বইপুস্তক খাতাপত্রের মূল উপাদান কাগজ। আমাদের দেশে কাগজ উৎপাদনের প্রধান কারখানা কাপ্তাই কর্ণফুলি পেপার মিল। পার্বত্য চট্টগ্রামের বণ-জঙ্গলের যত প্রকার বাঁশ, উদ্ভিদ ঝোপঝাড় কেটে পেপার মিলে একদিকে ঢেলে দিলে অপর দিকে কাগজ হয়ে বেরিয়ে আসে। সেই কাগজ কেপিএম বইখাতা মুদ্রণ কাজে ব্যবহার হয়, সমাজ, সাহিত্য ও সভ্যতার লালনকারীর ভূমিকা পালন করে।
ক্যাডেট স্কুল ও কলেজগুলোতে সাধারণ ছাত্রদের কোনোমতে ভর্তি করাতে পারলেই হলো, নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে আর্মি অফিসার হয়ে তারা দেশ রক্ষার, দেশ সেবার যোগ্যতা অর্জন করে। নবী রাসুল মহাপুরুষগণ দুনিয়াতে এসেছেন মানুষ তৈরির জন্য। মানুষ ও অমানুষ নামে দুটি শব্দ আমাদের সমাজে চালু আছে। অমানুষ যারা তারা জন্তু জানোয়ারের চেয়েও অধম। এই ঘোষণা পবিত্র কুরআনের। আর যারা সত্যিকার মানুষ, মানবীয় গুণ ও বৈশিষ্ট্যের বিকাশ যাদের জীবনে হয়েছে, তারাই মানুষ। এই বিকাশ যতখানি হয়েছে সেই অনুপাতে তারা তত বড় মানুষ।
আমরা বুুঝলাম, শিক্ষিত জনশক্তি গড়ে তোলার প্রতিষ্ঠান স্কুল মাদ্রাসা, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়। বাঁশঝাড় গাছগাছালিকে কাগজে র?পান্তর করার যন্ত্র কর্ণফুলি পেপার মিল। কিন্তু নবী রাসুল মহাপুরুষগণ সত্যিকার মানুষ বানান বলে যে কথা বলা হয় সেই প্রতিষ্ঠান বা কারখানা কোনটি। এই প্রশে?র জবাব সহজে এভাবে পাওয়া যায়।
নবী রাসুলগণ কোনো সুনির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা বিশেষ ধরনের উৎপাদন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেননি; খাঁটি মানুষ তৈরির জন্য তারা যে ব্যবস্থাপনা দিয়েছেন তাকে কর্মসূচি কর্মশালা হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। এর মধ্যে কিছু আছে বিশ্বাস, কিছু আনুষ্ঠানিকতা আর কিছু আচার ব্যবহার। সুনির্দিষ্ট সাতটি বিশ্বাসকে যখন নিজের মনে মগজে লালন করা হয়, তখন মানুষ চিন্তার দিক থেকে পরিপক্ক এবং আত্মবিশ্বাসে বলিয়ান হয়। আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি বিশ্বাস তার মধ্যে সৃষ্টি করে পরম আত্মবিশ্বাস। যে কোনো মানুষের জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে হলে প্রথম কাজ আত্মবিশ্বাসে বলিয়ান হওয়া। যে মানুষ যথখানি আত্মবিশ্বাসী সে জীবনে ততবেশি প্রতিষ্ঠিত। বিশ্বাসের পরে আছে সেই বিশ্বাস অনুযায়ী জীবন গড়ার কর্মসূচি ও আনুষ্ঠানিকতা। যেমন দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত। কোনো সমাজের লোকেরা যখন দেহ মনের পবিত্রতা নিয়ে দৈনিক পাঁচবার আল্লাহর সামনে নিজেকে সমর্পণ করে আর সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সাথে মিলেমিশে থাকার, সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধের দায়িত্ব চেতনা অনুভব করে তখন সেই মানুষ ও সেই সমাজ সুন্দর না হয়ে পারে না।
মানুষ জড়পদার্থ নয় যে, পেপার মিলে বাঁশঝাড় ঢুকিয়ে দিলে কাগজ হয়ে বেরিয়ে আসবে। স্কুলে ভর্তি হলেই কেউ শিক্ষিত হয়ে বের হয় না, শিক্ষিত হওয়ার জন্য সবচে বড় প্রয়োজন শিক্ষার্থীর মনযোগ, সজাগ সচেতন সাধনা। ইসলামের আনুষ্ঠানিক ইবাদতসমূহের সুফল লাভের জন্যও প্রথম প্রয়োজন বিশুদ্ধ ইচ্ছাশক্তি, সচেতন অনুভূতি এবং সে অনুযায়ী শারীরিক কসরত। ধর্মীয় পরিভাষায় এর নাম নিয়ত ও ইখলাস। কুরআন মজিদে বলা হয়েছে ‘নিশ্চয়ই নামাজ অন্যায় অসুন্দর ও অশ্লীলতা থেকে বারণ করে।’ (সূরা আনকাবুত, আয়াত-৪৫) সত্যিই কোনো সমাজে যখন নামাজ কায়েম হয় সে সমাজের সর্বত্র তখন সুন্দর ও পবিত্রতার ফল্গুধারা প্রবাহিত হয়। নামাজ তো দৈনন্দিন কর্মসূচি। বছরে একবার মাসব্যাপী মানুষ গড়ার কর্মশালার নাম রমজানের রোজা। যে কেউ ঈমান, দৃঢ় বিশ্বাস ও আত্মসচেতনতা সহকারে রমজানে একমাসব্যাপী রোজা পালন করে, তার অতীতের গোনাহখাতা আল্লাহর পক্ষ হতে ক্ষমা করে দেয়া হয়। তার মানে লোকটি আদর্শ মানুষ হিসেবে জীবনযাপন করার যোগ্যতা অর্জন করে। নিজেকে মানবীয় গুণাবলী ও চরিত্রে সজ্জিত করে। মাহে রমজানে পালনীয় প্রত্যেক ইবাদতের অনুষ্ঠানিকতা নিয়ে চিন্তা করলে এই তত্ত্ব ও তথ্যের স্বাক্ষাত পাওয়া যাবে।
আজ পবিত্র মাহে রমজানের প্রথম দিনে আমরা এই প্রশিক্ষণ কর্মসূচিকে স্বাগত জানাই। আমাদের নিয়ত ও ঈমানকে মজবুত করি, আত্মবিশ্বাসে বলিয়ান হই, আত্মবিশ্বাসের বেলাভূমিতে দাঁড়িয়ে নিয়তকে বিশুদ্ধ করি, পুরো রমজানে কী কী ভালো কাজ করতে পারব, তার একট তালিকা তৈরি করি। লাভ হবে নিয়তের সাথে সাথে আমার নামে ওই কাজটি সওয়াব বরাদ্দ হয়ে যাবে। হাদিস শরিফে বর্ণিত, ‘যে ব্যক্তি কোনো সৎ কাজের নিয়ত করল। বিনিময়ে তাকে একটি সওয়াব দেয়া হবে, যদি কাজটি বাস্তবে র?প দেয় তাহলে কমপক্ষে দশ গুণ সওয়াব দেয়া হবে। অবশ্য রমজানে এই হিসাব গাণিতিক নয়, জ্যামিতিক। রমজানে একটি ভালো ও সুন্দর কাজের জন্য সওয়াব দেয়া হবে কমপক্ষে ৭০ গুণ। আমাদের প্রত্যেকের উচিত মন থেকে রমজানকে স্বাগত জানানো।’ এক মাসের সাধনার মেয়াদে হৃদয়-মনকে সদা জাগ্রত রাখা। নানা জাতের খাদ্য আমাদের দেহের ও পেটের খোরাক, আর রুহের খোরাক হলো আল্লাহর যিকির ও স্মরণ। কুরআনের ভাষায়, ‘সাবধান! আল্লাহর জিকির ও স্মরণ দ্বারাই অন্তরসমূহ প্রশান্তি লাভ করে।’ -(সুরা রাআদ, আয়াত-২৮)