ঢাকা শনিবার, ২১ জুন ২০২৫, ৭ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

রহমতের পরশে ভরে উঠুক মন ও জীবন

রহমতের পরশে ভরে উঠুক মন ও জীবন

নেয়ামত বিদেশি আরবি শব্দ, ছোটবেলায় তা জানতাম না। বড় হয়েও দেখি এর সঠিক বাংলা প্রতিশব্দ নেই। আমাদের ছোটবেলা কেটেছে গ্রামে, মাটি ও মানুষের কাছে। বড় বৈয়ামে করে রসগোল্লার ফেরিওয়ালা ছিল আমাদের প্রিয়লোক। একটা চিমটি দিয়ে আমাদের ডান হাতের তালুতে রাখত একটি রসাল মিষ্টি। মুখে দিতেই দিল মন শান্তি, দুনিয়ার সবচেয়ে বড় নেয়ামতপ্রাপ্তি। হ্যাঁ, ছোটবেলায় নেয়ামতের অর্থ ছিল এই রসের গোল্লা।

একটু বড় হয়ে নেয়ামতের আরেকটি অর্থ আলো ছড়াল মনের দর্পণে। পরীক্ষায় বৃত্তি পাওয়ার পর অভাবনীয় অবর্ণনীয় আনন্দে ভরে গেল মন, উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্নরেখা উঁকি দেয় এখন। এর চেয়ে বড় নেয়ামত আর কি হতে পারে। পরীক্ষার এমন ফলাফল আমি ভাবিনি, এ ছিল আল্লাহর খাস রহমত। রহমত নেয়ামত বরকত প্রভৃতি পরিভাষার বাংলা প্রতিশব্দ এখনো আমার অজানা। মনে করি, অবারিত দয়া, অনুগ্রহ ও শান্তির পরশ বুঝায় আল্লাহর রহমত।

হাদিস শরিফে বলা হয়েছে ‘আউয়ালুহু রাহমাতুন’। রমজান মাসের প্রথম ভাগ হচ্ছে রহমত। এই রহমতের তাৎপর্য উদ্ঘাটন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।

গ্রীষ্মের তাপদাহে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। গরমের প্রচণ্ডতায় খালবিল চৌচির হয়ে যায়। গোটা প্রকৃতি হাঁসফাঁস করে অস্থিরতায়। ইউরোপীয় কোনো কোনো দেশে বনভূমিতে আগুন লেগে যায়। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর যখন এক পশলা বৃষ্টি নামে, তখনই বোঝা যায় আল্লাহর রহমতের বরিষণ শুরু হয়েছে তাপদগ্ধ পৃথিবীতে।

বর্ষায় রহমতের বৃষ্টির স্নিগ্ধ পরশ মানব দেহ ও বস্তুজগতে শান্তির পরশ বুলায়; তবে রমজানে আল্লাহর খাস রহমতের ছোঁয়া লাগে মনে ও জীবনে। সেই ছোঁয়ায় জেগে ওঠে সমাজে নতুন জাগরণ। এই জাগরণ ঈমানের। আধ্যাত্মিক অবর্ণনীয় শিহরণ জাগে প্রতিটি মুমিনের হৃদয়তন্ত্রীতে। তার প্রমাণ আমরা দেখতে পাই। রমজানের চাঁদ উদিত হওয়ার পরপর মসজিদসমূহ ভরে যায় মুসল্লির সমাগমে। এক অনির্বচনীয় প্রেরণায় জেগে ওঠে ঈমানদারের মন। এতদিন নামাজ কালামের প্রতি যাদের অবহেলা ছিল রমজানের আগমনে তাদের অবহেলা অলসতাও পালিয়ে যায়। আগে একটু বেশি নামাজে সময় ব্যয় করা কষ্টকর মনে হতো। এখন নিয়মিত নামাজ কালাম ছাড়াও রাতের বেলা দীর্ঘ দেড় দুই ঘণ্টা দাঁড়িয়ে তারাবিহ নামাজ পড়ে। পুরো একমাসে ত্রিশ পারা কুরআন তেলাওয়াত শ্রবণ করে নামাজে হাফেজ সাহেবের কণ্ঠের সাথে মনের সংযোগ নিবদ্ধ করে। তারাবিহ নামাজের পর বিছানায় যেতে না যেতে শেষরাতে মনের কানে ডাক আসে ঊর্ধ্বজগত হতে, কেউ কি আছ আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থন করার, আমি তাকে ক্ষমা করে দেব। কেউ কি আছ রিজিক প্রার্থনা করার আমি তাকে রিজিক দান করব। কেউ কি আছ আমার কাছে কিছু চাওয়ার আমি তাকে দান করব। রাতের শেষ প্রহর পর্যন্ত আল্লাহ ডাক দিয়ে যান আপন রহমত বিলানোর জন্য। যারা সেই ডাক শোনে তারা আরামের বিছানা ছেড়ে দাঁড়িয়ে যান তাহাজ্জুদের জায়নামাজে। আবার পরের দিনের রোজা পালনের প্রস্তুতি পর্বে আল্লাহর মেহমান হিসেবে আহার গ্রহণ করে সাহরি।

রমজানে আল্লাহর রহমত নাজিলের ধারণাটি বুঝলাম। এখন প্রশ্ন কীভাবে সে রহমত আমি লাভ করতে পারব। বর্ষাকালের ঝুম বৃষ্টির পানি ধারণ করতে পারে পুকুর, কুয়া বা আলবাধা জমি কিংবা কলসি বা পাত্র। সটান পাথরের উপর মুষলধারে বৃষ্টি নামলেও পানি থাকবে না, গড়িয়ে যাবে, শুকিয়ে যাবে। আল্লাহর রহমত লাভ করার জন্যও আমাদের সেই প্রস্তুতি থাকতে হবে। মনের জমিনকে প্রস্তুত করতে হবে। হৃদয়ের পাত্রটি ঊর্ধ্ব আকাশপানে উন্মুখ করে রাখতে হবে। তবেই রমজানের বা অন্য যে কোনো সময়ের রহমতের বরিষণে মন ও জীবন সিক্ত করতে পারব।

মনের জমিন প্রস্তুত কিংবা হৃদয়ের পাত্রখানি উন্মুখ করে রাখার অর্থ কী। অর্থ হলো, আপনি জমিতে ফসল বুনতে চান , প্রথম প্রয়োজন জমিন পরিষ্কার করা, নিড়ানি দিয়ে আগাছা ঝোপঝাড় সাফ করা। একই সাথে চাষ ও সেচের ব্যবস্থা করা। ধর্মীয় পরিভাষায় এর নাম তাওবা। মানুষ যখন কোনো পাপকাজ করে একটি কালচে দাগ বসে যায় মনের আয়নায়। আরো যত গুনাহ করে মনের আয়নার কালো দাগ তত গাঢ় হয়, অমোচনীয় হয়ে যায়। সেই দাগ দূর করতে হলে পানি ও সাবান লাগে। মনের কালো দাগ পরিষ্কার করতে হলে প্রয়োজন চোখের পানি আর তাওবার সাবান। রমজান সেই সুযোগ এনে দেয় মানুষের দোরগোড়ায়।

মওলানা রূমী বলেন, মরুভূমিতে কোথাও সবুজ বীথিকা যদি নজর কাড়ে। কাছে গিয়ে দেখবে সেখানে ঝিরঝিরে একটি ঝর্ণা। ঝর্ণার পরশে প্রাণের স্পন্দন সবুজের শিহরণ জেগেছে। যদি চাও রহমতের সবুজ বিথিকায় হেসে ওঠুক তোমার জীবন, তাহলে তোমাকে কান্নার প্র¯্র্রবণ জারি করতে হবে। যদি বল কান্না তো আসে না। চোখের পানি তো বড় দুর্লভ। তাহলে সমাজে যারা কান্নারত তাদের প্রতি দয়া দেখাও, চোখের অশ্রুর অকাল ঘুচাতে হলে সদা অশ্রুসিক্তদের মাথায় হাত বুলাও। পৃথিবীতে যারা আছে তাদের প্রতি দয়া দেখাও, তাহলে যিনি আসমানে আছেন তিনি তোমাদের প্রতি দয়াপরবশ হবেন। (আবু দাউদ, তিরমিজি)

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত