ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় নির্বাচনে জনপ্রশাসন, পুলিশ, নির্বাচন কমিশন এবং গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অনিয়ম-দুর্নীতি-পক্ষপাতিত্ব করেছেন। এজন্য তারা নগদ টাকাও পেয়েছেন। এসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সংস্কার কমিশনের সঙ্গে জনপ্রশাসন এবং পুলিশের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের বৈঠক হয়েছে। ওই বৈঠকে অন্তর্বর্তী সরকারের গৃহীত রাষ্ট্র সংস্কার, দুর্নীতি প্রতিরোধ, গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার অভিমত উঠে এসেছে। যার ধারাবাহিকতায় বিগত তিনটি বিতর্কিত সংসদ নির্বাচনের (২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত) দায়িত্বে থাকা সাবেক জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) মধ্যে ২২ জনকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। সচিব ও অতিরিক্ত সচিবদের পর গতকাল রোববার পুলিশের চারজন ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল (ডিআইজি) বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের পুলিশ শাখা গতকাল এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করে। গত সাড়ে ১৫ বছরে সুবিধাভোগী ও অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত থাকা কর্মকর্তাদের ওএসডি এবং বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়ে যোগ্য বঞ্চিত কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিয়ে প্রশাসন সাজানোর উদ্যোগ গ্রহণ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গণি স্বাক্ষরিত পৃথক চারটি প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ‘জনস্বার্থে’ সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অবসরে যাওয়া কর্মকর্তারা প্রচলিত বিধি অনুযায়ী অবসর সংক্রান্ত সব সুবিধা পাবেন। অবসরে পাঠানো চার কর্মকর্তা মো. নিশারুল আরিফ (এন্টি টেররিজম ইউনিট), মো. আব্দুল কুদ্দুস আমিন (নৌপুলিশ, ঢাকা), আমেনা বেগম (হাইওয়ে পুলিশ, ঢাকা) এবং আজাদ মিয়া (হাইওয়ে পুলিশ, ঢাকা)। সাবেক ডিসিদের বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হলেও তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলমান রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির তথ্য পেলে মামলার প্রক্রিয়ায় যাবে সরকার। এ বিষয়ে গতকাল রোববার সচিবালয়ে জনপ্রশাসন সিনিয়র সচিব মোখলেস উর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো এবং ওএসডি করা জেলা প্রশাসকদের মধ্যে যাদের বিরুদ্ধে আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগ রয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে। তবে যাদের বিরুদ্ধে আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগ নেই, তাদের বিরুদ্ধে মামলা হবে না। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে বিগত তিনটি বিতর্কিত নির্বাচনে যারা জেলা প্রশাসক বা ডিসি হিসেবে রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করেছেন, এমন শতাধিক কর্মকর্তার অনেককে দায়িত্বহীন বা ওএসডি করা হচ্ছে। কয়েকজনকে বাধ্যতামূলক অবসরেও পাঠানো হচ্ছে। প্রশাসনিক ব্যবস্থা ছাড়াও কারো কারো বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে।
জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার জুলাই-আগস্টের বিপ্লবের মধ্যদিয়ে কর্তৃত্ববাদী আওয়ামী লীগ সরকারের পতন বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি অভূতপূর্ব অর্জন। সেই অর্জন ম্লান করতে আমলাতন্ত্রে পতিত সরকারের দোসরদের প্রভাব অব্যাহত রয়েছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। সেজন্য প্রশাসনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের ক্ষেত্রে প্রধানত উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের অপসারণের মাধ্যমে দলীয়করণ থেকে মুক্ত করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের। যদিও দলীয়করণের শিকড় অনেক গভীরে এরপরও যতটুকু সম্ভব সুশাসনের চ্যালেঞ্জ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।
জনপ্রশাসন সচিব দাবি করেন, সরকার কারো বিরুদ্ধেই অবিচার এবং পক্ষপাতমূলক আচরণ করেনি। রাষ্ট্রের স্বার্থে যে সিদ্ধান্ত নেয়ার শুধুমাত্র সেটাই নেয়া হয়েছে। সেই তদন্তের ভিত্তিতেই অপরাধ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেবে সরকার। তবে ২০২৪ সালের নির্বাচনে যেসব ডিসি রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্বে ছিলেন, তাদের ব্যাপারে এখন গোয়েন্দা সংস্থা কাজ করছে বলে জানান তিনি। এদিকে, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে এখন অতিরিক্ত সচিবের দায়িত্বে রয়েছেন, এমন আরও নয়জন বঞ্চিত কর্মকর্তাকে সচিব করা হচ্ছে শিগগিরই। তারা প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদ পাওয়ার যোগ্য বলেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব বলেন, শিল্প মন্ত্রণালয়ে নতুন সচিব হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (এপিডি অনুবিভাগ) মো. ওবায়দুর রহমান। এছাড়া দুয়েক দিনের মধ্যে আরও নয়জনকে সচিবপদে শূন্য থাকা মন্ত্রণালয় ও বিভাগে পদায়ন করা হবে।
মোখলেস উর রহমান বলেন, চারটি সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডের সভায় সচিবপদের জন্য ১২ জনকে নির্বাচন করা হয়েছে। তারা অধিকাংশই যোগ্য ও বঞ্চিত। তাদের মধ্যে কেউ চুক্তিতে নন। চাকরিতে কর্মরতদের মধ্যে থেকেই সচিব করা হচ্ছে।
বিতর্কিত নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করা সাবেক জেলা প্রশাসক (ডিসি) বা অন্য কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়ে মোখলেস উর রহমান বলেন, যাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, তাদের কাউকে ওএসডি, কাউকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। আরেকটি বিষয় হলো, যারা অর্থনৈতিক অপরাধ করেছেন বলে অভিযোগ আছে, সে ব্যাপারে বিভিন্ন সংস্থা এবং নিজস্ব ব্যবস্থায় যদি দেখা যায় ঘটনা সত্যি সত্যি ঘটেছে, শুধু সেই অভিযোগগুলো দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) পাঠানো হবে। এটা সাধারণীকরণ করা হবে না। যাদের নামে অপপ্রচার আছে বা অপরাধের সঙ্গে জড়িত নন বা এ ধরনের কিছুই করেননি, সাময়িকভাবে ওএসডি হয়েছেন, তারা খুব সাধারণ জীবনযাপন করবেন, এতে কোনো সমস্যা না। এখানে সরকারের পক্ষপাত নেই। সরকার অত্যন্ত সচেতনভাবে কাজটি করবে, যাতে একজনও নিরীহ কর্মকর্তার যেন কোনো অসম্মান না হয়।
২০২৪ সালের নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকা সাবেক জেলার প্রশাসকদের (ডিসি) বিষয়ে জনপ্রশাসন সচিব আরও বলেন, সাবেক ডিসিদের পুরো তালিকা গোয়েন্দা সংস্থার কাছে পাঠানো হয়েছে। সেগুলো আসার পর বিবেচনা করা হবে। এ বিষয়ে চারজন উপদেষ্টার সমন্বয়ে একটি কমিটি আছে। সেই কমিটিতে এগুলো বিশ্লেষণ করা হবে এবং তা ধীরেসুস্থে হবে। পক্ষপাত বা কোনো কিছুর বশবর্তী হয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হবে না। সব সিদ্ধান্ত হবে নিয়মনীতির মাধ্যমে। একজন কর্মকর্তাও যেন ক্ষতিগ্রস্ত (ভিকটিম) না হন, সেটি দেখা হবে।
জনপ্রশাসনের কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, মন্ত্রণালয় ও দপ্তরগুলো দ্রুত সচল ও গতিশীল করতে বঞ্চিতদের অগ্রাধিকার দিয়ে সচিব করা হচ্ছে। একইসঙ্গে সরবরাহব্যবস্থায় যাতে কোনো বিরূপ প্রভাব না পড়ে, সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সচিব সভায় মন্ত্রণালয়গুলোর বাস্তবায়নাধীন উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে আলোচনা হয়েছে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের দিকে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার।