ঢাকা শুক্রবার, ২০ জুন ২০২৫, ৬ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

এলো নতুন দল, নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়

এলো নতুন দল, নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়

দলের নাম : জাতীয় নাগরিক পার্টি

ইংরেজি রূপ : ন্যাশনাল সিটিজেনস পার্টি

সংক্ষেপে : এনসিপি

* এখনই সময় নতুন বাংলাদেশ গড়ার : নাহিদ

* দল গঠনের পরই গণপরিষদ নির্বাচনের দাবি জানালেন আখতার

* সংসদে কে যাবে, নির্ধারণ করবে জনগণ : হাসনাত

* সর্বস্তরের মানুষের চাওয়া-পাওয়ার ভিত্তিতেই নতুন রাজনৈতিক দল : আরিফ

* বড় রাজনৈতিক দল ছোট দলকে এগোতে না দিলে ফের স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হতে পারে : সারজিস

জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট জালিয়াতির মাধ্যমে টানা সাড়ে ১৫ বছর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় গেড়ে বসা ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারকে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে পতন হয়েছে। এই আন্দোলনে ইতিহাসে নিকৃষ্টতম স্বৈরাচার খুনি হাসিনার পলায়নের পেছনে ছাত্ররা সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখেন। সেজন্য ছাত্রদের অগ্রাধিকার দিয়ে গতকাল শুক্রবার রাজধানীর বুকে মহাসমাবেশের মাধ্যমে ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’ নামে নতুন একটি রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটল। আগামীতে দলটি জাতীয় সংসদের পাশাপাশি স্থানীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। সেলক্ষ্যেই দেশজুড়ে জনসমর্থন বাড়াতে জোরেসোরে মাঠে নামছে দলটি। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে জাতীয় নাগরিক পার্টির ভূমিকা দলটিকে একক বৃহৎ রাজনৈতিক দলে পরিণত করবে বলে প্রত্যাশা কেন্দ্রীয় নেতাদের। ফলে ‘নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের’ প্রতিশ্রুতি নিয়ে জুলাই আন্দোলনের সংগঠকদের নেতৃত্বে আত্মপ্রকাশ পেল নতুন রাজনৈতিক দল ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’ (এনসিপি)।

জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে জাতীয় নাগরিক পার্টির আত্মপ্রকাশ ঘিরে পতাকা হাতে মিছিল নিয়ে বিপুলসংখ্যক ছাত্র-জনতা উচ্ছ্বাস করেন। দেশের বিভিন্ন জেলা, উপজেলা, মহানগর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে খন্ড খন্ড মিছিল নিয়ে সমাবেশস্থলে হাজির হন তারা। কানায় কানায় পূর্ণ হয় মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ। পরে বিকেল সোয়া ৪টার দিকে জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া তরুণদের রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠান শুরু হয়। শুরুতে পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত করা হয়। এরপর পবিত্র গীতা, ত্রিপিটক ও বাইবেল থেকে পাঠ করা হয়। ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠের পর জাতীয়সংগীত পরিবেশন করা হয়। এরপর জুলাই আগস্টে নিহতদের স্মরণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয় এবং নিজ নিজ ধর্মমতে তাদের জন্য দোয়া করা হয়। পরে ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’র আহ্বায়ক হিসেবে সাবেক তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম এবং সদস্য সচিব আখতার হোসেনের নাম ঘোষণা করা হয়। নতুন রাজনৈতিক দল ও আহ্বায়ক এবং সদস্য সচিবের নাম ঘোষণা করেন জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে নিহত শহীদ মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন রাব্বীর বোন মীম আক্তার। মীম আক্তার বলেন, ইতিহাসে দেখিনি বোনের কাঁধে ভাইয়ের লাশ। আমরা দুই বোনের কাঁধে ছিল ভাইয়ের লাশ।

সদস্য সচিব আখতার হোসেন আংশিক আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করেন। এতে দলের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক হয়েছেন শামান্তা শারমিন, আরিফুল ইসলাম আদীব, সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব হয়েছেন ডা. তাসনিম জারা, নাহিদা সরওয়ার রিভা, দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হয়েছেন হাসনাত আব্দুল্লাহ, উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হয়েছেন সারজিস আলম, মুখ্য সমন্বয়ক হয়েছেন নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী, সিনিয়র যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক হয়েছেন আবদুল হান্নান মাসউদ।

যুগ্ম-আহ্বায়ক করা হয়েছে নুসরাত তাবাসসুম, মনিরা শারামিন, মাহবুব আলম, সারওয়ার তুষার, অ্যাডভোকেট মুজাহিদুল ইসলাম শাহীন, তুজরুবা জাবিন, সুলতান মুহাম্মদ জাকারিয়া, ড. আতিক মুজাহিদ, আশরাফ উদ্দিন মাহদি, অর্পিতা শ্যামা দেব, তানজিল মাহমুদ, অনিক রায়, খালেদ সাইফুল্লাহ, জাবেদ রাসিম, এহতেশাম হক এবং হাসান আলী। যুগ্ম সদস্য সচিব আব্দুল্লাহ আল আমিন, আরিফ সোহেল, রশিদুল ইসলাম রিফাত, মাহিন সরকার, মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন, আকরাম হোসাইন, এস এম সাইফ মুস্তাফিজ, সালেহ উদ্দিন সিফাত (দপ্তরে সংযুক্ত), আলাউদ্দিন মুহাম্মদ, ফরিদ উদ্দীন, মোহাম্মদ ফারহাদ আলম ভুইয়া, মোহাম্মদ মিরাজ মিয়া, লুৎফর রহমান, মোহাম্মদ মইনুল ইসলাম তুহিন, মুশফিকুর সালেহিন, ড. জাহিদুল ইসলাম, জহিরুল ইসলাম মুসা, হুমায়রা নুর, মুশফিকুর রহমান জুহান, মোল্লা মোহাম্মদ ফারুক এহসান, শাগুপ্তা বুশরা বিসমা, আহনাফ সাঈদ খান, আবু সাঈদ মোহাম্মদ সুজাউদ্দিন, মীর আরশাদুল হক, ফয়সাল মাহমুদ শান্ত, তারেক রেজা, মশিউর রহমান, জয়নাল আবেদিন শিশির, মোহাম্মদ মুনতাসির রহমান, গাজী সালাউদ্দিন তানভীর, তামিম আহমেদ এবং তাহসিন রিয়াজ। যুগ্ম মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) মোহাম্মদ আতাউল্লাহ, ডা. মাহমুদা মিতু, মোল্লা রহমতুল্লাহ, এম এম শাহরিয়ার, জোবায়ের আরিফ। যুগ্ম মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সাইফুল্লাহ হায়দার, আলী নাসের খান, সাকিব মাহদি, মেজর (অবসরপ্রাপ্ত) আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ, সাদিয়া ফারজানা দিনা, অলিক মৃ, হানিফ খান সজিব।

নতুন সংবিধান, গণপরিষদ নির্বাচন এবং তরুণদের আকাঙ্ক্ষা পূরণের ঘোষণা দিয়ে আত্মপ্রকাশ করে দলটি।

আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নতুন দলটির নেতাকর্মীরা উপস্থিত হন। এছাড়াও অনুষ্ঠানে যোগ দেন জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের নায়েবে আমির আহমেদ আলী কাসেমী, বিকল্পধারার নেতা মেজর (অব.) আব্দুল মান্নান, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা জালালুদ্দীন আহমেদ, লেবার পার্টির একাংশের চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, ইসলামী ঐক্য জোটের সহ-সভাপতি জসিম উদ্দিন, বিএলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব আহমেদ আবদুল কাদের। এছাড়া অনুষ্ঠানে কূটনৈতিকদের মধ্যে পাকিস্তানের হাইকমিশনারের পক্ষে একজন কাউন্সিল অংশ নিয়েছেন বলে মঞ্চ থেকে জানানো হয়।

জাতীয় নাগরিক পার্টির আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে লিখিত ঘোষণাপত্রে জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, এখনই সময়- নতুন স্বপ্ন দেখার, নতুন পথচলার এবং একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার! তাই আসুন, প্রত্যেকে যার যার অবস্থান থেকে শপথ করি। ঐক্যবদ্ধ হই এবং আমাদের কাঙ্ক্ষিত সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে দৃঢ়চিত্তে এগিয়ে যাই। আমাদের দেশ, আমাদের অধিকার, আমাদের ভবিষ্যৎ- আমাদের সেকেন্ড রিপাবলিক অধরা কোন স্বপ্ন নয়, এটি আমাদের প্রতিজ্ঞা!

নাহিদ ইসলাম বলেন, জুলাই ২০২৪-এ ছাত্র-জনতা বিপুল আত্মত্যাগের মাধ্যমে এক অভূতপূর্ব অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ দেড় দশক ধরে ঝেঁকে বসা ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন ঘটিয়েছে। কিন্তু আমাদেরকে স্মরণ রাখতে হবে, হাজারো শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এই নতুন স্বাধীনতা কেবল একটি সরকার পতন করে আরেকটি সরকার বসানোর জন্যই ঘটেনি। জনগণ বরং রাষ্ট্রের আষ্টেপৃষ্ঠে ঝেঁকে বসা ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা বিলোপের মাধ্যমে একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের আকাঙ্ক্ষা থেকে এই অভ্যুত্থানে সাড়া দিয়েছিল, যাতে করে জনগণের অধিকারভিত্তিক একটি রাষ্ট্র পুনর্গঠিত হয়। সেই লক্ষ্য নিয়েই আমরা জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিচ্ছি।

তিনি বলেন, আমরা ঐতিহ্য, সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ রক্ষার মাধ্যমে একটি বৈচিত্র্যপূর্ণ ও সমৃদ্ধ সমাজ বিনির্মাণ করতে চাই। আমাদের রিপাবলিক সব নাগরিককে দারিদ্র্য, বৈষম্য ও ক্ষমতার অপব্যবহার থেকে শক্তিশালী সুরক্ষা প্রদান করবে। আমাদের সেকেন্ড রিপাবলিকে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর কোনো অংশকেই অপরায়ন করা হবে না। বরং রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিককে সমান গুরুত্ব প্রদান ও সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে।

অর্থনীতিতে, আমরা কৃষিসেবা উৎপাদন খাতের যথাযথ সমন্বয়ের মাধ্যমে এমন একটি জাতীয় অর্থনীতি গড়ে তুলতে চাই যেটি হবে স্বনির্ভর, আয়-বৈষম্যহীন মন্তব্য করে নাহিদ ইসলাম বলেন, আমরা একটি ন্যায্যতা ও সমতাপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠায় আমাদের সংকল্প আবারও পুনর্ব্যক্ত করতে চাই। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থান শুধু একটি ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধেই বিজয় নয়, এটি আমাদের ভবিষ্যৎ নির্মাণেরও শপথ। চলুন আমরা একসঙ্গে, হাতে হাত রেখে, এমন এক বাংলাদেশ গড়ে তুলি, যেখানে প্রতিটি নাগরিকের কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত হবে, যেখানে ন্যায় প্রতিষ্ঠা, মানুষের অধিকারের সংগ্রামই হবে রাজনীতির অন্যতম লক্ষ্য। যেখানে সাম্য ও মানবিক মর্যাদা হবে রাষ্ট্রের ভিত্তি।

দল গঠনের পরই গণপরিষদ নির্বাচনের দাবি জানিয়ে এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, সংবিধান সংস্কারের জন্য গণপরিষদ নির্বাচন দরকার। তরুণরা স্বপ্ন দেখে আগামী বাংলাদেশ নতুন এক সংবিধানের মাধ্যমে পরিচালনা করা হবে। সেই স্বপ্ন নিয়ে গণপরিষদ নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আমি আমার বক্তব্য শেষ করছি।

দীর্ঘ দেড় দশকের আওয়ামী জাহেলিয়াতকে দূর করে আজকে আমরা মুক্ত বাংলাদেশে এমন মন্তব্য করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক ও সদ্য আত্মপ্রকাশ করা জাতীয় নাগরিক পার্টির মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেছেন, গণভবন ও সংসদ ভবনে কে যাবে, তা নির্ধারণ করবে দেশের খেটে খাওয়া জনগণ। গণভবনে কে যাবে সেটি নির্ধারিত হবে বাংলাদেশ থেকে, ভারত থেকে সেটি নির্ধারিত হবে না। এই সংসদে কে বসবে, তা নির্ধারণ করবে এই ভূখণ্ডের মানুষ। আমরা একটা সুন্দর বাংলাদেশ গড়তে চাই। যেখানে কোনো ভেদাভেদ থাকবে না।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্য সচিব আরিফ সোহেল বলেন, আমরা সর্বস্তরের মানুষের কাছে গিয়েছি। তাদের থেকে জানতে পেরেছি, তারা কেন স্বৈরাচারী শেখ হাসিনাকে উৎখাত করেছেন। তাদের চাওয়া-পাওয়ার ওপর ভিত্তি করেই আজকের এই রাজনৈতিক দলের উৎপত্তি হয়েছে।

জাতীয় নাগরিক পার্টির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম বলেন, এই মঞ্চ থেকে আমরা শপথ নিতে চাই, এই ছোট জীবনে এত বড় দায়িত্বের আমানতকে যেন আমরা খেয়ানত না করি। আমরা যদি বাংলাদেশকে সুসংগঠিত করতে চাই তাহলে আমাদের সব রাজনৈতিক দলকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। তাহলে আগামীর বাংলাদেশ হবে ঐক্যের বাংলাদেশ। হাসিনা দেশের সব প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। সব রাজনৈতিক দলকে ঐক্যবদ্ধভাবে এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে সংগঠিত করতে হবে। খুনি হাসিনার বিচার আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে করতে হবে। কোনো অপরাধীর মুক্তির জন্য আমরা যেন থানায় না যাই।

তিনি বলেন, যারা বড় রাজনৈতিক দল রয়েছে, তারা যদি ছোট দলকে এগিয়ে যেতে না দেয় তাহলে আবার একটি স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হতে পারে। খুনি হাসিনাকে দেখে যেন আমরা সেই শিক্ষা নিতে পারি। আমরা দেশ এবং জাতিকে সবার ওপরে রেখে যেন নতুন ও সাম্যের বাংলাদেশ গঠন করতে পারি।

অধিকার আদায়ের জন্য মাঠে নামা মানুষের ওপর যেন আর রক্তপাত না হয়, নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টির কাছে সেই প্রত্যাশা রাখেন জুলাই শহিদ জাবির ইব্রাহিমের বাবা নওশের আলী। শুক্রবার বিকেলে জাতীয় নাগরিক পার্টির আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে তিনি বলেন, এই দেশে ১৯৭১ সালে যেভাবে রক্তক্ষরণ হয়েছিল, সেই রক্তক্ষরণ আমরা চাই না। নব্বইয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছিল, সেই রক্তক্ষরণ আমরা আর চাই না। এই চব্বিশে রক্তক্ষরণ হয়েছে, জুলাই বিপ্লবে, সেই রক্তক্ষরণ আমরা চাই না। দলটির প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে তিনি বলেন, আমার অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা থাকবে, সমর্থন থাকবে তারা যেন নতুন বাংলাদেশ উপহার দেয়। আমি চাই, আমার দেশ যেন এই দলের কাছে নিরাপদ থাকে। এই দল আরো ভালো করবে। এই দলের প্রতি আমাদের, বিশেষ করে এই শহিদ পরিবারের পক্ষ থেকে তাদের অকুণ্ঠ সমর্থন জানাই।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর থেকে বড় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠ হয়েছিল। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকাবস্থায় দলগুলোর নেতাকর্মীরা দুর্নীতি, বিদেশে অর্থ পাচার, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ায় জনগণের সমর্থন হারিয়ে ফেলে। দীর্ঘ শাসনে বড় ব্যর্থতা হচ্ছে দুর্নীতি দমন করতে না পারেনি। এরপরেও জোর করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকতে আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং জাতীয় পার্টি পাতানো নির্বাচন করে। জনগণের আন্দোলনের মুখে কিছুদিন পরেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। এসব দলের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা পরিচালনা বহু মানুষের কাছে শুভকর মনে হয়নি। পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলোর দুঃশাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে তরুণ প্রজন্মের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি। নতুন দল হিসেবে তাদের লক্ষ্য থাকবে দেশের ন্যায় বিচার, দুর্নীতি, অনিয়ম ও সন্ত্রাস দূর করা, এটাই দেশের নাগরিকদের প্রত্যাশা।

জানা গেছে, স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এক নায়কতন্ত্রের কায়দায় বাকশাল তৈরি করা হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মধ্য দিয়ে সেই বাকশালের ইতি টানা হয়। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ক্ষমতা এলে কয়েক বছর পরেই তাকেও হত্যা করা হয়, রাজনৈতিক দল হিসেবে জাতীয় পার্টিও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা পরিচালনার স্বাদ পেলেও নব্বইয়ের আন্দোলনের মাধ্যমে জাতীয় পার্টি ক্ষমতাচ্যুত হয়। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি আবারো সরকার গঠন করলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলুপ্ত করে। পরে আওয়ামী লীগের আন্দোলনের মুখে তত্ত্বাবধায় সরকারের মাধ্যমে নির্বাচন দিতে বাধ্য হয় বিএনপি। পরবর্তী নির্বাচনের মাধ্যমে ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়। শেখ হাসিনা সরকার গঠনের পরেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দিয়ে কারচুপির নির্বাচনের মাধ্যমে টানা সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকে। সর্বশেষ চব্বিশের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান। ছাত্রদের অগ্রাধিকার দিয়ে ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’ গঠন করা হয়েছে।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না। রাজনীতিতে সক্রিয় প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোতে পরিবারতন্ত্র পুরনো বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দলগুলোতে গণতন্ত্রের চর্চা না থাকা এবং দেশে স্বাভাবিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া না থাকার কারণেই কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত পরিবারতন্ত্র প্রকট আকার ধারণ করছে। শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার পর তার কন্যা স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের হাল ধরেন। একচেটিয়া শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগে আধিপত্য বিস্তার করে। বাংলাদেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপিতে দলটির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের পর তার স্ত্রী খালেদা জিয়া দলের হাল ধরেছিলেন। এরপর খালেদা জিয়ার ভাই বোনসহ আত্মীয়দের অনেকে মন্ত্রী ও এমপি হয়েছিলেন। এখন দলটির কর্তৃত্ব তার সন্তান তারেক রহমানের হাতে। জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর দলটির চেয়ারম্যান হিসেবে নিযুক্ত হন তার ছোটভাই জিএম কাদের। ছাত্র-জনতার নতুন দল হিসেবে স্বৈরশাসক হটিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে যোগ হয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি। নতুন পার্টিতে তরুণপ্রজন্ম অগ্রাধিকার পেয়েছে, সেজন্য এখানে পরিবারতন্ত্রের ছোঁয়া লাগেনি।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বর্তমানে বাংলাদেশে রাজনৈতিক শূন্যতা চলছে। সেক্ষেত্রে যদি নতুন দল নতুন ধারার রাজনীতির সাথে বাংলাদেশের মানুষের পরিচয় করাতে পারে, তাহলে তারা মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেলেও পারে। কারণ এই ধরনের দলের চাহিদা আছে সমাজে।

বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ঘটনা নিয়ে ইতিহাস নিয়ে লিখেছেন মহিউদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, যখন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি টালমাটাল থাকে, তখন এই ধরনের নতুন দলের জন্ম হয়। ১৯৪৯ সালে যখন মুসলিম থেকে আলাদা হয়ে আওয়ামী লীগ তাদের যাত্রা শুরু করে, তখন সেটি তরুণদের নেতৃত্বেই হয়েছিল। যদিও মওলানা ভাসানী ছিলেন ছায়ার মতো। খন্দকার মোশতাক, শেখ মুজিব, তাজউদ্দীন এরা সব ২৫-৩০ বছর বয়সী ছিল তখন। তারা ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে গিয়ে মুসলিম লীগের বিক্ষুব্ধ কর্মীরা দলটি করেছিলেন। সংকট বা পালাবদলের সময় শূন্যতা তৈরি হয়।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান হলো। মুসলিম লীগ সরকার গঠন করল। বিরোধী দল বলতে কিছু ছিল না। সেই শূন্যতা পূরণ করে আওয়ামী লীগ। তারা বিরোধী দল হয়েছিল। ২৩ থেকে ২৪ বছর পর তারা সরকার গঠন করতে পেরেছিল। ১৯৭২ সালে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তরুণরা জাসদ করা হয়। ১৯৭২ সালেও শূন্যতা ছিল। তখন ক্ষমতাসীনের বাইরে কোনও বিরোধী দল ছিল না। বিরোধী দল যারা হতে পারতো, তারা আওয়ামী লীগের সাথে একটি কোলাবোরেট করেছিল। সেই শূন্যতা পূরণ করার চেষ্টা করে জাসদ। সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ ও জাসদের যাত্রা শুরুর মাঝে এক ধরনের মিল পাওয়া যায়।

জুলাই অভ্যুত্থানের পর তরুণরা বলল যে, আমরা উদ্যোগ নেবো, এটি গণবিদ্রোহের ফলাফল উল্লেখ করে মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ওই দুই দলের সাথে এই নতুন দলের একটি পার্থক্যের কথা বলেন। যদিও তারা (ছাত্ররা) এই সরকারেরই অংশ। কারণ তাদের আন্দোলনের ফলেই এই সরকার এসেছে। সেক্ষেত্রে তাদের এই পদক্ষেপ (আওয়ামী লীগ ও জাসদের মতো) এই সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ না। তাদের এই বিদ্রোহ বিগত সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। জুলাই আন্দোলনের স্পিরিট থেকে তারা নতুন দল গঠন করেছে।

এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মামুন আল মোস্তফা বলছেন, পার্টির প্রতি আনুগত্যের প্রশ্নে বড় দলগুলো তাদের সাবেক নেতাদের ছেলেমেয়েদের প্রতি বেশি ভরসা করছে বলেই সর্বস্তরে পরিবারতন্ত্রের বিকাশ ঘটছে।

আলোকিত বাংলাদেশ
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত