
বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। তবে, একমাস যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনের সঙ্গে বাংলাদেশের শীর্ষপর্যায়ের প্রতিনিধিদলের কয়েক দফা বৈঠকে দর কষাকষি করে ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশে শুল্ক আরোপ আনা হয়েছে। রপ্তানি পণ্যের ওপর ১৫ শতাংশ শুল্ক কমায় বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে বড় সফলতা দেখছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা।
জানা গেছে, স্থানীয় সময় গত বৃহস্পতিবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক নির্বাহী আদেশে নতুন শুল্ক হার ঘোষণা করা হয়। ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশ হোয়াইট হাউসের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। পাল্টা শুল্ক কমাতে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির (ইউএসটিআর) সঙ্গে টানা তিনদিন আলোচনা করেন বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের সদস্যরা। গত মঙ্গল, বুধবার ও বৃহস্পতিবার দুই দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক হয়। এ সময়ে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বে ছিলেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। এছাড়া দলে ছিলেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান, বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নাজনীন কাউসার চৌধুরী। গতকাল শুক্রবার বাংলাদেশি পণ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ২০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেছেন, ‘বাংলাদেশের ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করায় আমরা প্রতিযোগিতামূলক অবস্থায় থাকব। যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবে আমরা ২০ শতাংশের নিচে প্রত্যাশা করেছিলাম।’ প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম তার ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে দেওয়া এক স্ট্যাটাসে এ তথ্য জানান। শুল্ক আলোচনায় বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিয়েছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন।
অন্তর্বর্তী সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টার নেতৃত্বে মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক হয়। বৈঠকে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেছেন বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এক পোস্টে উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেছেন, ‘দেশের অভ্যন্তরীণ পণ্যমূল্য স্থিতিশীলতা বজায় রাখা থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সফল শুল্ক আলোচনায় তিনি (বাণিজ্য উপদেষ্টা) নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেছেন, সমালোচকদের হতাশ করে।’ ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপের বিষয়টিকে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম সফলতা হিসেবে দেখছেন আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। গতকাল নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেওয়া এক পোস্টে আসিফ নজরুল লেখেন, ‘১৫ শতাংশ কমিয়ে বাংলাদেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক ২০ শতাংশ। অ্যানাদার সাকসেস অব ইন্টেরিম গভর্নমেন্ট’।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নেওয়া বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও প্রধান আলোচক খলিলুর রহমান বলেছেন, ‘আমাদের জাতীয় স্বার্থ ও সক্ষমতার সঙ্গে আমাদের প্রতিশ্রুতিগুলো সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না, তা নিশ্চিত করার জন্য আমরা সাবধানতার সঙ্গে আলোচনা করেছি। আমাদের পোশাকশিল্পকে রক্ষা করা একটি শীর্ষ অগ্রাধিকার ছিল। তবে আমরা মার্কিন কৃষিপণ্যের ওপর আমাদের ক্রয় প্রতিশ্রুতিও কেন্দ্রীভূত করেছি। এটি আমাদের খাদ্যনিরাপত্তা লক্ষ্যগুলোকে সমর্থন করে এবং মার্কিন কৃষিপ্রধান রাজ্যগুলোর জন্য সদিচ্ছা প্রতিফলিত করে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আজ আমরা সফলভাবে ৩৫ শতাংশ পারস্পরিক শুল্ক এড়িয়েছি। এটি আমাদের পোশাক খাত এবং এর ওপর নির্ভরশীল লাখো মানুষের জন্য সুসংবাদ। আমরা আমাদের বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানও সংরক্ষণ করেছি এবং বিশ্বের বৃহত্তম ভোক্তা বাজারে প্রবেশের জন্য নতুন সুযোগ খুলে দিয়েছি।’
বাণিজ্য ঘাটতির কথা উল্লেখ করে গত ২ এপ্রিল বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ওপর উচ্চহারে পাল্টা শুল্ক আরোপ করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তখন বাংলাদেশের ওপর ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছিল। পরে ৯ এপ্রিল বিভিন্ন দেশের ওপর ওই শুল্ক তিন মাসের জন্য স্থগিত করা হয়। এ সময় শুল্ক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিভিন্ন দেশকে আলোচনার সুযোগ দেয় ওয়াশিংটন। যুক্তরাষ্ট্রের তিন মাসের সময়সীমা গত ৯ জুলাই শেষ হয়। এর আগের দিন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে চিঠি দিয়ে ট্রাম্প জানান, বাংলাদেশের পাল্টা শুল্ক ২ শতাংশ কমিয়ে ৩৫ শতাংশ করা হয়েছে। যদিও ৯ জুলাইয়ের পর পাল্টা শুল্ক কার্যকর করেনি মার্কিন প্রশাসন। শুল্কের হার কমাতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি বাণিজ্য চুক্তির জন্য ৩১ জুলাই পর্যন্ত বিভিন্ন দেশকে সময় দেওয়া হয়। সেই সময়সীমার মধ্যে মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের কয়েক দফা বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে গতকাল শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে বাংলাদেশের ওপর শুল্ক আরোপ করে।
কোন দেশে কত শুল্ক বসালেন ট্রাম্প : যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাহী আদেশে বাংলাদেশ ছাড়াও নতুন করে কয়েকটি দেশের ওপর মার্কিন শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। অন্য দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তানের ওপর ১৯ শতাংশ, আফগানিস্তানের ওপর ১৫, ভারতের ওপর ২৫ শতাংশ, আলজেরিয়া ৩০ শতাংশ, অ্যাঙ্গোলা ১৫ শতাংশ, বলিভিয়া ১৫ শতাংশ, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা ৩০ শতাংশ, বতসোয়ানা ১৫ শতাংশ, ব্রাজিল ১০ শতাংশ, ব্রুনেই ২০ শতাংশ, কম্বোডিয়া ১৯ শতাংশ, ক্যামেরুন ১৫ শতাংশ, চাদ ১৫ শতাংশ, কোস্টারিকা ১৫ শতাংশ, কোট দিভোয়ার (আইভরি কোস্ট) ১৫ শতাংশ, কঙ্গো গণপ্রজাতন্ত্রী ১৫ শতাংশ, ইকুয়েডর ১৫ শতাংশ, ইকুয়েটোরিয়াল গিনি ১৫ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়া ১৯ শতাংশ, ইরাক ৩৫ শতাংশ, ইসরায়েল ১৫ শতাংশ, জাপান ১৫ শতাংশ, জর্ডান ১৫ শতাংশ, কাজাখস্তান ২৫ শতাংশ, লাওস ৪০ শতাংশ, ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ ১০ শতাংশ, ফিজি ১৫ শতাংশ, ঘানা ১৫ শতাংশ, গায়ানা ১৫ শতাংশ, আইসল্যান্ড ১৫ শতাংশ, লেসোথো ১৫ শতাংশ, লিবিয়া ৩০ শতাংশ, লিচটেনস্টেইন ১৫ শতাংশ, মাদাগাস্কার ১৫ শতাংশ, মালাউই ১৫ শতাংশ, মালয়েশিয়া ১৯ শতাংশ, মরিশাস ১৫ শতাংশ, মলদোভা ২৫ শতাংশ, মোজাম্বিক ১৫ শতাংশ, মিয়ানমার (বার্মা) ৪০ শতাংশ, নামিবিয়া ১৫ শতাংশ, নাউরু ১৫ শতাংশ, নিউজিল্যান্ড ১৫ শতাংশ, নিকারাগুয়া ১৮ শতাংশ, নাইজেরিয়া ১৫ শতাংশ, নর্থ মেসেডোনিয়া ১৫ শতাংশ, নরওয়ে ১৫ শতাংশ, পাপুয়া নিউগিনি ১৫ শতাংশ, ফিলিপাইন ১৯ শতাংশ, সার্বিয়া ৩৫ শতাংশ, দক্ষিণ আফ্রিকা ৩০ শতাংশ, দক্ষিণ কোরিয়া ১৫ শতাংশ, শ্রীলঙ্কা ২০ শতাংশ, সুইজারল্যান্ড ৩৯ শতাংশ, সিরিয়া ৪১ শতাংশ, তাইওয়ান ২০ শতাংশ, থাইল্যান্ড ১৯ শতাংশ, ত্রিনিদাদ ও টোবাগো ১৫ শতাংশ, তিউনিসিয়া ২৫ শতাংশ, তুরস্ক ১৫ শতাংশ, উগান্ডা ১৫ শতাংশ, যুক্তরাজ্য ১০ শতাংশ, ভানুয়াতু ১৫ শতাংশ, ভেনেজুয়েলা ১৫ শতাংশ, ভিয়েতনাম ২০ শতাংশ, জাম্বিয়া ১৫ শতাংশ এবং জিম্বাবুয়ে ১৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।