস, তার দুই শিশু সন্তান ও এক বৃদ্ধের লাশ ইসরায়েলে পাঠানো হয়। তখনই ঘটে যায় এমন ভুল। শিরি বিবাসের জায়গায় হামাস আরেক নারীর লাশ পাঠিয়ে দেয়। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এ-নিয়ে হুমকি দেওয়ার পর হামাস একটি বিবৃতি দেয়। তারা জানান, ইসরায়েলি বিমান হামলায় শিরি বিবাস ও তার দুই সন্তান নিহত হন। ওই সময় শিরির লাশ ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। এ-কারণে ভুলক্রমে ইসরায়েলের কাছে আরেকটি লাশ পাঠানো হয়েছে। বিবৃতিতে তারা বিষয়টি খুবই গুরুত্বের সঙ্গে দেখার প্রতিশ্রুতি দেন। এরপরই শুক্রবার রাতে গাজার খান ইউনিসে রেডক্রসকে খবর দেয় হামাস। ওই সময় তারা একটি লাশ তাদের হাতে তুলে দিয়ে জানান, এটি শিরি বিবাসের লাশ। পরে ইসরায়েলে নিয়ে পরীক্ষা করে তার পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে।
সৌদি প্রেস এজেন্সি জানিয়েছে, সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান শুক্রবার রিয়াদে উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদ বা জিসিসিভুক্ত দেশের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এতে জর্ডান ও মিসরের শীর্ষ নেতারাও অংশ নেন। তারা এই বৈঠকের নাম দিয়েছেন ‘ভাইদের অনানুষ্ঠানিক সম্মিলন’। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৈঠকে ফিলিস্তিন ইস্যুতে যৌথ প্রচেষ্টা, গাজার সাম্প্রতিক পরিস্থিতি এবং অন্যান্য আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন- সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল-নাহিয়ান, জর্ডানের বাদশাহ আবদুল্লাহ, মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি, কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল-থানি, কুয়েতের আমির শেখ মিশাল আল-আহমদ আল-জাবের আল-সাবাহ, বাহরাইনের ক্রাউন প্রিন্স ও প্রধানমন্ত্রী সালমান বিন হামাদ আল-খলিফা। বৈঠকে অংশ নেওয়া নেতারা আগামী ৪ মার্চ কায়রোতে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া জরুরি আরব সম্মেলনকে স্বাগত জানান। বৈঠকে গাজায় সংঘাত বন্ধে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়। নেতারা চলমান যুদ্ধবিরতির প্রয়োজনীয়তা ও ফিলিস্তিনিদের জন্য মানবিক সহায়তা জোরদারের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তারা ইসরায়েলের অব্যাহত হামলার নিন্দা জানান এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের আহ্বান জানান। নেতারা ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানে দ্বি-রাষ্ট্র নীতির প্রতি তাদের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন এবং জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের আহ্বান জানান। ইউরোপীয় ইউনিয়নে মিসরের সাবেক দূত গামাল বায়ুমি আলজাজিরাকে বলেন, বৈঠক থেকে গাজাবাসীদের উচ্ছেদ পরিকল্পনার বিরুদ্ধে শক্তিশালী একটি বার্তা এসেছে। বড় ধরনের একটি ‘না’ শুনতে পেয়েছেন ট্রাম্প। কায়রোতে আরব নেতাদের যে বৈঠক হবে, তাতে ট্রাম্পের পরিকল্পনার বিরুদ্ধে আরও জোরালো ও কার্যকর পদক্ষেপ আসবে বলে মনে করেন তিনি।
ফক্স নিউজের খবরে বলা হয়, গাজা দখল করে উপত্যকার প্রায় ২০ লাখ অধিবাসীকে স্থায়ীভাবে অন্য দেশগুলোতে স্থানান্তর করার পরিকল্পনা থেকে স্পষ্টত সরে এসেছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। শুক্রবার তিনি বলেছেন, গাজা উপত্যকা নিয়ে তার পরিকল্পনা সত্যিকার অর্থেই কার্যকর; তবে তিনি বলপ্রয়োগ করে এটি বাস্তবায়ন করবেন না। ফক্স নিউজ রেডিওর ব্রায়ান কিলমিডের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প বলেন, ‘আমি মনে করি, আমার পরিকল্পনা সত্যিকার অর্থেই কাজ করবে। তবে আমি বলপ্রয়োগ করব না; শুধু পরামর্শ দেব।’ মিসর ও জর্ডান গাজা নিয়ে তার প্রস্তাবের বিরোধিতা করায় বিস্ময় প্রকাশ করেন ট্রাম্প। তিনি স্বীকার করেন, দেশ দুটি গাজাবাসীদের গ্রহণ করতে অস্বীকার করায় তার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। ট্রাম্প আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমরা প্রতিবছর জর্ডান ও মিসরকে কয়েক বিলিয়ন ডলার দিই, এবং আমি বিস্মিত হয়েছি যে তারা এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করছে।’ ট্রাম্প দাবি করেন, গাজার জনগণ যদি একটি সুন্দর কমিউনিটিতে বসবাসের সুযোগ পায়, তবে তারা গাজা ছাড়তে রাজি হবে। গাজাকে দারুণ একটি জায়গা হিসেবে অভিহিত করে ট্রাম্প বলেন, ‘আমি জানি না কেন ইসরায়েল এটি ছেড়ে দিয়েছিল।’ ট্রাম্প বারবার গাজা দখল এবং এর জনগণকে অন্য কোথাও পুনর্বাসনের কথা বলে আসছেন। তিনি গাজাকে পুনর্নির্মাণ করে মধ্যপ্রাচ্যের রিভেরা বানাতে চান। তবে এই পরিকল্পনা আরব বিশ্ব ও অন্যান্য দেশের তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে। এই পরিকল্পনাকে জাতিগত নির্মূলের শামিল বলে অভিহিত করছেন তারা। ওয়াশিংটন পোস্ট ও ইপসোস পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, নানা বিতর্কিত সিদ্ধান্তের কারণে ক্ষমতাগ্রহণের মাত্র এক মাসের মাথায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা কমতে শুরু করেছে। ৫৭ শতাংশ মার্কিনি মনে করেন, দায়িত্বগ্রহণের পর ক্ষমতার সীমা ছাড়িয়ে গেছেন ট্রাম্প। জরিপ অনুযায়ী, ট্রাম্পকে সমর্থনের হার ৪৫ শতাংশে নেমে এসেছে। ৫৩ শতাংশ ট্রাম্পকে সমর্থন করছেন না বলে জানিয়েছেন। এই এক মাসে ট্রাম্প প্রশাসনের কার্যক্রমকে সমর্থন করছেন ৪৩ শতাংশ মার্কিনি, ৪৮ শতাংশ বিরোধিতা করছেন। এর মধ্যে তীব্র বিরোধিতা করছেন ৩৭ শতাংশ, দৃঢ় সমর্থন দিয়েছেন ২৭ শতাংশ। জরিপ অনুযায়ী, প্রায় ৯০ শতাংশ রিপাবলিকান ট্রাম্পের কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করছেন, ৯০ শতাংশ ডেমোক্র্যাট বিরোধিতা করছেন। নিরপেক্ষ ভোটারদের মধ্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ তার পদক্ষেপগুলোর পক্ষে থাকলেও অর্ধেকের বেশি এর বিরোধিতা করছেন। ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ মিত্র ইলন মাস্কের কর্মকাণ্ড নিয়েও জনরোষ রয়েছে। জরিপে দেখা গেছে, কেন্দ্রীয় প্রশাসনের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততাকে সমর্থন দিচ্ছেন মাত্র ৩৪ শতাংশ মার্কিনি, ৪৯ শতাংশই বিরোধিতা করছেন। এই এক মাসে গাজাবাসীদের উচ্ছেদসহ বিভিন্ন আগ্রাসী পদক্ষেপ নিয়েছেন ট্রাম্প। তার বেশকিছু নির্বাহী আদেশ আইনি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। কেন্দ্রীয় আদালত ট্রাম্প প্রশাসনের বিরুদ্ধে রায় দিলে কী হবে, এই প্রশ্নের জবাবে ৮৪ শতাংশ বলেন, রায় মেনে নেওয়া উচিত ট্রাম্পের। ১১ শতাংশ মনে করেন, আদালতের রায় উপেক্ষা করা উচিত। ৬২ শতাংশ মার্কিনি মনে করেন, ট্রাম্প তার ক্ষমতার সীমা ছাড়িয়ে গেলেও রিপাবলিকান সংখ্যাগরিষ্ঠ কংগ্রেস তাকে সমর্থন দিয়ে যাবে। তবে ৫৬ শতাংশ মনে করেন, সীমা ছাড়িয়ে গেলে সুপ্রিম কোর্ট তাকে থামানোর চেষ্টা করবে।