ঢাকা সোমবার, ২৮ জুলাই ২০২৫, ১৩ শ্রাবণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

বাংলাদেশের ওপর চাপ বাড়াচ্ছেন রোহিঙ্গারা

বাংলাদেশের ওপর চাপ বাড়াচ্ছেন রোহিঙ্গারা

মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির (এএ) যৌথ নির্যাতনের মুখে রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ বেড়ে চলেছে। গত দেড় বছরে দেড় লাখ রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। এভাবে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশে স্থানীয় পর্যায়ে নিরাপত্তার শঙ্কা বেড়েছে। আরও রোহিঙ্গা বিভিন্ন পথে আসছে এবং রাখাইনের পরিস্থিতির কারণে সামনে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ব্যাপক হতে পারে বলেও বিভিন্ন মহল থেকে আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মানবিক কারণে লাখ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় দিয়ে নানামুখী সংকটে পড়েছে বাংলাদেশ। বছরে পর বছর অনেক দেনদরবারের করেও রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো যাচ্ছে না। এর মধ্যে নতুন করে দেড় লাখ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে আরও বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে। এভাবে রোহিঙ্গা স্রোতের মতো আসতে থাকলে কক্সবাজারের কুতুপালং, নয়াপাড়া, ভাসানচর, উখিয়া ও টেকনাফে নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়বে। কক্সবাজারে মাত্র ২৪ বর্গকিলোমিটারে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে। দেড় বছরে আরও দেড় লাখ যুক্ত হয়েছে। ফলে এলাকাটি বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ স্থানের একটিতে পরিণত হয়েছে।

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলমান সহিংসতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের মুখে গত দেড় বছরে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে আরও ১ লাখ ৫০ হাজার রোহিঙ্গা। আজ শুক্রবার জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর এ তথ্য জানিয়েছে। সংস্থাটির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিয়ানমারে চলমান সংঘাত এবং বিশেষ করে রাখাইন রাজ্যকে লক্ষ্যবস্তু করায় হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছে। ২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নের মুখে সাড়ে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। গত কয়েক মাসে এ সংখ্যা আরও বেড়েছে। ইউএনএইচসিআর ও অন্যান্য দাতা সংস্থা এসব শরণার্থীকে মানবিক সহায়তা দিতে কাজ করে যাচ্ছে। ইউএনএইচসিআর বলছে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে উদারভাবে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে আসছে বাংলাদেশ।

কক্সবাজারে মাত্র ২৪ বর্গকিলোমিটারে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে। দেড় বছরে আরও দেড় লাখ যুক্ত হয়েছে। ফলে এলাকাটি বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ স্থানের একটিতে পরিণত হয়েছে। নতুন করে বাংলাদেশে প্রবেশ করা এসব রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে প্রায় ১ লাখ ২১ হাজার জনের বায়োমেট্রিক নিবন্ধন সম্পন্ন করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ইউএনএইচসিআর। এসব শরণার্থীর বেশিরভাগই নারী ও শিশু। এদের অধিকাংশই জনাকীর্ণ শরণার্থী শিবিরগুলোতে বসবাস করছে।

সংস্থাটি বলছে, শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা মূলত সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। ফলে নতুন করে শরণার্থী যোগ হওয়ায় সংকট দেখা দিয়েছে। যারা নিবন্ধিত শরণার্থী তাদের মানবিক সহায়তা প্রদান করছে দাতা সংস্থাগুলো। তবে, যারা নিবন্ধনের আওতায় আসেনি; তাদের কাছে খাবার, চিকিৎসা সেবা, শিক্ষা ও প্রয়োজনীয় ত্রাণ সামগ্রীসহ মৌলিক পরিষেবা পৌঁছানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে স্বেচ্ছাসেবকদের। ইউএনএইচসিআরের শঙ্কা, বর্তমানে বৈশ্বিক সহায়তা তহবিল তীব্র সংকটের মধ্যে রয়েছে। এ অবস্থায় নতুন শরণার্থী বৃদ্ধি পেলে জরুরি পরিষেবা শৃঙ্খল ভেঙে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে। শিগগির অতিরিক্ত তহবিল নিশ্চিত না করা হলে, সেপ্টেম্বরের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে এবং প্রয়োজনীয় রান্নার জ্বালানি (এলপিজি) ফুরিয়ে যাবে। ডিসেম্বরের মধ্যে খাদ্য সহায়তা বন্ধ হয়ে যাবে।

এছাড়া প্রায় ২ লাখ ৩০ হাজার শিশুর শিক্ষাসুবিধা বন্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। আর এদের মধ্যে প্রায় ৬৩ হাজার নতুন করে বাংলাদেশে আসা শিশু। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর ও মানবিক সহায়তা প্রদানকারী সংস্থাগুলো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বাংলাদেশ ও এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশগুলোর সঙ্গে সংহতি প্রকাশের আহ্বান জানিয়েছে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে শান্তি ও স্থিতিশীলতা না আসা পর্যন্ত এবং নিরাপদ ও স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসনের পরিবেশ নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সহায়তা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানানো হয়।

শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) কার্যালয়ের তথ্যমতে, একদিকে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২২০ জন এবং প্রতিমাসে সাড়ে ৬ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে। অন্যদিকে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের জন্মের হারও বেড়ে চলছে। প্রতিদিন ৯০ এবং প্রতিবছর ৩০ হাজার করে রোহিঙ্গা শিশুর জন্ম হচ্ছে বাংলাদেশে। সবমিলিয়ে বাংলাদেশের ওপর দিনদিন চাপ বেড়ে চলছে। শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, প্রতিবছর ৩০ হাজার রোহিঙ্গা শিশুর জন্ম বাংলাদেশের ওপর চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটা কোনোভাবে ঠেকানো যাচ্ছে না। দেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মধ্যে ৫২ শতাংশ শিশু, ৪৪ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক এবং ৪ শতাংশ বয়স্ক রয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মধ্যে ৪ লাখ ৯২ হাজার ৭০৫ জন পুরুষ (৪৯ শতাংশ) এবং ৫ লাখ ১২ হাজার ৮১৫ জন নারী (৫১ শতাংশ) রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪ সালে রোহিঙ্গাদের জন্য ৯০০ মিলিয়ন চেয়ে পাওয়া গেছে ৬০০ মিলিয়ন। ২০২৩ সালে রোহিঙ্গাদের জন্য ৮৭ কোটি মার্কিন ডলার বা প্রায় ৯ হাজার ৬০০ কোটি টাকা চেয়ে মিলেছে এর ৫০ শতাংশ। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের সহায়তায় জেআরপিতে ৪৩ কোটি ৪০ লাখ ডলারের প্রতিশ্রুতি থাকলেও পাওয়া যায় ৩১ কোটি ৭০ লাখ ডলার। ২০১৮ সালে প্রতিশ্রুত ১০০ কোটি ডলারের বিপরীতে ৬৫ কোটি ৫০ লাখ ডলার এবং ২০১৯ সালে ৯২ কোটি ডলারের বিপরীতে ৬৯ কোটি ৬০ লাখ ডলার পাওয়া গিয়েছিল। ২০২০, ২০২১ ও ২০২২ সালে প্রতিশ্রুতির চেয়ে যথাক্রমে ৬০, ৭৩ ও ৬৩ শতাংশ সহায়তা পাওয়া গেছে। একাধিক কর্মকর্তা জানান, মাসে জনপ্রতি ১২ দশমিক ৫০ মার্কিন ডলার হিসেবে খাদ্য সহায়তা দিয়ে আসছে ডব্লিউএফপিও। এ হিসাবে প্রতি মাসে খাবার খরচ বাবদ প্রায় ১৪৫ কোটি টাকা দেওয়া হয়। এটা কমে এখন ৭০ থেকে ৭৫ কোটিতে দাঁড়াবে। ২০২৩ সালে তহবিল ঘাটতির কারণে রোহিঙ্গাদের মাথাপিছু খাদ্য সহায়তা ১২.৫০ মার্কিন ডলার থেকে ১০ ও এর পর ৮ মার্কিন ডলার করা হয়। পরে ফের সেটি ১২.৫০ মার্কিন ডলার করা হয়েছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত