বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জ্বনতার আন্দোলনে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনাকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা থেকে হটিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। দেখতে দেখতে অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতা সাত মাসের কাছাকাছি পৌঁছেছে। এরমধ্যেই পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের দোসররা দেশের ভেতরে নানাভাবে বিশৃঙ্খলের চেষ্টা করছে। তাদের পাতানো ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পড়ে সহিংসতায় লিপ্ত হচ্ছেন বিভিন্ন রাজ্বনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা। আর এসব সহিংতার ঘটনার পর একজ্বন আরেকজ্বনের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছেন। এভাবে দোষারোপের রাজ্বনীতি চলতে থাকলে দেশে শৃঙ্খলা ফেরানো চ্যালেঞ্জ্ব হয়ে পড়বে বলে মনে করছেন রাজ্বনীতিবিদ ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। গতকাল মঙ্গলবার প্রথবারের মতো জাতীয় শহিদ সেনা দিবস উপলক্ষে বনানীতে সামরিক কবরস্থানে শায়িত পিলখানায় শহিদ সামরিক কর্মকর্তা ও সদস্যদের উদ্দেশ্যে পুষ্পস্তবক অর্পণ শেষে সাংবাদিকদের সামনে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (অব.) বলেন, শহিদ পরিবারের দাবি ছিল দ্রুত বিচার ও শহিদ সেনা দিবস ঘোষণা করা। আমরা কিন্তু দুটোই করছি। শহিদ সেনা দিবস ঘোষণা করেছি, আর সঠিক বিচারের জ্বন্য স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছে। এদিকে গতকাল রাজ্বধানীর রাওয়া কনভেনশন হলে ‘জাতীয় শহিদ সেনা দিবসের’ অনুষ্ঠানে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের বিচারিক প্রক্রিয়াকে নষ্ট না করার আহ্বান জানিয়ে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ্ব-জামান বলেছেন, ‘একটা জিনিস আমাদের সব সময় মনে রাখতে হবে, এই বর্বরতা কোনো সেনাসদস্য করেনি। সম্পূর্ণটাই তদানীন্তন বিডিআর সদস্য দ্বারা সংঘটিত। ফুলস্টপ। এখানে কোনো ‘ইফ’ এবং ‘বাট’ (যদি ও কিন্তু) নাই। এখানে যদি ‘ইফ’ এবং ‘বাট’ আনেন, এই যে বিচারিক কার্যক্রম এত দিন ধরে হয়েছে, ১৬ বছর ধরে, ১৭ বছর ধরে যারা জেলে আছে, যারা কনভিকটেড, সেই বিচারিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে। এই জিনিসটা আমাদের খুব পরিষ্কার করে মনে রাখা প্রয়োজ্বন। এই বিচারিক প্রক্রিয়াকে নষ্ট করবেন না। যে সমস্ত সদস্য শাস্তি পেয়েছে, তারা শাস্তি পাওয়ার যোগ্য।’ জেনারেল ওয়াকার-উজ্ব-জামান বলেন, ‘আজ্বকে একটা বেদনাবিধুর দিবস। ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি আমরা এই ৫৭ জ্বন চৌকস সেনা অফিসার এবং শুধু তাই নয়, তাদের কিছু কিছু পরিবারের সদস্যদের আমরা হারিয়েছি। এখানে আসার সময় এই ছবিগুলো আমি দেখছিলাম। এই ছবিগুলো আপনারা অনেকে ছবিতে দেখেছেন। কিন্তু এগুলো আমার সব চাক্ষুষ দেখা। আমি একটা চাক্ষুষ সাক্ষী এই সমস্ত বর্বরতার।’
জেনারেল ওয়াকার-উজ্ব-জামান বলেন, ‘এখানে কোনো রাজ্বনৈতিক নেতৃবৃন্দ এর মধ্যে উপস্থিত ছিল কি না, ইনভলব ছিল কি না, বাইরের কোনো শক্তি এর মধ্যে ইনভলব ছিল কি না, সেটার জ্বন্য কমিশন করা হয়েছে। কমিশনের চেয়ারম্যান এখানে আছেন। উনি এটা বের করবেন এবং আপনাদের জানাবেন।’ সেনাপ্রধান বলেন, ‘বটমলাইন হচ্ছে যে এই সমস্ত, আমাদের এই চৌকস সেনাসদস্য, যারা প্রাণ হারিয়েছেন, তারা প্রাণ হারিয়েছেন তদানীন্তন বিডিআর সদস্যদের গুলিতে। আমরা নিজেরা এসব জিনিস নিয়ে অনেক ভিন্নমত পোষণ করছি কেউ কেউ। এই জিনিসটাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করছি। সেটা আমাদের জ্বন্য মঙ্গলজ্বনক হবে না।’
সেনাবাহিনীকে সহায়তা করার আহ্বান সেনাপ্রধান বলেন, ‘নিজেরা হানাহানিতে লিপ্ত থাকলে দেশের স্বাধীনতা বিপন্ন হবে। ২০০৯ সালে পিলখানা হত্যাকাণ্ডে শহিদ সেনা কর্মকর্তাদের স্মরণে শহিদ সেনা দিবস পালন অনুষ্ঠানে সতর্কবাণী উচ্চারণ করে সেনাপ্রধান বলেন, ‘আমি আপনাদের সতর্ক করে দিচ্ছি, পরে বলবেন যে, আমি সতর্ক করিনি, আমি আপনাদের সতর্ক করে দিচ্ছি, আপনারা যদি নিজেদের মধ্যে ভেদাভেদ ভুলে একসঙ্গে কাজ্ব না করতে পারেন, নিজেরা যদি কাদা ছোড়াছুড়ি করেন, মারামারি-কাটাকাটি করেন, এই দেশ এবং জাতির স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবে। আমি আজ্বকে বলে দিলাম, নইলে আপনারা বলবেন যে, আমি আপনাদের সতর্ক করিনি। আমি সতর্ক করে দিচ্ছি আপনাদের।’ নিজের ‘অন্য কোনো আকাঙ্ক্ষা’ নেই উল্লেখ করে জেনারেল ওয়াকার-উজ্ব-জামান বলেন, ‘আমার একটাই আকাঙ্ক্ষা, দেশ এবং জাতিটাকে একটা সুন্দর জায়গায় রেখে ছুটি করা। আই হ্যাড এনাফ লাস্ট সেভেন-এইট মান্থস, আই হ্যাড এনাফ। আমি চাই, দেশ এবং জাতিকে একটা সুন্দর জায়গায় রেখে আমরা সেনানিবাসে ফেরত আসব।’
দেশের এই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপের পেছনে ‘কিছু কারণ আছে’ উল্লেখ করে সেনাপ্রধান বলেন, ‘আমরা নিজেরা হানাহানির মধ্যে ব্যস্ত, একজ্বন আরেকজ্বনের বিরুদ্ধে বিষোদ্গারে ব্যস্ত। এটা একটা চমৎকার সুযোগ অপরাধীদের জ্বন্য। যেহেতু আমরা একটা অরাজ্বক পরিস্থিতির মধ্যে বিরাজ্ব করছি, তারা (অপরাধীরা) খুব ভালোভাবেই জানে যে, এই সময়ে যদি এই সমস্ত অপরাধ করা যায়, তাহলে এখান থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব। সেই কারণে এই অপরাধগুলো হচ্ছে, আমরা যদি সংগঠিত থাকি, একত্রিত থাকি, তাহলে অবশ্যই এটা সম্মিলিতভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব হবে।’
পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, ডিজিএফআই, এনএসআই এসব বাহিনী অতীতে দেশের জ্বন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ্ব করেছে উল্লেখ করে সেনাপ্রধান বলেন, ‘(তারা) খারাপ কাজের সঙ্গে অসংখ্য ভালো কাজ্ব করেছে। আজ্ব যে দেশের স্থিতিশীলতা, দেশটাকে যে এত বছর স্থিতিশীল রাখা হয়েছে, এটার কারণ হচ্ছে, এই সশস্ত্র বাহিনীর বহু সেনাসদস্য, সিভিলিয়ান সবাই মিলে এই অরগানাইজেশনগুলোকে অসামরিক-সামরিক সবাই মিলে, এই অরগানাইজেশনগুলোকে ইফেক্টিভ (কার্যকর) রেখেছে। সেজ্বন্য এতদিন ধরে আমরা একটা সুন্দর পরিবেশ পেয়েছি। এর মধ্যে যারা কাজ্ব করেছে, যদি অপরাধ করে থাকে, সেটার শাস্তি হবে। অবশ্যই শাস্তি হতে হবে। না হলে এই জিনিস আবার ঘটবে। আমরা সেটাকে বন্ধ করতে চাই চিরতরে। কিন্তু তার আগে মনে রাখতে হবে, আমরা এমন ভাবে কাজ্বটা করবো, এই সমস্ত অরগানাইজেশনগুলো যেন আন্ডারমাইন্ড না হয়।’
‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব শুধু সেনাবাহিনীর নয়’ সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে সেনাপ্রধান বলেন, ‘এই দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব শুধু সেনাবাহিনীর নয়। ২ লাখ পুলিশ আছে, বিজিবি আছে, র্যাব আছে, আনসার-ভিডিপি আছে; আমার আছে হচ্ছে ৩০ হাজার সৈন্য। এদের আমি... এই যে একটা বিরাট ভয়েড... আমি এই ৩০ হাজার সৈন্য দিয়ে, আমি কীভাবে এটা পূরণ করব? ৩০ হাজার থাকে, আবার ৩০ হাজার চলে যায়, ক্যান্টনমেন্টে আরও ৩০ হাজার আসে, এটা দিয়ে আমরা দিন-রাত চেষ্টা করে যাচ্ছি। এখানে যে সমস্ত উশৃঙ্খল কাজ্ব হয়েছে, সেটা আমাদের নিজ্বস্ব তৈরি। এটা আমাদের নিজ্বস্ব ম্যানুফ্যাকচারড। আমরা এইগুলো তৈরি করেছি। এই বিপরীতমুখী কাজ্ব করলে দেশে কখনো শান্তি-শৃঙ্খলা আসবে না।