ফিলিস্তিনের গাজার উপত্যকার দক্ষিণাঞ্চলীয় রাফা শহরের একটি টানেলে পেতে রাখা বোমার বিস্ফোরণে দুই ইসরায়েলি সেনা নিহত এবং অপর দুইজন আহত হয়েছেন। এ নিয়ে গাজায় হামাসের সঙ্গে চলমান যুদ্ধে নিহত ইসরায়েলি সেনার সংখ্যা ৪১৬ জনে দাঁড়াল বলে জানিয়েছে টাইমস অব ইসরায়েল। রোববার ইসরায়েলি দখলদার বাহিনী জানিয়েছে, রাফার একটি ভবনের ভেতরে থাকা টানেলের প্রবেশপথ স্ক্যানিং করার সময় হঠাৎ সেখানে বিস্ফোরণ ঘটে। এ সময় ইয়াহালোম কমব্যাট ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিটের ২৩ বছর বয়সী ক্যাপ্টেন নোয়াম রভিদ এবং ২০ বছর বয়সী স্টাফ সার্জেন্ট ইয়ালি সেরর নিহত হন। আহত সেনাদের মধ্যে একজনের অবস্থা গুরুতর। অপরজনের আঘাত ততটা গুরুতর নয়। এদিন পৃথক আরেক ঘটনায় গাজার উত্তরাঞ্চলে ইসরায়েলি বাহিনীর জেরুজালেম ব্রিগেডের এক রিজার্ভ সেনা গুরুতর আহত হন। আইডিএফ জানিয়েছে, কোন পরিস্থিতিতে তিনি আহত হয়েছেন, তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। এর পাশাপাশি গাজা সিটির দুই এলাকায় ইসরায়েলি সেনা ছাউনিতে পৃথক বিস্ফোরণে আরও দুই সেনা আহত হন। তাদের মধ্যে এক ঘটনায় ট্যাঙ্কের একটি গোলার আগাম বিস্ফোরণে একজন আহত হন। অপরজন গাজা সিটির তুফফাহ এলাকায় সম্ভাব্য এক মর্টার হামলায় আহত হয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে তীব্র নৃশংসতার প্রতিশোধ হিসেবে ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস দখলদার গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক অভিযান চালানোর পর ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজায় গণহত্যামূলক যুদ্ধ শুরু করে ইসরায়েল। ইসরায়েলি নির্বিচার হামলায় এ পর্যন্ত কমপক্ষে ৫২ হাজার ৫৩৫ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। এছাড়া, এক লাখ ১৮ হাজার ৪৯১ জন আহত হয়েছেন। যুদ্ধের আগে হামাসকে নির্মূল করা এবং অভিযানের মাধ্যমে ইসরায়েলি বন্দিদের মুক্ত করার লক্ষ্য ঘোষণা করেছিলেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু; কিন্তু এই লক্ষ্য অর্জনে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে ইসরায়েল।
মাটির নিচে আশ্রয় নিলেন ৩০ লাখ ইসরায়েলি : ইসরায়েলি আকাশ প্রতিরক্ষাবাহিনীর একাধিক প্রতিরোধ চেষ্টা ব্যর্থ করে তেলআবিবের কাছে অবস্থিত বেন গুরিয়ন বিমানবন্দরে বীরোচিত হামলা চালিয়েছে ইয়েমেনের হুথি আনসার-আল্লাহর নেতৃত্বাধীন সশস্ত্র বাহিনী। হামলায় হাইপারসনিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছেন তারা। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইসরায়েলের চার স্তরের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেদ করে রোববার এই ক্ষেপণাস্ত্র দেশটির প্রধান বিমানবন্দরের কেন্দ্রস্থলে আঘাত হানে। ইসরায়েলি দৈনিক ইয়েদিয়োত আহরোনোত জরুরি সেবা সূত্রের বরাতে জানিয়েছে, হামলায় অন্তত সাতজন আহত হয়েছেন। ইয়েমেনের সশস্ত্র বাহিনীর মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইয়াহিয়া সারি এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘আমরা ইসরায়েলের বেন গুরিয়ন বিমানবন্দরে হাইপারসনিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে আঘাত করেছি। ইসরায়েলি বিমান প্রতিরক্ষা বাহিনী ক্ষেপণাস্ত্র আটকাতে ব্যর্থ হয়েছে।’ ইসরায়েলি গণমাধ্যমে প্রকাশিত ফুটেছে দেখা গেছে, বেন গুরিয়নে হামলার পর মাটিতে ২৫ মিটার গভীর গর্ত তৈরি হয়েছে। ইসরায়েলি গণমাধ্যমে বলা হয়েছে, ইয়েমেনি হামলার পর আতঙ্কে ৩০ লাখেরও বেশি ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারী পালিয়ে মাটির নিচে আশ্রয় নিয়েছেন। হামলার পর রোববারের জন্য নির্ধারিত ইসরায়েলি মন্ত্রিসভার বৈঠক বাতিল করা হয়েছে। এছাড়া, লুৎফহানসা, এয়ার ফ্রান্স, ডেল্টা ও উইজ এয়ারের মতো আন্তর্জাতিক বিমান সংস্থাগুলো ইসরায়েলে তাদের ফ্লাইট বাতিল করেছে।
ফিরে এলো তেলআবিবগামী ভারতীয় বিমান : বেন গুরিয়ন বিমানবন্দরে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ঘটনায় দিল্লি থেকে তেলআবিবগামী এয়ার ইন্ডিয়ার একটি যাত্রীবাহী উড়োজাহাজের গন্তব্য পরিবর্তন করা হয়েছে। জরুরি পরিস্থিতিকে সেটি আবুধাবিতে অবতরণ করে। এই ঘটনার পর প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, যাত্রী ও কর্মীদের নিরাপত্তার স্বার্থে তেলআবিবগামী সব ফ্লাইট ৬ মে ২০২৫ পর্যন্ত সাময়িকভাবে স্থগিত রাখা হয়েছে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে বলা হয়েছে, বোয়িং সেভেন-এইট-সেভেন ড্রিমলাইনার উড়োজাহাজের ফ্লাইটটি তেলআবিবে পৌঁছানোর এক ঘণ্টা আগে দিক পরিবর্তন করে। ফ্লাইট ট্র্যাকিং সেবা ফ্লাইটরাডার টোয়েন্টিফোর বলেছে, ওই সময় উড়োজাহাজটি জর্ডানের আকাশসীমা অতিক্রম করছিল। এয়ার ইন্ডিয়া এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, বেন গুরিয়ন বিমানবন্দরে একটি ঘটনার কারণে ফ্লাইটটিকে আবুধাবিতে অবতরণ করানো হয়। এটিকে শিগগিরই দিল্লিতে ফিরিয়ে আনা হবে।’ হুথিদের হামলার পর তেলআবিব থেকে দিল্লিগামী ফিরতি ফ্লাইটও বাতিল করেছে এয়ার ইন্ডিয়া।
ইসরায়েলের বিরুদ্ধে এয়ার ব্লকেড ঘোষণা : এদিকে ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে এয়ার ব্লকেডের ঘোষণা দিয়েছে আনসার-আল্লাহ আন্দোলন। রোববার এক বিবৃতিতে এই অবরোধ আরোপের কথা জানায় সংগঠনটির নেতৃত্বাধীন সশস্ত্র বাহিনী। বাহিনীর মুখপাত্র ইয়াহিয়া সারি এক বিবৃতিতে বলেন, ‘গাজায় ইসরায়েলের ক্রমবর্ধমান আগ্রাসন এবং সম্প্রসারিত সামরিক অভিযানের প্রতিক্রিয়ায় আমরা ইসরায়েলের ওপর পূর্ণাঙ্গ এয়ার ব্লকেড ঘোষণা করছি। আমরা বারংবার বিমানবন্দরগুলোতে আঘাত হানান মাধ্যমে এই অবরোধ কার্যকর করব। বেন গুরিয়ন বিমানবন্দর এই হামলার প্রাথমিক লক্ষ্যবস্তু থাকবে।’ বিবৃতিতে ইসরায়েলি বিমানবন্দরগুলোতে সব ধরনের ফ্লাইট বাতিল করে বিমান ও যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আন্তর্জাতিক বিমান সংস্থাগুলোর প্রতি আহ্বান জানানো হয়। বিবৃতি প্রকাশের মুহূর্ত থেকেই এই অবরোধ কার্যকর হবে বলে ঘোষণায় উল্লেখ করা হয়। ইয়েমেনের বিবৃতিতে বলা হয়, ‘লেবানন ও সিরিয়ার মতো আরব দেশগুলোকে লক্ষ্য করে শত্রুরা যে হামলা চালাচ্ছে, তা কখনও মেনে নেবে না ইয়েমেনের গর্বিত জনগণ। এই জাতি যুদ্ধকে ভয় পায় না; তারা আত্মসমর্পণ করতে জানেন না।’
গাজা দখলের পরিকল্পনা ইসরায়েলের মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত : গাজায় হামাসের বিরুদ্ধে সামরিক হামলা আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা অনুমোদন করেছে ইসরায়েলের নিরাপত্তাবিষয়ক মন্ত্রিসভা। এ পরিকল্পনার মধ্যে গাজা পুরোপুরি দখল ও ভবিষ্যতে নিয়ন্ত্রণে রাখার মতো বিষয়ও রয়েছে। এরই মধ্যে হাজার হাজার সংরক্ষিত সেনা ডেকে পাঠিয়েছে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী। বাকি বন্দিদের ফিরিয়ে আনা ও হামাসকে পরাজিত করতে চাপ বাড়ানোকে তারা কারণ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। আশঙ্কা করা হচ্ছে, আগামী সপ্তাহে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য সফরের পর এই পরিকল্পনা কার্যকর হতে পারে। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর নিরাপত্তাবিষয়ক মন্ত্রিসভা রোববার সন্ধ্যায় গাজায় হামলা বাড়ানোর নিয়ে বৈঠকে বসে। বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ইসরায়েলি গণমাধ্যমে বলা হয়েছে, আগামী কয়েকমাস ধরে পর্যায়ক্রমে গাজায় সামরিক হামলা বৃদ্ধির প্রস্তাবটি সর্বসম্মিতক্রমে অনুমোদন করেছে মন্ত্রিসভা। প্রথম পর্যায়ে গাজার আরও কিছু এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মিসর ও ইসরায়েলের মধ্যে থাকা বাফার জোনের এলাকা বৃদ্ধি করা হবে। এর ফলে হামাসের সঙ্গে নতুন যুদ্ধবিরতি ও বন্দি মুক্তি আলোচনায় বাড়তি সুবিধা পাবে ইসরায়েল।