
আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন হবে বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সেই ফেব্রুয়ারিকেই টার্গেট করে ডিসেম্বরের শুরুতে তফসিল আর ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ভোটের সময় ধরে সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে নির্বাচন কমিশন ভবনে কমিশন সচিব আখতার আহমেদ ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটের প্রস্তুতি নিয়ে বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনা বা রোডম্যাপ ঘোষণা করেন। এরআগে গত বুধবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার এএমএম নাসির উদ্দিনের নেতৃত্বে নির্বাচন কমিশন এই রোডম্যাপ অনুমোদন করেন। ২৪টি কাজের পরিকল্পনার মধ্যে সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে রাজনৈতিক দলসহ অংশীজনদের সঙ্গে সংলাপের কথাও রয়েছে। সংলাপ, মতবিনিময়, মিটিং, ব্রিফিং, প্রশিক্ষণ, মুদ্রণ, বাজেট বরাদ্দ, আইটিভিত্তিক প্রস্তুতি, প্রচারণা, সমন্বয় সেল, আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক থেকে যাবতীয় কর্মপরিকল্পনা মাথায় রেখে উল্লেখযোগ্য খাত ও বাস্তবায়ন সূচি রোডম্যাপে স্থান পেয়েছে। তবে নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে দলগুলোর মধ্যে যখন নানা মত তখন রোডম্যাপ ঘোষণা হলেও শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়ন কতটা সম্ভব হবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ রোডম্যাপ ঘোষণার পর বিএনপি যখন স্বস্তি প্রকাশ করছেন তখন পুরোপুরি ভিন্ন মত জামায়াতের। নির্বাচন ইস্যুতে বিএনপি-জামায়াত এখন অনেকটা দুই মেরুতে অবস্থান করছে।
রোডম্যাপ ঘোষণার পর এক প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘আমরা খুশি, উই আর হ্যাপী।’ তিনি বলেন, যথাযথ সময়ে রোডম্যাপটি ঘোষণা করা হয়েছে। সরকারের দিক থেকেও একই রকম নির্দেশনা ছিল। এখন রোডম্যাপ অনুযায়ী জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেওয়া হবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা। আর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণায় জাতির প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে। এই বিষয়টিকে তারা ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন।
তবে বিএনপি যখন খুশির কথা বলছে, তখন রোডম্যাপকে অপরিপক্ব সিদ্ধান্ত আখ্যা দিয়ে জামায়াতের পক্ষ থেকে এর প্রতিক্রিয়া দেওয়া হয়েছে। দলটির সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, নির্বাচন কমিশন কর্তৃক ঘোষিত রোডম্যাপ গতানুগতিক এবং কিছুটা বিভ্রান্তিমূলক। এতে জনপ্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটেনি। তিনি আরও বলেন, জুলাই বিপ্লবের স্পিরিট ধারণ করে দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজনে জুলাই জাতীয় সনদের আইনি ভিত্তি প্রদান এবং এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করে রোডম্যাপ ঘোষণা করা উচিত ছিল বলে আমরা মনে করি।
এদিকে, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ঘোষিত সময় অনুযায়ী নির্বাচন হওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। এই সময় অনুযায়ী নির্বাচন না হলে জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, আর ফ্যাসিবাদ ফেরার আশঙ্কা বাড়বে। এ বিষয়ে শুধু দেশে নয়, বিদেশেও কাজ চলছে। গতকাল শুক্রবার সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবে এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
নেতাকর্মীদের সতর্ক করে মির্জা ফখরুল বলেন, মনে করবেন না, আপনারা ক্ষমতায় চলে এসেছেন। এখনও ক্ষমতার কাছেও পৌঁছাতে পারেননি। সামনে অনেক চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র রয়েছে। জনগণের আস্থা পেতে হলে ভালো কাজের মাধ্যমে তাদের কাছে যেতে হবে।
গণতান্ত্রিক উত্তরণের রোডম্যাপের কথা উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো একসঙ্গে এগিয়ে নিলে আমরা লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব। আমি একসময় হতাশার কথা বলেছিলাম, তখন কাছের মানুষই ভর্ৎসনা করেছিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, আমাদের লড়াই যেন ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে যাচ্ছে। রাজনীতিতে মতভেদ থাকাটাই স্বাভাবিক। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছে, নির্বাচন নিয়ে তাদের মনে শঙ্কা রয়েছে।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনই কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্রব্যবস্থায় ফেরার একমাত্র সুযোগ। সংস্কারের কথা প্রথম বিএনপিই বলেছে। জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতন্ত্র ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, খালেদা জিয়া সংসদীয় গণতন্ত্র এনেছেন। অথচ কেউ কেউ ভুল প্রচারণা চালিয়ে বিএনপিকে সংস্কারবিরোধী হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করছে। তিনি আরও বলেন, কিছু রাজনৈতিক দল মিথ্যা প্রচারণা করে বিএনপিকে হেয় করতে চায়। বিএনপির কেউ এমন কোনো কাজ করবে না, যাতে জনগণ তাদের খারাপ বলতে পারে। পরিবর্তনের জন্য মানুষ উন্মুখ হয়ে আছে, আর সেই পরিবর্তন এনে দেওয়ার দায়িত্ব বিএনপিকেই নিতে হবে।
এসময় বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য, কবি ও সাংবাদিক আবদুল হাই শিকদারের সভাপতিত্বে প্রধান বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন- বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য ড. মাহদী আমিন। এছাড়া দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের শীর্ষ নেতাসহ সাহিত্যপ্রেমী অতিথিরা উপস্থিত ছিলেন।
অপরদিকে, নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা একটি সুষ্ঠু নির্বাচন ভণ্ডুলের নীলনকশা বলে মন্তব্য করেছেন জামায়াতে ইসলামির নায়েবে আমির ও সাবেক সংসদ সদস্য ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। গতকাল শুক্রবার কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার কালির বাজার ইউনিয়নে নির্বাচনী দায়িত্বশীল সমাবেশে তিনি এ মন্তব্য করেন। ডা. তাহের বলেন, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন নিয়ে জামায়াতের কোনো আপত্তি নেই। আমরা ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনের জন্যই প্রস্তুতি নিচ্ছি। কিন্তু একটি সুষ্ঠু অবাধ নির্বাচনের জন্য কিছু বিষয় সুরাহা হওয়া খুবই জরুরি। এরমধ্যে জুলাই চার্টারকে আইনগত ভিত্তি দিতে হবে এবং এর ভিত্তিতেই ফেব্রুয়ারির নির্বাচন দিতে হবে। কিন্তু সেগুলো না করেই নির্বাচনের যে পথ নকশা ঘোষণা করা হয়েছে সেটি একটি সুষ্ঠু নির্বাচন ভণ্ডুল করার নীল নকশা বলে মনে করি। তিনি আরও বলেন, আমরা সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে বাধ্য করবো জুলাই চার্টার রিফান্ড ও পিআরের মাধ্যমে নির্বাচন করতে। এছাড়া আগের ট্র্যাডিশনাল পদ্ধতি ও নতুন প্রস্তাবিত পিআর, দুটার মধ্যে একটি নির্ধারণ না হওয়া পর্যন্ত রোড ম্যাপ ঘোষণা করার নির্বাচন কমিশনের বড় ধরনের অপরাধ। এজন্য নির্বাচন কমিশনকে দেশবাসীর প্রতি ক্ষমা চাওয়ারও আহ্বান জানাবো। তিনি বলেন, বাংলাদেশে জনগণ একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের অপেক্ষায় আছে। আগামী নির্বাচন যদি সুষ্ঠু হয়, তা হলে চাঁদাবাজবিরোধী শক্তি, দখলবাজবিরোধী শক্তি, দুর্নীতিবিরোধী শক্তি, ভারতীয় আধিপত্যবাদবিরোধী শক্তিকে দেশের মানুষ বিপুল ভোটে নির্বাচিত করবে। এই নির্বাচনের মাধ্যমে আমরা একটি নতুন বাংলাদেশ গড়বো।
সূত্রমতে, ঐকমত্য কমিশনের বাইরে বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে। উদ্দেশ্য, দুটি দলের মধ্যে সৃষ্ট বিরোধের অবসান। ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় নানা বিষয়েই দল দু’টির মধ্যে ফারাক তৈরি হয়েছে। জামায়াত অনেকগুলো শর্তারোপ করেছে। এর মধ্যে পিআর পদ্ধতি, সংস্কার, বিচার এবং জুলাই সনদ নিয়ে প্রকাশ্য মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। যে কারণে অনেকেই যথাসময়ে নির্বাচন প্রশ্নে সংশয় প্রকাশ করছেন। পর্দার আড়ালে একটি মহল এই দুই দলের মধ্যে মতবিরোধ কমিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে।
জানা যায়, এরই লক্ষ্যে গত মঙ্গলবার দুই দলের মধ্যে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে বিএনপির পক্ষে একজন এবং জামায়াতের পক্ষে দুইজন শীর্ষস্থানীয় নেতা উপস্থিত ছিলেন। ঘণ্টা দুয়েক আলোচনার পর অনেক বিষয়েই তারা একমত হতে পারেননি। ফলে মাঝপথেই আলোচনা থেমে গেছে। নিকট ভবিষ্যতে আর কোনো বৈঠক হবে কি না, এ নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। ওদিকে নির্বাচন কমিশন ঘোষিত রোডম্যাপের ব্যাপারেও জামায়াতে ইসলামী ভিন্নমত দিয়েছে। তারা বলেছে, এই রোডম্যাপ অস্পষ্ট। আর বিএনপি সরাসরি স্বাগত জানিয়েছে। এখানেও বিরোধ দৃশ্যমান। এই পর্যায়ে জামায়াত কী করবে, এখনই বলা মুশকিল। তবে নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্রে জানা গেছে, জামায়াত নেতারা বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে কথা বলার আগ্রহ ব্যক্ত করেছেন।