ঢাকা সোমবার, ১৯ মে ২০২৫, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

আজ মহান মে দিবস

হাড়ভাঙা শ্রমের মূল্য মেলে না

* দেশে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ হলেও আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় শিশুশ্রম বন্ধ করা যায়নি। তবে শ্রম আইনে অনেক পরিবর্তন আসবে : শ্রম উপদেষ্টা * দেশে আট কোটি শ্রমজীবী মানুষ আছেন। তার মধ্যে ৮৫ শতাংশ বা ৭ কোটি শ্রমিকের আইনি সুরক্ষা নেই। শ্রমিকদের আইনি সুরক্ষা নিশ্চিতের সুপারিশ করেছে শ্রম সংস্কার কমিশন
হাড়ভাঙা শ্রমের মূল্য মেলে না

বিশ্বের অন্য দেশের মতো আজ বাংলাদেশে পালিত হচ্ছে মহান মে দিবস। শ্রমিকদের আন্দোলন-সংগ্রামে অনুপ্রেরণার দিনে রাজধানী ঢাকাসহ পুরো দেশে সরকারি-বেসরকারি শ্রমজীবী মানুষ ছুটিতে থাকবেন। মালিক-শ্রমিক সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার আর শ্রমিকদের শোষণ-বঞ্চনার অবসান ঘটার দিন এটি। দিবসটি উপলক্ষে বিভিন্ন সংগঠন শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কর্মসূচি-সমাবেশ করছে।

জানা গেছে, দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি কৃষি, গার্মেন্ট ও রেমিট্যান্স। স্বস্তা শ্রমের ওপর দাঁড়িয়ে অর্থনীতি টিকিয়ে রেখেছেন শ্রমিকরা। কিন্তু আজ তারা ভালো নেই। জীবন যাত্রার ব্যয়ের সঙ্গে আয়ের বিশাল ফাঁরাক। বছরে বছরে নিত্যপণ্যের দাম হু হু করে বাড়লেও আয় সেভাবে বাড়েনি। ব্যয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে গিয়ে হিমশিমে পড়ছেন শ্রমজীবী মানুষ। কম মজুরি, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার অভাব, স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি এবং ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য আরও মারাত্মক আকার ধারণ করছে। এসবের মধ্যেই ‘শ্রমিক-মালিক এক হয়ে, গড়ব এ দেশ নতুন করে’ এ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে এবারের মে দিবসের মূল অনুষ্ঠান চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্র করছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়।

স্বাধীনতার পর থেকে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকা রাজনৈতিক দলের মন্ত্রী, এমপি, নেতাদের ভাগ্য বদল ঘটলেও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ শ্রমবাজার অপরিপক্ব রয়ে গেছে। দেশের তৈরি পোশাক খাতের ওপর নির্ভরশীল। রপ্তানিভিত্তিক হওয়া সত্ত্বেও এই খাত উচ্চ দক্ষ এবং উচ্চ মজুরির কর্মসংস্থান তৈরিতে সক্ষম হয়নি। ফলে বছরের পর বছর পোশাক খাতের শ্রমিকরা অন্যান্য দেশের শ্রমিকদের তুলনায় কম মজুরিতে কাজ করছেন।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২৪ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ের ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি জরিপে দেশে বেকার জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে। চলতি বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে শ্রমশক্তির ২৬ লাখ ৬০ হাজার মানুষ বেকার ছিলেন। বেকারের হিসাব ১৯তম আইসিএলএস (পরিসংখ্যানবিদদের আন্তর্জাতিক সম্মেলন) অনুযায়ী প্রস্তুত করে বিবিএস। এই পদ্ধতি অনুসারে যারা উৎপাদনমূলক কাজে নিয়োজিত থাকেন, কিন্তু বাজারে পণ্য বা সেবা বিক্রি করেন না, তারা কর্মে নিয়োজিত নন হিসেবে ধরা হয়। তারা বেকার জনগোষ্ঠী হিসেবে বিবেচিত হন। বেরসকারি হিসাবে বেকারের সংখ্যা সরকারি হিসাবের চেয়ে বেশি। এরমধ্যেই গতকাল বুধবার গাজীপুর নগরের কোনাবাড়ী এলাকার শ্রমিক বিক্ষোভের মুখে দুটি তৈরি পোশাক কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। বন্ধ কারখানা দুটি হলো ‘এমএম নিটওয়্যার লিমিটেড’ ও ‘মামুন নিটওয়্যার লিমিটেড’। কারখানা দুটি একই শিল্পপ্রতিষ্ঠানের।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের অর্থনীতির চালিকা শক্তির মূলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন শ্রমিকরা। আর এ শ্রমিকদের ঠকাতে বরাবরই চেষ্টা অব্যাহত রাখেন প্রতিষ্ঠানের কর্তারা। কখন কখন শ্রমিকরা নিজের ন্যায্য অধিকার আদায়ে সোচ্চার হলে জোরপূর্বক চাকরি থেকে ছাঁটাই করেন প্রতিষ্ঠানের মালিকরা। চাকরি হারানোর ভয়ে বছরের পর বছর নির্যাতন-নীপিড়ন সহ্য করেন শ্রমিকরা। মালিক-শ্রমিক সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার আর শ্রমিকদের শোষণ-বঞ্চনার অবসান ঘটার স্বপ্ন দেখারও দিনে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাণীতে বলেছেন, দেশকে নতুন করে গড়ে তুলতে হলে ঐক্য, পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং আস্থার পরিবেশ সুদৃঢ় করতে হবে। অন্যদিকে মে দিবসে ঢাকার নয়া পল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করছে বিএনপির জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দল।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন ৬৫ নম্বর ওয়ার্ডে প্রখর রোদে বহুতল ভবনের নির্মাণকাজ করছেন মোবারক হোসেন। তার কাছে মে দিবস বলতে কিছু নেই। একদিন কাজ না করলে পরের দিনে তার সংসার চালানো কষ্টকর হয়ে পড়ে। মোবারক হোসেন বলেন, মে দিবস এসব জেনে আমাদের লাভ অইব কী? সব দিনই আমরার লাগি সমান। বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য রড কাটতে কাটতে এসব কথা বলেন মোবারক হোসেন। যুগের পর যুগ মে দিবস পালন হলেও বহু শ্রমিক জানেন না তাদের আজ ছুটির দিন। প্রতিদিনের মতোই আজও তারা দিনমজুরের কাজে নেমেছেন। অধিকার নিয়ে তারা ভাবেন না। তারা শুধু ভাবেন কাজ না করলে সংসার চলবে না।

মে দিবসে সরকারি-বেসরকারিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকরা ছুটি পেলেও হোটেল-রেস্টুরেন্ট, মুদিদোকানের শ্রমিকদের ছুটি দিতে নানা টালবাহানা করেন মালিকরা। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পরিবার ও সন্তানদের জন্য দুমুঠো খাবার জোগাড় করতে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন তারা। কাজল সরকারের বাড়ি ফরিদপুর। তিনি কাপ্তানবাজারে দীর্ঘ সাড়ে ১২ বছর ধরে মুদির দোকানে কাজ করেন। তার পাঁচ সদস্যের সংসারের খরচ জোগান। ৫৫ বছর বয়সে অনেক ভারী বস্তা কাঁধে তুলতে তুলতে কাঁধ দুটি শক্ত হয়ে গেছে। পরিবার ও সন্তানদের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য এই হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পরও তিনি এক দিনের জন্যও বসে থাকেন না। বড় বড় বস্তা কাঁধে তার প্রতিদিন ৮০০ টাকা আয় হয়। এ দিয়েই তার সংসার চলে। দীর্ঘ কর্মজীবনে কোনো দিনও তিনি মে দিবসে বসে থাকেননি। এমনকি কবে কোন দিক দিয়ে এ দিবস যায়, সেটাও খোঁজখবর রাখেন না। রাখলেই কী? এদিন যদি তিনি বসে থাকেন, তাহলে খাবার জুটবে না। একই কথা বললেন আরেক রাজমিস্ত্রি মশিউর রহমান। মশিউর বলেন, ভাত জোগানের চিন্তায় সব সময় অস্থির থাকি। মে দিবস কী, বলতে পারি না। আর বলেই বা লাভ কী? শ্রমিকদের খোঁজখবর কে রাখে? দিন দিন বাজারের জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বাড়ছে, সেভাবে কি শ্রমিকদের মজুরি বাড়ছে? সে জন্য সারাদিন ঘাম ঝরিয়ে কঠোর পরিশ্রম শেষে পরের দিনের রোজগারের কথা চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ি। কোন দিক দিয়ে রাত শেষ হয়ে যায়, তাও টের পাই না। কাজ করে যে টাকা পাই তা দিয়ে টিকে থাকাই কঠিন।

মহান মে দিবস উপলক্ষে গতকাল বুধবার সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, মানবাধিকার এবং শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত করা অন্তর্বর্তী সরকারের লক্ষ্য। আর এজন্য মালিক ও শ্রমিক সবার সহযোগিতা দরকার। শ্রম উপদেষ্টা বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার শ্রমিকদের কল্যাণে অনেকগুলো পদক্ষেপ নিয়েছে। কর্মসংস্থান অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করা হচ্ছে। সেখান থেকে শ্রমিকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। তবে শ্রমিক অসন্তোষ সামাল দিতে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে সরকারকে। শ্রম আইনে অনেক পরিবর্তন আসবে, যা তার মেয়াদকালেই বাস্তবায়ন করে যেতে চান। এক প্রশ্নের জবাবে শ্রম উপদেষ্টা বলেন, দেশে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ হলেও আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় শিশুশ্রম বন্ধ করা যায়নি।

শ্রম সংস্কার কমিশনের সুপারিশ : অন্তর্বর্তী সরকার শ্রম অধিকার রক্ষা ও কল্যাণ নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সংস্কার প্রস্তাব প্রণয়নে শ্রম সংস্কার কমিশন গঠন করে। গত ১৭ নভেম্বর বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিআইএলএস) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদকে প্রধান করে ১০ সদস্যের একটি শ্রম সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। কমিশন শ্রম বিষয়ে অংশীজন ও বিভিন্ন সংগঠন এবং প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মতবিনিময় করে সুপারিশসহ প্রতিবেদন দাখিল করে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে শ্রম সংস্কার কমিশন ২১ এপ্রিল তাদের প্রতিবেদন হস্তান্তর করেন। শ্রম আইন মেনে শ্রমিককে চাকরিচ্যুত/ছাঁটাই করা না হলে মালিকের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সব শ্রমিকের আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করার সুপারিশ করেছে শ্রম সংস্কার কমিশন। দেশে আট কোটি শ্রমজীবী মানুষ আছেন। তার মধ্যে ৮৫ শতাংশ বা ৭ কোটি শ্রমিকের আইনি সুরক্ষা নেই। শ্রমবিষয়ক সংস্কার কমিটি এই শ্রমিকদের আইনি সুরক্ষা নিশ্চিতের সুপারিশ করেছে। কর্মক্ষেত্রে সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখার স্বার্থে বিশেষ সুপারিশ করেছে কমিশন। সেগুলো হলো, শ্রম আইনে মহিলা শব্দের পরিবর্তে নারী শব্দ ব্যবহার এবং কর্মক্ষেত্রে তুই/তুমি সম্বোধন বন্ধ করা। শ্রমিকদের সংগঠন করার অধিকার নিশ্চিত এবং তাদের দর-কষাকষি করার প্রক্রিয়া যেন আরও সহজ হয়, তা নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয়েছে। কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি দূর করতে ২০০৯ সালের হাইকোর্টের নির্দেশনার আলোকে যৌন নিপীড়নবিরোধী নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের সুপারিশ করেছে কমিশন। সেইসঙ্গে নারীদের মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস করার কথা বলা হয়েছে, যে সুপারিশ অন্যান্য কমিশনও করেছে। শ্রমিকদের কল্যাণে সর্বজনীন তহবিল করার সুপারিশ করা হয়েছে। সেইসঙ্গে শ্রম আদালতসহ আপিল বিভাগের সর্বক্ষেত্রে যেন বাংলা প্রচলন করা হয়, তা নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয়েছে। সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারী-পুরুষের সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।

নারী শ্রমিকদের বেতন কম : নিরাপত্তাকর্মী, ইটভাটা, হোটেল, রেস্তোরাঁ ও নির্মাণকাজে কর্মরত নারী শ্রমিকরা বেতন বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। তারা পুরুষদের তুলনায় কম বেতনই পাচ্ছেন না, কাজ পাওয়াও তাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। মালিকপক্ষ মনে করেন, প্রধান কাজের বাইরে সহযোগিতামূলক ও অগুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য নারী শ্রমিক নেয়া হয়। তাই তারা পুরুষ শ্রমিকের চেয়ে তুলনামূলক কম মজুরি পান।

প্রসঙ্গত, শ্রমিক দিবসে বিশ্বের অন্তত ৮০টি দেশে সরকারি ছুটি থাকে। মে দিবস বিশ্বব্যাপী শ্রমিকদের প্রতি শ্রদ্ধা-সম্মান-সংহতি হিসেবে পালিত হয়ে আসছে ১৯০৪ সাল থেকে। ১৮৮৬ সালের ১ মে আমেরিকার শ্রমিকরা দৈনিক শ্রমঘণ্টা ১২ থেকে কমিয়ে ৮ ঘণ্টার দাবিতে ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিলেন। মে মাসের ৪ তারিখ শিকাগো শহরের হে মার্কেট স্কয়ারে পুলিশের উপস্থিতিতে শ্রমিক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে অজ্ঞাতনামা কেউ বোমার বিস্ফোরণ ঘটালে একজন পুলিশ অফিসারের মৃত্যু হয়। এসময় পুলিশ গুলি চালালে অনেক শ্রমিক নিহত হন। পরের বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষাপটে আমেরিকান সরকার শ্রমিকদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়। দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজ করার দাবি পূরণ, শ্রমিকদের মৃত্যুর ঘটনাকে স্মরণ এবং তাদের প্রতি সংহতি জানাতে ১ মে শ্রমিক দিবস হিসেবে পালন করা হয়। বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, চীন, জাপান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, ইরাক, ফিলিপাইন, উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুরসহ বহু দেশে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করা হয়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত