ঢাকা শনিবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ২১ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

অনিশ্চিত প্রত্যাবাসন কোণঠাসা স্থানীয়রা

অনিশ্চিত প্রত্যাবাসন কোণঠাসা স্থানীয়রা

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইনে সেনা অভিযানের পর বাংলাদেশে পালিয়ে আসে ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গা নাগরিক। উখিয়া-টেকনাফের পাহাড়ি বনভূমিজুড়ে গড়ে ওঠে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবির। মানবিক সহায়তার হাত প্রসারিত হলেও আট বছর পর সংকটটি শুধু মানবিক নয়-নিরাপত্তা, সামাজিক ও পরিবেশগত এক বহুমাত্রিক সমস্যায় রূপ নিয়েছে।

বিশ্লেষক ও স্থানীয়দের মতে, বর্তমান সংকটকে তিনটি ভাগে দেখা যায়- ক্যাম্পে সশস্ত্র গোষ্ঠীর দাপট ও অপরাধ বিস্তার; মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের অনিশ্চয়তা; অতিরিক্ত জনচাপে স্থানীয় জনগণের দুর্ভোগ ও নিরাপত্তাহীনতা।

ক্যাম্পে সশস্ত্র গোষ্ঠীর আতঙ্ক : আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও স্থানীয় সূত্র জানায়, ক্যাম্পে সক্রিয় রয়েছে অন্তত সাতটি বড় সশস্ত্র সংগঠন-আরসা, এআরএ, আরএসও, এআরএসও, আরাকান রোহিঙ্গা লিবারেশন আর্মি, কোম্পানি গ্রুপ ও ইসলামী মাহাজ। এর বাইরে আছে অর্ধশতাধিক ডাকাত গ্রুপ।

তাদের মধ্যে আধিপত্য বজায় রাখা ও মাদক-অস্ত্র নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে নিয়মিত সংঘর্ষ হচ্ছে। এতে প্রাণ হারাচ্ছেন সাধারণ রোহিঙ্গারা।

ক্যাম্পের কয়েকজন বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, কর্মসংস্থান নেই, স্কুল-কলেজ নেই, বাইরে কাজ করতে পারি না। যারা শক্তিশালী, তারা অস্ত্র কিনে দল গড়ে তোলে, আর আমরা বাঁচতে হলে তাদের কথাই শুনি।

৬০ বছরের আবদুল গফুর বলেন, ‘যদি কোনো দলে যোগ দিই, প্রতিপক্ষ নির্যাতন করে। আবার কোনো দলের সদস্য না হলে সবার ভয়ে বাঁচা দায়।’

কক্সবাজার জেলা পুলিশের তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি-জুন পর্যন্ত ক্যাম্পে খুন, মাদক, অপহরণ ও ধর্ষণসহ ২৩১টি মামলা হয়েছে। এ সময়ে ২০ জনের বেশি খুনের ঘটনা ঘটে। গত আট বছরে খুন হয়েছে তিন শতাধিক রোহিঙ্গা।

কক্সবাজার জেলা পুলিশের মিডিয়া কর্মকর্তা ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. জসীম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ক্যাম্পে অপরাধের মূল কারণ আধিপত্য বিস্তার ও মাদক ব্যবসা। জেলা পুলিশ মামলা তদন্ত, অপরাধিদের গ্রেপ্তারে প্রধান দায়িত্ব পালন করে। ক্যাম্পের ভেতরে এপিবিএনকে সহায়তা প্রদান করেন। পুলিশ, র‌্যাব সহ অন্যান্য আইন শৃঙ্খলা বাহিনী মিলে সর্তকভাবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।

প্রত্যাবাসনের পথে নতুন অনিশ্চয়তা : আন্তর্জাতিক চাপ ও আলোচনার নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে কোনো অগ্রগতি হয়নি। বরং পরিস্থিতি আরও অনিশ্চিত হয়ে উঠেছে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর থেকে রাখাইনের ৯০ শতাংশ এলাকা বিদ্রোহী গোষ্ঠি আরাকান আর্মির দখলে। ফলে মিয়ানমার সরকারের হাতে রোহিঙ্গা বসতির কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। অনেক গ্রামই উধাও হয়ে গেছে।

বালুখালী ক্যাম্পের আবদুল মালেক জানান, ‘আমাদের গ্রাম সুদাপাড়া একসময় রোহিঙ্গায় ভরা ছিল। এখন সেখানে একজনও নেই। গ্রামটাই মুছে গেছে।’ অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর বলেন, ‘মিয়ানমারের নিয়ন্ত্রণহীন এলাকায় রোহিঙ্গাদের পাঠানো নিরাপদ হবে না। বরং সীমান্তে নতুন অনুপ্রবেশের ঝুঁকি বাড়ছে।’

গত দেড় বছরে আরও ১ লাখ ২০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। সীমান্তে অপেক্ষমাণ রয়েছে অন্তত ৫০ হাজার।

স্থানীয়দের দুর্ভোগ চরমে : রোহিঙ্গা সংকটের সরাসরি প্রভাব পড়ছে স্থানীয়দের জীবনে। উখিয়া ও টেকনাফে স্থানীয় জনসংখ্যা যেখানে ৫ লাখেরও কম, সেখানে বসবাস করছে প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গা। প্রতিনিয়ত খুন, অপহরণ ও গুমের ঘটনায় আতঙ্কে দিন কাটছে স্থানীয়দের। এছাড়া উখিয়ার সড়কে প্রতিদিন তীব্র যানজট; ক্যাম্পের বর্জ্যে জমি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। পাহাড় কেটে বসতি, বন উজাড় ও বর্জ্যের স্তুপ পরিবেশকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে।

পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এম এ গফুর উদ্দিন বলেন, “উখিয়া-টেকনাফে ছোট্ট আয়তনে অস্বাভাবিক জনসংখ্যার চাপ পড়েছে। সমাধানের একমাত্র পথ প্রত্যাবাসন।”

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সময় যত গড়াচ্ছে সংকট তত গভীর হচ্ছে। হতাশ তরুণরা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে, মাদক ও অস্ত্র ব্যবসা বাড়ছে।

আসিফ মুনীর সতর্ক করে বলেন, রোহিঙ্গা তরুণদের সচেতন না করলে ও আন্তর্জাতিক মহলে চাপ তৈরি না করলে এই সংকট একদিন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত