জম্মু ও কাশ্মীরের পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর বন্দুকধারীদের হামলায় ২৮ জন নিহতের ঘটনায় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। দুই দেশই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ভূখণ্ড কাশ্মীর নিয়ে ইতিপূর্বে তিনবার যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। একই ইস্যুতে তারা বেশ কয়েকবার যুদ্ধের কাছাকাছি অবস্থানে গিয়েছে। এবার নতুন করে আবারও দেশ দুটি যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। পারমানবিক শক্তিধর ভারত ও পাকিস্তানের শীর্ষ ব্যক্তিদের মধ্যেই এরইমধ্যে বাকযুদ্ধ শুরু হয়েছে। তারা একে অপরকে দোষারোপ করছেন। হামলার জন্য পাকিস্তানকে দোষারোপ করে এরইমধ্যে বেশ কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে ভারত। দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রতিশোধের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। পাকিস্তানের সঙ্গে সবচেয়ে বড় সীমান্ত ক্রসিং বন্ধ, সিন্ধু নদ পানিবণ্টন চুক্তি স্থগিত এবং পাকিস্তানিদের জন্য সবধরনের ভিসা সেবা স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছে ভারত। পাল্টা পদক্ষেপ নিয়েছে ইসলামাবাদও। ভারতের সঙ্গে ওয়াঘাহ সীমান্ত ক্রসিং বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে পাকিস্তান। এই ক্রসিং দিয়ে ভারত থেকে কোনো পণ্য পাকিস্তানে যাবে না এবং আসবেও না। এছাড়া ভারতের সঙ্গে থাকা সিমলা চুক্তিও বাতিলের ঘোষণা দিয়েছে পাকিস্তান। এই উত্তেজনার মধ্যেই গতকাল বৃহস্পতিবার মিসাইল ধ্বংসের পরীক্ষা চালিয়েছে ভারতীয় নৌবাহিনী। জবাবে পাকিস্তানও ভূমি থেকে ভূমিতে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালানোর ঘোষণা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক লেখক ও দক্ষিণ এশিয়া বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, ‘এটি অঞ্চলটির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সময়। আমরা দেখছি, দুই পরমাণু শক্তিধর প্রতিবেশী এখন একে অপরের দিকে আক্রমণাত্মক চোখে তাকিয়ে আছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কাশ্মীরের ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ ইতিহাস বিবেচনা করলে দেখা যাবে, ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশই এর ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ দাবি করেছে। তবে উভয়ে আলাদাভাবে কাশ্মীরের দুই অংশ শাসন করে। সর্বশেষ হামলায় ভারতের জবাব কেমন হবে, তা নির্ভর করবে অনেকটাই অভ্যন্তরীণ চাপের উপরে।
এরই মধ্যে দিল্লি ত্বরিতগতিতে প্রতিশোধমূলক একগুচ্ছ পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে আছে পাকিস্তানের সঙ্গে প্রধান সীমান্ত ক্রসিং বন্ধ ও গুরুত্বপূর্ণ পানি ভাগাভাগির চুক্তি স্থগিত করা ও কূটনীতিকদের বহিষ্কার।
বিশ্লেষকদের মতে, ভারত সামরিক প্রতিক্রিয়া দেখাবে কি না, সেটি প্রশ্ন নয়; বরং প্রশ্ন হলো, কবে ও কীভাবে এটি হবে এবং এর মূল্য কতটা হতে পারে। ঘটনার পরই অপরাধীদের ধরতে কাশ্মীর উপত্যকার উধমপুর জেলায় ভারতের সেনাবাহিনী ও পুলিশ যৌথভাবে অভিযান চালিয়েছে। এসময় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ভারতের সেনাবাহিনীর এক সদস্য নিহত হয়েছেন। এনডিটিভির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেনাবাহিনী ও পুলিশ যৌথভাবে এই এলাকায় অভিযান চালাচ্ছিলেন, কারণ গোয়েন্দা তথ্যে সেখানে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উপস্থিতি ছিল বলে জানানো হয়েছিল। অভিযানের সময় দুদু-বাসন্তগড় এলাকায় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধ লড়াই শুরু হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনীর হোয়াইট নাইট কর্পস জম্মু অঞ্চলে নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম এক্সে (সাবেক টুইটার) তারা জানায়: ?‘বিশেষ গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে জম্মু-কাশ্মীর পুলিশের সঙ্গে যৌথভাবে উধমপুরের বাসন্তগড়ে অভিযান চালানো হয়। সেখানে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মুখোমুখি হওয়ার পর প্রচণ্ড গোলাগুলি শুরু হয়। সংঘর্ষের শুরুতেই আমাদের এক সাহসী জওয়ান গুরুতর আহত হন এবং চিকিৎসার সব চেষ্টা সত্ত্বেও শেষপর্যন্ত নিহত হন।’
ভারতীয় সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এখনও সেখানে অভিযান চলছে এবং পুরো এলাকা ঘিরে তল্লাশি চালানো হচ্ছে। তবে এই হামলায় নিহতদের মধ্যে এক নৌবাহিনীর অফিসার, এক বিমান বাহিনীর কর্মী এবং এক গোয়েন্দা ব্যুরোর কর্মকর্তা ছিলেন।
পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার জেরে হাজারের বেশি স্থানীয় বাসিন্দাকে আটক করেছে ভারতীয় পুলিশ। বিবিসি জানিয়েছে, পুরো কাশ্মীরজুড়ে এই আটক অভিযান চালানো হয়েছে। পুলিশ সূত্রে আরও বলা হয়েছে, হামলায় জড়িত ছিল চারজন সন্ত্রাসী, যাদের মধ্যে ভারতীয়দের পাশাপাশি বিদেশি নাগরিক রয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। ভারত-শাসিত কাশ্মীরের অনন্তনাগ জেলার পুলিশ পেহেলগাম হামলায় সন্দেহভাজন তিনজন বন্দুকধারীর নাম উল্লেখ করে একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। তাদের মধ্যে দুজন পাকিস্তানের নাগরিক এবং একজন অনন্তনাগের স্থানীয় বাসিন্দা বলে বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে। চতুর্থ সন্দেহভাজন সম্পর্কে এখনও কোনো তথ্য প্রকাশ করা হয়নি। পুলিশ জানায়, এদের সবাই পাকিস্তানভিত্তিক সন্ত্রাসী সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বার সদস্য। তবে অভিযুক্তদের পক্ষ থেকে এখনও এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। পাকিস্তান এই হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছে। এই তিনজনের প্রত্যেকের সন্ধানদাতাকে ২০ লাখ রুপি পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে ভারতীয় পুলিশ। একই সঙ্গে তথ্যদাতার পরিচয় গোপন রাখার আশ্বাসও দেওয়া হয়েছে। অপরাধীদের খুঁজে বের করে কঠোর শাস্তি দেয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনি বলেছেন, ‘ভারত প্রতিটি সন্ত্রাসী এবং তাদের সমর্থকদের চিহ্নিত করবে, তাদের খুঁজে বের করবে এবং শাস্তি দেবে।’ গতকাল বিহারের মধুবনীতে একটি সরকারি অনুষ্ঠানে পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলায় নিহতদের প্রতি নীরব শ্রদ্ধা জানিয়ে দেয়া ভাষণে নরেন্দ্র মোদি বলেন, পেহেলগামে সন্ত্রাসীরা যে নির্মমভাবে নিরীহ পর্যটকদের হত্যা করেছে, তাতে পুরো দেশ বেদনার্ত। পুরো দেশ শোকাহত পরিবারের সঙ্গে আছে। সরকার আহতদের সুস্থতা নিশ্চিত করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করছে। কেউ ছেলে হারিয়েছে, কেউ ভাই হারিয়েছে, কেউ জীবনসঙ্গী হারিয়েছে। কেউ বাংলায় কথা বলেছে, কেউ কন্নড় ভাষায় কথা বলেছে, কেউ মারাঠি, কেউ ওড়িয়ায় কথা বলেছে, কেউ গুজরাটি ভাষায় কথা বলেছে এবং কেউ বিহারের ছেলে।’ তিনি বলেন, ‘কারগিল থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত শোক ও ক্ষোভ বিরাজ করছে। এই আক্রমণ কেবল নিরীহ পর্যটকদের ওপর নয়, দেশের শত্রুরা ভারতের আত্মাকে আক্রমণ করার সাহস দেখিয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘যেসব সন্ত্রাসবাদীরা এই হামলা চালিয়েছে এবং যারা এর পরিকল্পনা করেছে তারা এমন শাস্তি পাবে যা তারা কল্পনাও করতে পারবে না। সন্ত্রাসের আশ্রয়স্থলের যা কিছু অবশিষ্ট আছে তা ধ্বংস করার সময় এসেছে। ১৪০ কোটি মানুষের ইচ্ছা সন্ত্রাসের কোমর ভেঙে দেবে।’ ভারতের প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমি সমগ্র বিশ্বকে বলছি। ভারত প্রতিটি সন্ত্রাসী এবং তাদের সমর্থকদের চিহ্নিত করবে, তাদের খুঁজে বের করবে এবং শাস্তি দেবে। আমরা পৃথিবীর শেষ প্রান্ত পর্যন্ত তাদের তাড়া করব। সন্ত্রাসবাদের মাধ্যমে কখনও ভারতের চেতনা ভাঙা যাবে না। সন্ত্রাসবাদের শাস্তি হবে। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করা হবে। সমগ্র জাতি এই সংকল্পে দৃঢ়। মানবতায় বিশ্বাসী প্রত্যেকেই আমাদের সঙ্গে আছে।’ শেষে তিনি বিশ্ববাসীকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘আমি বিভিন্ন দেশের জনগণ এবং তাদের নেতাদের ধন্যবাদ জানাই যারা এই সময়ে আমাদের সঙ্গে দাঁড়িয়েছেন।’
এদিকে পেহেলগমে হামলার পর গত বুধবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নেতৃত্বাধীন দেশটির মন্ত্রিসভার নিরাপত্তাবিষয়ক কমিটির জরুরি বৈঠকে প্রচ্ছন্নভাবে পাকিস্তানকে দায়ী করে প্রতিবেশী দেশটির বিরুদ্ধে পাঁচটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সিদ্ধান্তগুলো হলো-
১. সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তি স্থগিত ঘোষণা। ভারত বলছে, পাকিস্তান যতদিন সীমান্তে সন্ত্রাস বন্ধ না করবে এবং সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন ত্যাগ না করবে ততদিন এটি স্থগিত থাকবে। ১৯৬০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর করাচিতে তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ও পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ূব খান সিন্ধু পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় বহুল আলোচিত এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল।
২. অবিলম্বে আটারি-ওয়াঘা সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়া হবে। যাদের বৈধ নথি রয়েছে তারা ১ মে এর আগে সীমান্ত অতিক্রম করতে পারবেন।
৩. সার্ক ভিসা এক্সেম্পশন স্কিম (এসভিইএস) এর আওতায় পাকিস্তানি নাগরিকদের ভারতে ভ্রমণের অনুমতি দেওয়া হবে না। পাকিস্তানি নাগরিকদের অতীতে জারি করা যে কোনো এসভিইএস ভিসা বাতিল বলে গণ্য হবে। এসভিইএস ভিসায় বর্তমানে ভারতে থাকা পাকিস্তানি নাগরিকদেরও ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ভারত ছাড়তে বলা হয়েছে।
৪. নয়াদিল্লিতে পাকিস্তানি হাইকমিশনের সামরিক, নৌ ও বিমান উপদেষ্টাদের ‘পার্সোনা নন গ্রাটা’ ঘোষণা করা হয়েছে। ভারত ছাড়ার জন্য এক সপ্তাহ সময় পাবেন তারা। ইসলামাবাদের ভারতীয় হাইকমিশন থেকে প্রতিরক্ষা, নৌ ও বিমান উপদেষ্টাদের প্রত্যাহার করে নিচ্ছে ভারত। সংশ্লিষ্ট হাইকমিশনের এই পদগুলো বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে। উভয় হাইকমিশন থেকে সার্ভিস অ্যাডভাইজারের পাঁচজন সাপোর্ট স্টাফকেও প্রত্যাহার করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
৫. হাইকমিশনের সামগ্রিক লোকবল ৫৫ থেকে কমিয়ে ৩০ জনে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। যা ১ মে এর মধ্যে কার্যকর হবে।
এর আগে ভারতীয় মেডিকেল ভিসাসহ পাকিস্তানি নাগরিকদের জন্য সব ধরনের ভিসা পরিষেবা স্থগিত করেছে ভারত।
ভারতের এসব ঘোষণাকে ‘শিশুসুলভ’ বলে আখ্যায়িত করেছে পাকিস্তান। পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার বলেছেন, আমরা বৈঠকে ভারতকে যোগ্য জবাব দেব, এই জবাব কম হবে না। সংবাদমাধ্যম বিবিসি বলছে, ভারতশাসিত কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার পর পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক সীমিত করার বিষয়ে ভারতের সিদ্ধান্ত নিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ইসহাক দার। পাকিস্তানের একটি বেসরকারি চ্যানেলে তিনি বলেছেন, ‘ভারতের ঘোষণাগুলো শিশুসুলভ এবং এতে গুরুত্বের অভাব রয়েছে।’
তিনি আরও বলেছেন, ‘ভারত প্রতিটি ঘটনার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে এবং অতীতের মতো এবারও পাকিস্তানকে দোষারোপ করার চেষ্টা করা হয়েছে। আমরা বৈঠকে ভারতকে যোগ্য জবাব দেব, এই জবাব কম হবে না।’ সিন্ধু পানি চুক্তি প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার বলেন, এই ইস্যুতে ভারতের সঙ্গে আমাদের দীর্ঘদিনের সমস্যা রয়েছে। ভারতের কাছে প্রমাণ থাকলে তা সামনে আনা উচিত।
পাকিস্তান এই হামলাকে ভারতের ‘ফলস ফ্ল্যাগ (ভধষংব ভষধম)’ অপারেশন বলে আখ্যা দিয়েছে। অর্থাৎ তারা দাবি করছে, ভারত নিজেরাই এই হামলা সাজিয়েছে যেন পাকিস্তানের ওপর দোষ চাপানো যায়। পাকিস্তান আরও জানিয়েছে, ভারতের কূটনৈতিক সিদ্ধান্তগুলোর ‘প্রত্যুত্তরমূলক জবাব’ দেওয়া হবে। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফও এই হামলাকে ‘ফলস ফ্ল্যাগ’ বলে উল্লেখ করেছেন এবং পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যমে তিনি বলেন, ‘এই সম্ভাবনাকে কখনওই পুরোপুরি অস্বীকার করা যায় না।’
ভারতের এসব সিদ্ধান্ত নিয়ে জরুরি বৈঠকে বসেছিল পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা কমিটি (এনএসসি)। আর এ বৈঠকের পর ভারতের বিরুদ্ধে পাল্টা পদক্ষেপ নিয়েছে ইসলামাবাদ। যার অংশ হিসেবে ভারতের সঙ্গে সিমলা চুক্তি বাতিল, ওয়াঘাহ সীমান্ত বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে ইসলামাবাদ। এগুলোর সঙ্গে নিজেদের আকাশে ভারতীয় মালিকানাধীন অথবা ভারত পরিচালিত সব বিমান প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে পাকিস্তান। এর পাশাপাশি ভারতের সঙ্গে সব ধরনের বাণিজ্যও বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশটি। তারা জানিয়েছে, পাকিস্তান হয়ে তৃতীয় কোনো দেশের পণ্যও ভারতে প্রবেশ অথবা বের হতে পারবে না।
এছাড়া সার্কের আওতাধীন বিশেষ ভিসা সুবিধাও বাতিল করেছে পাকিস্তান। যেসব ভারতীয়র কাছে এ ভিসা আছে তাদের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার নির্দেশও দিয়েছে ইসলামাবাদ। এরসঙ্গে পাকিস্তানের ভারতীয় দূতাবাসে থাকা ভারতীয় সামরিক উপদেষ্টাদের অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে। এবং ভারতীয় দূতাবাসের কর্মকর্তা ৩০ জনে নামিয়ে আনতে বলা হয়েছে। যা আগামী ৩০ এপ্রিল থেকে কার্যকর হবে।
এছাড়া ভারতের সঙ্গে থাকা সিমলা চুক্তিও বাতিলের ঘোষণা দিয়েছে পাকিস্তান। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ দিকে ভারত এ যুদ্ধে জড়িত হয়। ওই সময় দুই দেশের সেনাদের মধ্যে লড়াই হয়। যা বাংলাদেশের স্বাধীনতার মাধ্যমে শেষ হয়। এরপর ১৯৭২ সালে ভারত-পাকিস্তান সিমলা শান্তি চুক্তি করে। এই চুক্তির লক্ষ্য ছিল দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের একটি কাঠামো তৈরি, কাশ্মীর সংকটের সমাধান এবং ভবিষ্যতে যে কোনো ধরনের দ্বন্দ্ব শান্তিপূর্ণ উপায়ে মেটানো। এছাড়া চুক্তিতে যুদ্ধবন্দিদের মুক্তি এবং যোগাযোগের লাইন পুনঃস্থাপনের কথা বলা হয়েছিল।
ভারতের সিন্ধু নদের পানি চুক্তি বাতিলেরও তীব্র নিন্দা জানিয়েছে পাকিস্তান। ইসলামাবাদ বলেছে, নয়াদিল্লি সিন্ধু নদের পানি প্রবাহ ঠেকানোর চেষ্টা করলে পূর্ণশক্তি প্রয়োগ করে এর জবাব দেওয়া হবে। ভারত দাবি করেছে, এ হামলায় পাকিস্তানের একাধিক নাগরিক অংশ নিয়েছে। তবে পাকিস্তান হামলার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির জরুরি ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ, সেনাপ্রধান অসিম মুনিরসহ অন্যান্য সামরিক ও বেসামরিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা।
দুই দেশের উত্তেজনার মধ্যে বৃহস্পতিবার মিসাইল ধ্বংসের পরীক্ষা চালিয়েছে ভারতীয় নৌবাহিনী। মাইক্রো ব্লগিং সাইট এক্সে এক পোস্টে নৌবাহিনী জানিয়েছে, তাদের নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি মিসাইল বিধ্বংসকারী আইএনএস সুরাত সফলভাবে সামুদ্রিক অঞ্চলে একটি দ্রুত, নিচ দিয়ে উড়ে যাওয়া মিসাইল ধ্বংস করেছে। এর মাধ্যমে নিজেদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় আরেকটি মাইলস্টোন অর্জিত হয়েছে বলে দাবি করেছে তারা। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড জানিয়েছে, পাকিস্তানের নৌকর্মকর্তারা করাচি উপকূলে তাদের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে সারফেস টু সারফেস মিসাইলের পরীক্ষা চালাবে। যা ২৪ এপ্রিল থেকে ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত চলবে।
পেহেলগামে ‘পর্যটকদের’ অপর এই হামলার দায় স্বীকার করেছে কাশ্মীরভিত্তিক সশস্ত্র গোষ্ঠী দ্য রেজিসটেন্স ফোর্স (টিআরএফ)। বুধবার হামলার দায় স্বীকার করে দেওয়া এক বিবৃতি বলেছে, ‘যাদের টার্গেট করা হয়েছে তারা সাধারণ কোনো পর্যটক নয়। ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে তাদের যোগাযোগ ও সংশ্লিষ্টতা ছিল।
তারা ছিল গোপন সংস্থার সদস্য। পর্যটকের ছদ্মবেশে অনুসন্ধান চালানোর জন্য এখানে এসেছিল।’ ভয়াবহ এ হামলার দায় স্বীকার করা গোষ্ঠীটি কাশ্মীরে নিজেদের কার্যক্রম আরও বাড়ানোর হুমকি দিয়েছে। এই হামলা ভারত সরকারের জন্য একটি সতর্কবার্তা বলেও বিবৃতিতে উল্লেখ করেছে টিআরএফ। গোষ্ঠীটি বলেছে, ‘এটি শুধুমাত্র নয়াদিল্লির জন্য একটি সতর্কবার্তা নয়। এটি তাদের জন্যও সতর্কবার্তা যারা নয়াদিল্লির প্রশ্নবিদ্ধ নীতিকে সমর্থন করে।’ তবে ভারত সরকার এখন পর্যন্ত টিআরএফের দাবি নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।
এদিকে পেহেলগাঁওতে সন্ত্রাসী হামলার জেরে পাকিস্তান সরকারের অফিসিয়াল এক্স অ্যাকাউন্টে প্রবেশাধিকার স্থগিত করেছে ভারত। এই ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ক্যাবিনেট কমিটি অন সিকিউরিটি (সিসিএস) ভারতের প্রতিক্রিয়া নির্ধারণে বৈঠক করে। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিস্রি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক একাধিক কঠোর পদক্ষেপ ঘোষণা করেন।
ভারতের সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি এ খবর জানিয়েছে। সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরে ভ্রমণ সতর্কতা জারি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলটিতে এবং ভারত-পাকিস্তান সীমান্তের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে ‘সন্ত্রাসী হামলা’ এবং সম্ভাব্য ‘সহিংস বেসামরিক অস্থিরতার’ কারণে এই সতর্কীকরণ জারি করা হয়েছে। গত বুধবার সব মার্কিন নাগরিকদের জন্য এই সতর্কতা জারি করল যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘জম্মু ও কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলা এবং সহিংস নাগরিক অস্থিরতার আশঙ্কা রয়েছে।
পূর্ব লাদাখ অঞ্চল এবং এর রাজধানী লেহ ব্যতীত এই রাজ্যে ভ্রমণ করবেন না। এই অঞ্চলে মাঝেমধ্যেই সহিংসতা ঘটে এবং ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে নিয়ন্ত্রণ রেখা (এলওসি) বরাবর এটি হয়ে থাকে। কাশ্মীর উপত্যকার পর্যটন কেন্দ্রগুলোতেও শ্রীনগর, গুলমার্গ এবং পেহেলগামে- সহিংসতার ঘটনা ঘটে।’ এদিকে, ‘সশস্ত্র সংঘাতের আশঙ্কার কারণে’ ভারত তার নাগরিকদের ভারত-পাকিস্তান সীমান্তের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে যাওয়া এড়াতেও অনুরোধ করেছে।