
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন জমে উঠেছে। প্রার্থীরা ভোটারদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে ভোট চাচ্ছেন, আর নিজেদের আগামীর পরিকল্পনার বিষয়গুলো তুলে ধরছেন। সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনের বটতলায় আসন্ন ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে ঘোষিত ইশতেহারে এই অঙ্গীকার করেছে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল-সমর্থিত প্যানেল। এ ছাড়া সংবাদ সম্মেলন করে শিক্ষার্থীবান্ধব নিরাপদ ক্যাম্পাস গড়ে তুলতে মোট ১০ দফা অঙ্গীকার করেছে প্যানেলটি।
তারা বলছেন, বহিরাগত নিয়ন্ত্রণ করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাকে তিনটি অঞ্চলে (সবুজ, হলুদ ও লাল) ভাগ করার ঘোষণা দিয়েছে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেল। সংবাদ সম্মেলনে এই প্যানেলের জিএস প্রার্থী শেখ তানভীর বারী হামিমের সঞ্চালনায় ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান ইশতেহারের এসব অঙ্গীকার তুলে ধরেন। এ সময় ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের এজিএস প্রার্থী তানভীর আল হাদী মায়েদসহ অন্য প্রার্থীরা উপস্থিত ছিলেন। ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থাকে আরও যুগোপযোগী, আধুনিক, নিরাপদ ও শিক্ষার্থীবান্ধব ক্যাম্পাস গড়ে তুলতে আমরা ১০ দফা ইশতেহার ঘোষণা করছি। আমরা বিশ্বাস করি, এই ইশতেহারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মতামত প্রতিফলিত হয়েছে। আমরা নির্বাচিত হলে এগুলো বাস্তবায়নে চেষ্টা করব।’
দশ দফা ইশতেহার : জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল-সমর্থিত প্যানেলের ১০ দফা ইশতেহারের মধ্যে রয়েছে- শিক্ষা ও গবেষণাকে প্রাধান্য দিয়ে আধুনিক, আনন্দময়, বসবাসযোগ্য ও নিরাপদ ক্যাম্পাস গড়ে তোলা। ২. নারী শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপদ ক্যাম্পাস, নারী স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। ৩. শিক্ষার্থীদের জন্য মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা ও স্বাস্থ্যবিমা নিশ্চিত করা এবং বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা গ্রহণ ও চলাচল সহজতর করা। ৪. কারিকুলাম, অবকাঠামো ও পরীক্ষা ব্যবস্থার আধুনিকায়ন এবং গবেষণার মানোন্নয়ন করা। ৫. পরিবহনব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ, ব্যাটারিচালিত শাটল বাস সার্ভিস প্রচলন এবং যাতায়াতব্যবস্থা সহজ করা। ৬. হয়রানিমুক্ত প্রশাসনিক সেবা, শিক্ষাঋণ ও ক্যাম্পাসভিত্তিক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। ৭. তরুণদের গঠনমূলক কাজে সম্পৃক্তকরণ এবং ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম বৃদ্ধি করা। ৮. শিক্ষার্থীদের জন্য ডিজিটাল সুবিধা, সাইবার সিকিউরিটি ও সাইবার বুলিং প্রতিরোধ করা। ৯. বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ সংরক্ষণ, সবুজায়ন ও প্রাণীবান্ধব ক্যাম্পাস তৈরি করা। ১০. কার্যকর ডাকসু ও আন্তর্জাতিক পরিসরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি করা। ইশতেহারের পঞ্চম দফায় পরিবহনব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ, ব্যাটারিচালিত শাটল বাস সার্ভিস প্রচলন এবং যাতায়াতব্যবস্থা সহজ করা অংশে ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাকে গ্রিন, ইয়েলো ও রেড জোনে ভাগ করে যানবাহন ও বহিরাগত নিয়ন্ত্রণ করা হবে। গ্রিন জোনে ঢাকা মেডিকেল, বাংলা একাডেমি ইত্যাদি জনবহুল জায়গা থাকবে। ইয়েলো জোনে অডিটরিয়ামের মতো এরিয়া, যেখানে অতিথি, অ্যালামনাই ও অন্য ব্যক্তিরা যথাযথ পরিচয় প্রদানের মাধ্যমে প্রবেশ করতে পারবেন। আর রেড জোনে আবাসিক ও একাডেমিক এরিয়া, যেখানে বহিরাগতদের প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হবে।’ ইশতেহারের প্রথম দফায় শিক্ষা ও গবেষণাকে প্রাধান্য দিয়ে আধুনিক, আনন্দময়, বসবাসযোগ্য ও নিরাপদ ক্যাম্পাস গড়ে তোলা অংশে আবিদুল ইসলাম বলেন, গেস্টরুম–গণরুম সংস্কৃতি, জোরপূর্বক রাজনৈতিক কর্মসূচি ও দমন নিপীড়নের মতো ঘৃণিত চর্চা বন্ধ করে ক্যাম্পাসকে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও দখলদারত্ব থেকে চিরকালের জন্য মুক্ত করা হবে। এ ছাড়া ১০ দফা ইশতেহারে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সংকট সমাধানে বিস্তারিত পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়েছে।
ডাকসু নির্বাচনে সেনাবাহিনীর প্রয়োজন নেই : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে সেনাবাহিনীর প্রয়োজন নেই বলে জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন। গতকাল বৃহস্পতিবার তিনি এ কথা জানান। অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা ব্যবস্থা কেমন হবে, তা আমরা শিক্ষার্থীদের জানিয়েছি। এটি ব্যবস্থা করার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের। তারা সেনাবাহিনী আনবেন, না অন্য ফোর্স আনবেন, এটি তারা জানেন। এ বিষয়ে বিচলিত হওয়ার মতো কিছু দেখছি না। তিনি আরও বলেন, এখানে শিক্ষার্থীরাই ভোট দেবেন। সেনাবাহিনীর প্রয়োজন নেই। গতকাল এক বিজ্ঞপ্তিতে আইএসপিআর জানিয়েছে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আসন্ন কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনে সেনাবাহিনীর সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ নেই। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সম্প্রতি বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আসন্ন কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী মোতায়েন সংক্রান্ত বিবিধ সংবাদ প্রচারিত হচ্ছে, যা সেনাবাহিনীর নজরে এসেছে। আইএসপিআর জানায়, সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে এসব নির্বাচনে দায়িত্ব পালনের বিষয়ে কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের কোনো দায়িত্বে সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ নেই।
বিজয়ী হলে কালচারাল ফ্যাসিবাদের কবর রচনা করবো- সাদিক কায়েম : আসন্ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে বিজয়ী হতে পারলে কালচারাল ফ্যাসিবাদের কবর রচনার ঘোষণা দিয়েছেন ছাত্রশিবির সমর্থিত ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের ভিপি পদপ্রার্থী আবু সাদিক কায়েম। গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) বটতলায় ডাকসুর সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেন তিনি। এ সময় প্যানেলের জিএস পদপ্রার্থী এস এম ফরহাদ, এজিএস পদপ্রার্থী মহিউদ্দিন খানসহ অন্য প্রার্থীরা উপস্থিত ছিলেন।
সাদিক কায়েম বলেন, জুলাই বিপ্লবের পরে আমরা রাজনৈতিক আজাদি পেলেও সাংস্কৃতিক আজাদি পাইনি। পতিত স্বৈরাচারের দোসররা এখনো নানাভাবে ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। তারা ইসলামিক সিম্বলগুলো এখনো হিউমিলিয়েট করছে। আমরা বিজয়ী হলে ইসলামিক সিম্বলগুলো সমাজে স্বাভাবিক রূপদান করবো।
তিনি বলেন, আমরা বিজয়ী হলে কালচারাল ফ্যাসিবাদের কবর রচনা করবো। আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কালচারাল সেন্টারের হাব হয়ে উঠবে। এটি হবে একটি মাল্টিকালচারাল ইনস্টিটিউশন। এখানে হিন্দু-বৌদ্ধ, চাকমা-মারমাসহ সবাই মুক্তভাবে তাদের ধর্মচর্চা করতে পারবে।
তিনি আরও বলেন, আজ আমরা কলাভবনের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাদের যাবতীয় সমস্যা নিয়ে কথা বলেছি। এখানে ক্লাসরুম সংকট, পুরোনো লিফটসহ বেশ কিছু সমস্যা চিহ্নিত করেছি। এছাড়া কমনরুমে নারী স্টাফ না থাকা একটি বড় সমস্যা।
নির্বাচিত হলে এসব সমস্যা সমাধানে আমরা সর্বাত্মক কাজ করবো। তিনি অভিযোগ করে বলেন, আমরা প্রশাসনের পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণ দেখে আশঙ্কা প্রকাশ করছি। তারা বারবার আমাদের হতাশ করছেন। আমরা তাদের কাছ থেকে স্বচ্ছতা আশা করি।
এ সময় জিএস পদপ্রার্থী এস এম ফরহাদ বলেন, আমরা যেসব পোস্টার লাগিয়েছি সেগুলো নিয়ম মেনেই লাগিয়েছি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন হঠাৎ করে নিয়ম বদলানোয় ঝামেলা বেধেছে। নির্বাচনে সেনাবাহিনীর অন্তর্ভুক্তি নিয়ে তিনি বলেন, অনেক ছাত্র সংগঠনই এ নিয়ে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করে। সেনাবাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সব স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে পরামর্শ করা দরকার ছিল।