ঢাকা শনিবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ২১ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

আপত্তি-পরামর্শ আজকের মধ্যে জানানোর আহ্বান কমিশনের

আপত্তি-পরামর্শ আজকের মধ্যে জানানোর আহ্বান কমিশনের

জুলাই সনদের প্রতিটি অনুচ্ছেদ ধরে আলোচনা করার সুযোগ না থাকলেও সংশোধনী ও সংযোজনীগুলো সব রাজনৈতিক দলের কাছে চেয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। রাজনৈতিক দলগুলোর পরামর্শ বা আপত্তির বিষয়গুলো বৃহস্পতিবারের মধ্যে জানানোর আহ্বান করেছে কমিশন। তবে, ইতোমধ্যে মৌলিক সংস্কার ও আইনি ভিত্তির নিশ্চয়তা ছাড়া জুলাই সনদে সই করবে না বলে জানিয়েছে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্র তরুণদের নিয়ে গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)।

গতকাল বুধবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে দ্বিতীয় দফার ২২তম বৈঠকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরুর আগে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, আপনারা যে দায়িত্ব আমাদের দিয়েছেন, তার মধ্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। আমাদের লক্ষ্য একটি গ্রহণযোগ্য ঐকমত্যের খসড়া সনদ চূড়ান্তভাবে সবার হাতে তুলে দেওয়া।

রাষ্ট্রের মূলনীতি, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনপদ্ধতি, সংসদে নারী প্রতিনিধিত্বসহ অমীমাংসিত বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এরই অংশ হিসেবে গতকাল ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কমিশনের আলোচনা হয়। আলোচনার সূচিতে ছিল- সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব; সরকারি কর্ম কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং ন্যায়পাল নিয়োগের বিধান-সম্পর্কিত; রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব [অনুচ্ছেদ ৪৮(৩)]; রাষ্ট্রপতি নির্বাচনপদ্ধতি, ইলেকটোরাল কলেজ ইত্যাদি; উচ্চকক্ষের গঠন, সদস্য নির্বাচনের পদ্ধতি, এখতিয়ার ইত্যাদি; নাগরিকের মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ সম্পর্কিত প্রস্তাব এবং রাষ্ট্রের মূলনীতি।

৬২টি বিষয়ে একমত্য: দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন এবং দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কারের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঐকমত্য হয়েছে। বিভিন্ন দলের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে মোট ৬২টি বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে।

সংবিধান সংস্কার: সংবিধান সংস্কার ছিল প্রধান আলোচনার বিষয়। এতে ৩০টি দলের সম্মতিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে একটি দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা থাকবে, যা নিম্নকক্ষ (জাতীয় সংসদ) এবং উচ্চকক্ষ (সিনেট) নিয়ে গঠিত হবে। উচ্চকক্ষের সদস্যদের যোগ্যতা ও অযোগ্যতা নিম্নকক্ষের সদস্যদের অনুরূপ হবে। জাতীয় সংসদে নারী আসন ১০০-তে উন্নীত করার বিষয়েও নীতিগতভাবে ১৯টি দল একমত হয়েছে। এ ছাড়া, আইনসভার উভয় কক্ষে একজন করে ডেপুটি স্পিকার বিরোধী দল থেকে মনোনীত করার বিধান রাখা হবে। রাষ্ট্রপতির অভিশংসন প্রক্রিয়া নিম্নকক্ষ ও উচ্চকক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে সম্পন্ন করার প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে।

নির্বাচন ও বিচার বিভাগ সংস্কার: নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের ক্ষেত্রে, নির্বাচন কমিশনের অধীনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলসমূহকে তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯-এর আওতাভুক্ত করা হবে। বিচার বিভাগ সংস্কারে আপিল বিভাগের বিচারক সংখ্যা বৃদ্ধি এবং প্রধান বিচারপতির চাহিদা মোতাবেক বিচারক নিয়োগের বিধান যুক্ত করা হবে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে একটি স্বাধীন বিচার বিভাগীয় নিয়োগ কমিশন (জেএসি) গঠন করা হবে। বিচার বিভাগকে পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান এবং বিচারকদের জন্য আচরণবিধি প্রণয়ন ও প্রকাশ করার বিষয়েও ঐকমত্য হয়েছে। অধস্তন আদালতের বিচারকদের চাকরির নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণভাবে সুপ্রিম কোর্টের ওপর ন্যস্ত করা হবে। নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে কার্যকরভাবে পৃথক্?করণের লক্ষ্যে সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে। এ ছাড়া, একটি স্থায়ী সরকারি অ্যাটর্নি সার্ভিস এবং স্বতন্ত্র ফৌজদারি তদন্ত সার্ভিস প্রতিষ্ঠার জন্য আইন প্রণয়ন করা হবে। বিচারকদের রাজনৈতিক আনুগত্য প্রদর্শনকে অসদাচরণ হিসেবে বিবেচনা করে ব্যবস্থা গ্রহণের বিধানও রাখা হবে।

জনপ্রশাসন ও দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার: জনপ্রশাসন সংস্কারের বিষয়ে জুলাই অভ্যুত্থানকালে গণহত্যা ও নিপীড়নের সঙ্গে জড়িত এবং ভোট জালিয়াতি ও দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের চিহ্নিতকরণে স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠনের বিষয়ে ৩২টি দল একমত হয়েছে। একটি স্বাধীন ও স্থায়ী জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন এবং তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯ ও অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট, ১৯২৩ সংশোধন করার প্রস্তাবও রাখা হয়েছে। কুমিল্লা ও ফরিদপুর নামে দুটি নতুন প্রশাসনিক বিভাগ গঠন এবং স্বতন্ত্র ভূমি আদালত স্থাপনের বিষয়েও ঐকমত্য হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সংস্কারের ক্ষেত্রে সাংবিধানিক ও আইনগত ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। একটি দুর্নীতিবিরোধী জাতীয় কৌশলপত্র প্রণয়ন এবং বৈধ উৎসবিহীন আয়কে বৈধতা দানের চর্চা চিরস্থায়ীভাবে বন্ধ করতে সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন করা হবে। উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতি ও অর্থ পাচার রোধে আইন প্রণয়ন এবং নির্বাচনী অর্থায়নে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে। দুদক কমিশনারের সংখ্যা তিন থেকে পাঁচে উন্নীত করা, তাদের মেয়াদ পাঁচ বছরের পরিবর্তে চার বছর নির্ধারণ এবং বাছাই কমিটির নাম ‘বাছাই ও পর্যালোচনা কমিটি’তে পরিবর্তন করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এই কমিটি সাত সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত হবে এবং কমিশনার নিয়োগের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করবে। দুদক আইন, ২০০৪-এর ধারা ৩২ক বিলুপ্ত করে জজ, ম্যাজিস্ট্রেট বা সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে সরকারের পূর্বানুমোদন গ্রহণের বিধান বাতিল করা হবে। এ ছাড়া, বাংলাদেশ ওপেন গভর্নমেন্ট পার্টনারশিপ (ওজিপি)-এর পক্ষভুক্ত হবে।

জুলাই সনদে সই করবে না এনসিপি: গতকাল বুধবার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে সংলাপের বিরতিতে এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেছেন, ‘অনেকে ভাবছেন জুলাই সনদে সই করা মানেই আমরা সব মেনে নিচ্ছি, এটা ভুল। আমরা মৌলিক সংস্কার এবং আইনি ভিত্তির নিশ্চয়তা ছাড়া কোনো সনদে সই করব না। আমাদের ভাইয়েরা গণঅভ্যুত্থানে জীবন দিয়েছেন। তাদের সেই আত্মত্যাগ যেন একটি বাস্তব ভিত্তির জুলাই ঘোষণাপত্রে প্রতিফলিত হয়, আমরা সেটাই চাই।’ এনসিপি সদস্যসচিব মনে করেন, জুলাই সনদ ও জুলাই ঘোষণাপত্রকে ভুলভাবে গুলিয়ে ফেলা রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত একটি প্রচারণা হতে পারে, যা এনসিপির অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। তিনি বলেন, ‘জুলাই ঘোষণাপত্র এবং জুলাই সনদ এই দুইটা আলাদা ডকুমেন্ট। কিন্তু এই দুইটা ডকুমেন্টকে গুলিয়ে ফেলছে অনেকেই, যেটা জাতীয় নাগরিক পার্টির অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।’ আখতার হোসেন ব্যাখ্যা করে বলেন, জুলাই ঘোষণাপত্র হচ্ছে গত বছরের আগস্টের গণঅভ্যুত্থান এবং ৫ আগস্টের বিজয়ের একটি ঐতিহাসিক স্বীকৃতি, যার একটি আইনি ভিত্তি থাকা দরকার। এটি একটি ঐতিহাসিক দলিল। অন্যদিকে, জুলাই সনদ হচ্ছে রাজনৈতিক সংস্কারের বিষয়ে ঐক্যমতের ভিত্তিতে কমিশনে আলোচিত প্রস্তাবগুলোর একটি বাস্তবায়নযোগ্য রূপরেখা। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা চাই না এমন একটি অকার্যকর, অপূর্ণ এবং মৌলিক সংস্কারবিহীন জুলাই সনদ তৈরি হোক, যেটা তিন দলের অতীত রূপরেখার মতো শুধু ইতিহাসের দলিল হয়ে থাকবে। আমরা চাই, জুলাই সনদটি হবে কার্যকর, পূর্ণাঙ্গ সংস্কার ধারণকারী, আইনি ভিত্তিসম্পন্ন এবং তাৎক্ষণিকভাবে বাস্তবায়নযোগ্য।’ আখতার হোসেন আরও জানান, কমিশনের প্রাথমিক খসড়ায় দুই বছরের বাস্তবায়নকালের উল্লেখ আছে যা এনসিপি দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করে। তিনি বলেন, ‘আমরা মনে করি, এ ধরনের বিলম্বিত বাস্তবায়নের প্রস্তাব প্রতারণার সুযোগ তৈরি করে এবং জনগণের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে প্রতারণা করার শামিল।’ জুলাই ঘোষণাপত্র সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমরা একবিন্দু ছাড় দিতে রাজি না। সরকার যদি ৩৬ জুলাইয়ের মধ্যে ঘোষণাপত্র জারি না করে, তাহলে এনসিপি দেশের ফ্যাসিবাদবিরোধী সব পক্ষকে সঙ্গে নিয়ে নিজেরা তা জারি করবে।’ সরকার একটি খসড়া দিয়েছে জানিয়ে আখতার বলেন, ‘আমরা সরকারকে আমাদের পক্ষ থেকে একটি পরিণত খসড়া দিয়েছি এবং আলোচনার মধ্যেই রয়েছি। কিন্তু এখনো পর্যন্ত তেমন অগ্রগতি চোখে পড়ছে না। সরকার যদি আন্তরিক হয় এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দল সমন্বয় করে, তবে ৩৬ জুলাইয়ের মধ্যেই একটি পরিপূর্ণ, আইনি ও সাংবিধানিক ভিত্তিসম্পন্ন ঘোষণাপত্র জারি করা সম্ভব।’

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত