ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এবং পুলিশ গত শনিবার স্বীকার করেছে, গাজাসিটির আল-শুজাইয়া এলাকায় ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ যোদ্ধাদের সঙ্গে লড়াইয়ে তাদের এক সেনা ও পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন। নিহত সেনা কর্মকর্তা ৪০১তম আর্মার্ড ব্রিগেডের ৪৬তম ব্যাটালিয়নের প্লাটুন কমান্ডার এবং পুলিশ কর্মকর্তা সীমান্ত পুলিশের ইয়ামাস কভার্ট ইউনিটের সদস্য। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর প্রাথমিক তদন্তে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, আল-শুজাইয়া অভিযানের সময় জেরুজালেম রিজার্ভ ইনফেন্ট্রি ব্রিগেড এবং ইয়ামাস ইউনিটের সদস্যরা একটি ভবনে হামলা চালান। এরপর প্রতিরোধ যোদ্ধারা ইসরায়েলিদের ওপর পাল্টাহামলা চালান। প্রচণ্ড গোলাগুলির এক পর্যায়ে ইয়ামাস কর্মকর্তা ঘটনাস্থলে নিহত হন। আহত হন অনেকে। কিছুক্ষণ পর সেখানে ইসরায়েলি উদ্ধারকারী সেনাদল গেলে তাদের ওপর আরপিজি শেল দিয়ে আঘাত করা হয়। এতে এক সেনাসদস্য আহত হন। ঘণ্টাখানেক পর কয়েকটি ইসরায়েলি ট্যাঙ্ক নিয়ে ঘটনাস্থলে যান আরেকটি সেনাদল। তারাও প্রচণ্ড আরজিপি হামলার কবলে পড়েন। একটি প্রজেক্টাইল এসে পড়ে প্লাটুন কমান্ডারের ওপর। এতে তিনি ঘটনাস্থলে নিহত এবং আরও তিন সেনাসদস্য গুরুতর আহত হন।
ইসরায়েলি সামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ: ইসরায়েলের চ্যানেল ফোর্টিন ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর সিনিয়র কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ক্ষোভের খবর দিয়েছে। প্রতিরোধ যোদ্ধাদের হামলা তীব্র বাড়ছে জানিয়ে ওই কর্মকর্তাদের বরাতে খবরে বলা হয়েছে, ‘এখন দুই সিদ্ধান্তের একটি নিতে হবে; হয় গাজাকে ধ্বংস করে দিতে হবে, নয়তো সেখান থেকে সেনাদের সরিয়ে নিতে হবে। কারণ, সেনা সদস্যদের রক্ত এত সস্তা নয়।’
এ নিয়ে ইসরায়েলের চ্যানেল টোয়েলভের সামরিক সংবাদদাতা বলেছেন, যুদ্ধবিরতি শেষ হওয়ার পর থেকে কোনো স্পষ্ট লক্ষ্য ছাড়াই গাজায় অভিযান চলছে। তিনি বলেন, ‘কোনো বড় ধরনের সামরিক অভিযানও হচ্ছে না, প্রকৃত রাজনৈতিক পদক্ষেপও নেওয়া হচ্ছে না। বন্দিদের ফেরানোর বিষয়ে অগ্রগতি ছাড়াই সেনাদের নিরাপত্তাহীনতা ও জীবন ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়েছে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা কিংবা সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে গাজাযুদ্ধ নিয়ে ক্ষোভ তীব্র হচ্ছে বলে প্রতিদিনই জানাচ্ছে ইসরায়েলি মিডিয়া। এরইমধ্যে হাজার হাজার সেনা যুদ্ধ থেকে নিজেদের সরিয়ে নিতে আবেদন করেছেন। যুদ্ধে ফেরানোর চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর অনেক সেনাকে বরখাস্ত করেছে কর্তৃপক্ষ। এ নিয়ে চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীতে।
চার ইসরায়েলি সেনা কর্মকর্তাকে গুলি: শনিবার সকালে আল-কাসসাম ব্রিগেডসের মিলিটারি মিডিয়া উত্তর গাজায় দখলদার ইসরায়েলি কর্মকর্তা ও সৈনিকদের গুলি করে হত্যার ভিডিও প্রকাশ করেছে। কাসসামের তরফে জানানো হয়, স্থানীয়ভাবে তৈরি ঘৌল রাইফেল ব্যবহার করে বেইত হানুনের আল-আওদা স্ট্রিটে এই অভিযান পরিচালিত হয়। বেশ কয়েকটি অ্যান্টি-আর্মার শেল দিয়ে ইসরায়েলের সামরিক যন্ত্রপাতিতে আঘাত হানার ফুটেজও প্রকাশ করেছেন তারা। ‘ব্রেকিং দ্য সোর্ড’ অভিযানের অংশ হিসেবে এসব হামলা চালানো হয় বলে উল্লেখ করেছে আল-কাসসাম। আগেরদিনও হামাসের এই সামরিক শাখা জানিয়েছিল, আল-আওদা স্ট্রিটে চার ইসরায়েলি সেনা কর্মকর্তাকে গুলি করেছেন তারা। এতে সেনারা নিশ্চিতভাবে নিহত অথবা আহত হন। এদিন ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ লড়াই ও সুপরিকল্পিত হামলা আরও জোরালোভাবে অব্যাহত থাকবে বলে জানান আল-কাসসামের মুখপাত্র আবু ওবাইদা।
ইসরায়েলি বন্দিদের উদ্ধার করল হামাস: শনিবার আরেকটি ভিডিও প্রকাশ করেছে আল-কাসসাম, যেখানে কয়েকদিন আগে দখলদার সেনাবাহিনীর বোমা হামলায় বিধ্বস্ত একটি টানেল থেকে ইসরায়েলি বন্দিদের উদ্ধার অভিযানের দৃশ্য দেখা গেছে। এই অভিযানের বিস্তারিত পরে জানানো হবে বলে জানায় গ্রুপটি। ফুটেজে দেখা যায়, কাসসামের বেশ কয়েকজন যোদ্ধা কিছু অংশ চাপা পড়ে থাকা একটি সুড়ঙ্গে খননকাজ চালাচ্ছেন। হামলার কারণে এর প্রবেশপথ বন্ধ হয়ে যায়। বন্দিদের উদ্ধারের জন্য তারা ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে নিচ্ছেন।
ক্লিপে আল-কাসসামের এক সদস্যকে সুড়ঙ্গের ভেতরে থাকা এক ইসরায়েলি বন্দির সঙ্গে কথা বলতে শোনা যায়। ওই সদস্য বলছেন, ‘তুমি কি আমাকে শুনতে পাচ্ছ? অপেক্ষা কর, অপেক্ষা কর। এরপর কাসসামের সদস্যরা প্রবেশপথ খুলে ভেতরে প্রবেশ করে ব্যথায় কাতর এক ইসরায়েলি বন্দিকে বের করে আনেন। ওই বন্দি বলছিলেন, ‘আমার শরীর ব্যথা করছে, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।’ এরপর বন্দির মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগিয়ে দেন তারা। ওই বন্দির চেহারা ভিডিওতে স্পষ্ট দেখা যায়নি। কাসসামের ভিডিও ক্লিপের শেষের দিকে বলা হয়, বেশ কয়েকজন ইসরায়েলি বন্দিকে আটক রাখার জায়গায় হামলা চালায় ইসরায়েলি বাহিনী। এরপর আমাদের যোদ্ধারা অভিযান চালিয়ে তাদের উদ্ধার করেন।
ইসরায়েলি সেনাঘাঁটিতে হাইপারসনিক হামলা: গতকাল রোববার সকালে দখলকৃত ফিলিস্তিনের ওয়াদি আরাবা এবং মৃতসাগরে হামলা চালিয়েছেন ইয়েমেনের হুতি আনসার-আল্লাহর নেতৃত্বাধীন সশস্ত্র বাহিনী। এসময় সেখানে দীর্ঘ সময় ধরে সাইরেনের শব্দ শোনা যায় বলে জানিয়েছে ইসরায়েলি মিডিয়া। সীমান্তের দুই লক্ষ্যবস্তুতে পরিচালিত এই হামলা প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছে বলে জানায় ইসরায়েলি বাহিনী। এর আগে শনিবার ইয়েমেনের সশস্ত্র বাহিনী জানায়, দক্ষিণ ইসরায়েলের আল-নাকাব অঞ্চলের নেভাতিম বিমানঘাঁটিতে সামরিক অভিযান পরিচালনা করেছেন তারা। হাইপারসনিক মিসাইল ‘প্যালেস্টাইন-টু’ ব্যবহার করে এই হামলা চালানো হয়। বাহিনীর মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইয়াহিয়া সারি জানান, ইসরায়েলি প্রতিরক্ষাব্যবস্থা নস্যাৎ করে নেভাতিম বিমানঘাঁটিতে আঘাত হানে তাদের মিসাইল। সারি জানান, গাজা উপত্যকায় আগ্রাসন এবং এর ওপর থেকে অবরোধ প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত ইসরায়েলি ও মার্কিন স্বার্থের বিরুদ্ধে আরও জোরালোভাবে এ ধরনের হামলা অব্যাহত থাকবে।
পাঁচ বছরের যুদ্ধবিরতিতে রাজি হামাস: হামাসের শূরা কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ দারবিশের নেতৃত্বে একটি সিনিয়র প্রতিনিধিদল শনিবার সন্ধ্যায় মিসরীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে সিরিজ আলোচনার পর রাজধানী কায়রো ছেড়েছে। আলোচনায় গাজার যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করা, বন্দিবিনিময় সহজতর করা এবং গাজায় ক্রমবর্ধমান মানবিক সংকট মোকাবিলার ওপর জোর দেওয়া হয়। আলোচনার পর এক বিবৃতিতে হামাস গাজায় চলমান সংঘাতের অবসান ঘটাতে যুদ্ধবিরতিতে উপনীত হওয়া এবং আন্তর্জাতিক সহায়তার প্রবাহ নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়, প্রতিনিধিদলটি চুক্তি অর্জনে অব্যাহত কূটনৈতিক প্রচেষ্টার গুরুত্ব তুলে ধরেছে, যা শুধু সহিংসতা বন্ধ করবে না, পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ মানবিক সংকটগুলোর সুরাহাও করবে।
বিবৃতিতে হামাসের স্থায়ী শান্তির দৃষ্টিভঙ্গি বিস্তারিতভাবে তুলে ধরে বলা হয়, তাদের প্রচেষ্টার প্রধান লক্ষ্য হলো স্থায়ী যুদ্ধবিরতি, বন্দিবিনিময়, গাজায় মানবিক সহায়তার প্রবাহ নিশ্চিত করা ও উপত্যকার পুনর্গঠন। হামাস কর্মকর্তাদের বরাতে আলজাজিরা জানিয়েছে, কায়রোতে তারা মধ্যস্থতাকারীদের কাছে যুদ্ধবিরতি, বন্দিবিনিময় ও গাজা পুনর্গঠনের জন্য একটি বিস্তৃত পরিকল্পনা উপস্থাপন করেছেন। এএফপির খবরে বলা হয়, পাঁচ বছরের জন্য যুদ্ধবিরতির একটি চুক্তি করতে রাজি হয়েছে হামাস। এই চুক্তি অনুযায়ী যুদ্ধ বন্ধের পাশাপাশি হামাসের হাতে বন্দি বাকি সব ইসরায়েলিকে মুক্তি দেওয়া হবে। মিসরের সঙ্গে আলোচনার পর শনিবার এএফপিকে এমন তথ্য জানান হামাসের এক কর্মকর্তা।
আরও ৫৬ ফিলিস্তিনি নিহত: অবরুদ্ধ গাজায় ইসরায়েলি হামলায় একদিনে আরও ৫৬ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন শতাধিক। এর মধ্য দিয়ে অবরুদ্ধ উপত্যকাটিতে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৫১ হাজার ৪৯৫ জনে পৌঁছেছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েলি হামলায় আহত ১০৮ জনকে গাজার বিভিন্ন হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। এর ফলে সংঘাতের শুরু থেকে আহতের সংখ্যা বেড়ে ১ লাখ ১৭ হাজার ৫২৪ জনে পৌঁছেছে। অনেক মানুষ এখনও ধ্বংসস্তূপের নিচে এবং রাস্তায় পড়ে থাকলেও উদ্ধারকারীরা তাদের কাছে পৌঁছাতে পারছেন না। গাজার মিডিয়া অফিসের আপডেট তথ্য বলছে, নিহতের সংখ্যা ৬১ হাজার ৭০০’রও বেশি। কারণ, ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকাপড়া হাজার হাজার মানুষ আর বেঁচে নেই বলেই ধারণা করা হচ্ছে।