ঢাকা শনিবার, ১৫ মার্চ ২০২৫, ১ চৈত্র ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ঈমান ও ভালোবাসার কষ্টিপাথর

ঈমান ও ভালোবাসার কষ্টিপাথর

কারো অন্তরে যদি মহান আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসে ঘাটতি থাকে, অদৃশ্য বিষয়াদির প্রতি সন্দেহ থাকে তাহলে সে কোনো দিনও রোজা রাখতে পারবে না, সারাদিন ক্ষুধা তৃঞ্চার কষ্ট সহ্য করা তার পক্ষে সম্ভব হবে না। সামাজিকতা রক্ষার জন্য বাইরে রোজার হাবভাব দেখালেও গোপনে পানাহার করবেই। কাজেই বলা যায়, রোজা আমাদের ঈমানের চরম পরীক্ষা এবং যারা রোজা রাখেন, তারা ধরে নিতে পারেন যে, আল্লাহর প্রতি ঈমান ও ভালোবাসার পরীক্ষায় তিনি পাস করেছেন। আলহামদুলিল্লাহ।

রোজা ছাড়া অন্যান্য ইবাদত সামাজিকতা রক্ষার খাতিরে, কিংবা লোক দেখানোর জন্য করার সুযোগ আছে। কিন্তু একটানা একমাস রোজা পালন একমাত্র আল্লাহর ভয় ও ভালোবাসার আকর্ষণ ছাড়া সম্ভব নয়। রোজার এই আবেদন ও বৈশিষ্ট্য বর্ণিত হয়েছে হাদিসে কুদসির এক ভাষ্যে। আল্লাহতায়ালা বলেন, রোজা আমার জন্য, আর আমিই তার প্রতিদান দেব। শেষের বাক্যটির অনুবাদ এভাবেও করা হয়েছে, আমি নিজেই রোজার প্রতিদান হব। সে আমার কারণে পানাহার ও কামনা বাসনার আকর্ষণ ত্যাগ করে।’ ‘আমি নিজেই রোজার প্রতিদান হব’ কথাটি অনেক গভীর ও তাৎপর্যপূর্ণ। আধ্যাত্মিকতার সুউচ্চ মার্গের প্রতিচ্ছবি এখানে পাওয়া যায়। অর্থাৎ আল্লাহতায়ালা বলেন, আমি আমার রোজাদার বান্দার হয়ে যাই। তাকে একান্তভাবেই ভালোবাসি।

হাদিসের এসব ভাষ্য সামনে রাখলে বলতে হবে, রোজা ঈমানের কষ্টিপাথর। কষ্টিপাথর দিয়ে স্বর্ণ খাঁটি না ভেজাল পরীক্ষা করা যায়। রোজা দিয়েও লোকটি ঈমানে আমলে খাঁটি কি না, তা নির্ণয় করা সহজ।

‘হাদিস শরিফের অপর এক বর্ণনা হতে রোজার এই গুরুত্ব প্রতীয়মান হয়। ‘কেয়ামতের দিন রোজা ও কোরআন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। ইন্টারনেটের জালে আজকে সারা দুনিয়া বন্দি। নেট ছাড়া কোনো কাজ চলে না। কিন্তু নেট আমরা দেখি না, কম্পিউটারে মোবাইলে নেট নিয়ে কাজ করি বটে, কিন্তু আমরা নেট দেখি না। নেটের কথা চিন্তা করলে মনে হয়, শৈশবে বুড়োদের মুখে শোনা পাতালপুরের রাজকন্যার কল্পকাহিনি। নেটকে রূপকথা মনে হলেও এর বাস্তবতা অনস্বীকার্র্য। আজকের দুনিয়ায় নেটের উপরই প্রতিষ্ঠিত আছে যোগাযোগব্যবস্থা।

আখেরাতে রোজা ও কোরআন বাস্তব অবয়ব ধারণের বিষয়টিও এরূপ। পরকালে বিচারের আদালত বসবে। স্বয়ং আল্লাহতায়ালা হবেন একমাত্র বিচারপতি। অপরাধীদের হাজির করা হবে আদালতের কাঠগড়ায়। একজন বিবাদীর অপরাধ সাব্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। তার পাশে গিয়ে দাঁড়াবেন দুজন লোক। এরা দুনিয়াতে অমূর্ত ছিল, অবয়ব ছিল না। নেট দুনিয়ার মতো লোক চক্ষুর অন্তরালে ছিল। পরকালীন জগতে বাস্তবরূপ ধারণ করে হাজির হয়েছে দুই সাক্ষীরূপে। এক, রোজা দুই, কোরআন। রোজা দাঁড়িয়ে আর্জি পেশ করবে। হে আমার রব! আমার একটি ফরিয়াদ, তোমার এই বান্দা, কাঠগড়ার আসামি। দুনিয়াতে থাকতে আমি দিনের বেলা তাকে পানাহার ও যৌনসংসর্গ হতে বিরত রেখেছি। তোমার আদেশ পালন করতে গিয়ে দিনের বেলা সে পানাহার বর্জন করেছে, উপোস ছিল। সে আজ আসামীর কাঠগড়ায়।

আমি তোমার দরবারে তার দায়মুক্তির জন্য সুপারিশ করছি। সাথে সাথে আরেক ব্যক্তি দাঁড়াবে, তার মুখেও একই আর্জি। প্রভুহে! আমি রাতের বেলা তার চোখের ঘুম কেড়ে নিয়েছিলাম। রাত জেগে সে আমার তেলাওয়াত করেছে, তারাবিতে খতমে কোরআন পড়েছে, তোমার ভয়ে ও ভালোবাসায় সে রাত্রি জাগরণ করেছে। আমি তার সাক্ষী। তার দায়মুক্তির ব্যাপারে আমার সুপারিশ তুমি কবুল কর। হাদিস শরিফের সুসংবাদটি এরূপ : ‘ফায়ুশাফফাআন’ অতপর উভয়ের সুপারিশ গ্রহণ করা হবে। বান্দা মুক্তি পেয়ে যাবে।

মাহে রমজানে রোজার এমন বিস্ময়কর ফযিলত লাভ করতে হলে নিশ্চয় কিছু শর্ত মানা প্রয়োজন। তার মধ্যে সবচে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, রোজাদারকে সবসময় আল্লাহর ধ্যানে ও স্মরণে থাকতে হবে। এই ধ্যান ও স্মরণ যত নিখাদ ও তাৎপর্যপূর্ণ হবে, রোজার প্রতিদানও তত উন্নত হবে। এমন উন্নত যে, অন্যান্য ইবাদতের সওয়াব ফেরেশতাদের মাধ্যমে বণ্টন করা হলেও রোজার প্রতিদান দেবেন আল্লাহ নিজের হাতে। আল্লাহপাক বলেন, অতএব, আমার বান্দার উচিত, যখন রোজার দিন আসবে, রমজানের রোজা রাখবে, যখন মেজাজ তিরিক্কি হয়ে যাবে, তখন যেন নিজেকে সংযত রাখে। কারো সাথে ঝগড়া করবে না, অশ্লীল বাক্যব্যয় করবে না। অন্যায় আচরণ করবে না।

একটি প্রশ্ন জাগে, আমি হয়তো সংযমি আচরণ করলাম। কিন্তু যদি প্রতিপক্ষ আমার ভদ্রতার সুযোগ নেয়। কেউ যদি আমাকে গালমন্দ করে, কিংবা আমার সাথে গায়ে পড়ে ঝগড়া বাধায়। তাহলে কি আমাকে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে হবে। তার অন্যায়ের জবাব প্রতিবাদ কী আমি করতে পারব না। এই অনুচ্চারিত প্রশ্নের জবাব নয়, সমাধান দিয়েছেন স্বয়ং নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। বলেছেন, এহেন পরিস্থিতিতে তোমার কর্তব্য হলো, ঝগড়া করতে আসা লোকটিকে বলে দেবে, ভাই আমি রোজা রেখেছি। আমি তোমার ঝগড়ার জবাব দিতে পারব না।’

বস্তুত আল্লাহর ভয়, ভালোবাসা, সংযম ও ধৈর্র্যের প্রশিক্ষণ এবং মাসব্যাপী সাধনায় মানবীয় গুণাবলি নিজের স্বভাবগত ও মজ্জাগত করে নেয়ার সাধনার মাস রমজান। রমজানের বেহেশতি রঙে রঙিন হোক আমাদের জীবন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত