ঢাকা শনিবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ২১ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

সিলেটের পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে কমছে পর্যটক

সিলেটের পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে কমছে পর্যটক

পাহাড়, ঝরনা, নদী, হাওর, চা বাগান, অরণ্য জলাধার নিয়ে প্রকৃতির এক অপরূপ লীলাভূমি সিলেট। প্রকৃতির এই সৌন্দর্য আর বৈচিত্র্যতার কারণে পর্যটকদের অন্যতম পছন্দের স্থান সিলেট। এরই মধ্যে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জে সাদাপাথর অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটনস্পট হিসেবে স্বীকৃতি আদায় করেছে। ধলাই নদীর ধবধবে পানি আর সাদা পাথরে মন ছুয়ে যায় পর্যটকদের। এছাড়া পৃথিবীর মিঠা পানি ২২টি জলাবনের একটি সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার রাতারগুল জলাবন। এই জলাবন পর্যটকদের কাছে সবসময়ই রোমাঞ্চকর। বনের ভেতরে নৌকার ভ্রমণের সময় নানা প্রজাতির সাপ, প্রাণী ও বিভিন্ন পাখিদের মধুর ডাক রোমাঞ্চিত করে পর্যটকদের। এছাড়া একই উপজেলার বিছনাকান্দি, জাফলং পর্যটকদের বিমোহিত করে। এসব পর্যটনস্পটের সৌন্দর্য উপভোগ করতে অসংখ্য পর্যটক আসেন সিলেটে। এছাড়াও হয়রত শাহজালাল (রহ.) ও হযরত শাহপরাণ (রহ.)-এর মাজার এবং চা বাগানের সবুজ দৃশ্য মন কাড়ে পর্যটকদের। সম্প্রতি, সাদাপাথরসহ কয়েকটি পর্যটনকেন্দ্রে পাথর ও বালু লুটের ঘটনায় দেশ ও বিদেশে আলোচনার জন্ম দেয়। এসব কর্মকাণ্ডের পর সিলেটে কমেছে পর্যটকদের আগমন। এছাড়াও অনুন্নত অবকাঠামো, যাতায়াত ব্যবস্থা, জরাজীর্ণ সড়ক, নিরাপত্তাহীনতা, অব্যবস্থাপনা, সঠিক পরিকল্পনার অভাব, প্রচারের অভাব ও পর্যটনবান্ধব দক্ষ জনশক্তি না থাকায় পর্যটন বিকাশে অন্যতম বাধা বলে মনে করছেন, এ খাতের সংশ্লিষ্টরা।

সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব থাকায় সিলেটে অঞ্চলে পর্যটনশিল্পের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বর্তমানে ঢাকা-সিলেট হাইওয়ে দীর্ঘ যানজটের কারণে সিলেট পৌঁছাতে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে পর্যটকদের। পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে অপরিকল্পিতভাবে পর্যটকদের আনাগোনা ও অপর্যাপ্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কারণে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। এছাড়া অবাধে বালু ও পাথর লুটপাটে পর্যটনকেন্দ্রগুলোর সৌন্দর্যহানীর কারণে কমছে পর্যটক।

সিলেট থেকে সড়ক পথে কোম্পানীগঞ্জের সাদাপাথর দূরত্ব প্রায় ৩৫ কিলোমিটার। সেখান থেকে ভোলাগঞ্জ ১০ নম্বর পর্যটন বাজারে গিয়ে নামতে হয়। আবার ইঞ্জিন নৌকাযোগে এক কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে পৌঁছাতে হয় সাদাপাথর স্পটে। সেখানেও রয়েছে সিন্ডিকেটের দাপট। নৌকা দিয়ে আসা-যাওয়া করতে হলে একজন হলে ৮০০ টাকা আবার ৮ জন হলেও একই টাকা দিতে হয়। বেশি টাকা দিয়ে নৌকা ভাড়া করতে হয় বলে অনেকেই স্পটে যান না। স্থানীয় প্রশাসন কর্তৃক নৌকা চলাচলের ব্যবস্থা থাকলে সাদাপাথরে পর্যটকদের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাবে। দেশের জনপ্রিয় এই পর্যটনকেন্দ্রে নেই কোনো বাথরুম কিংবা ভেজাকাপড় পরিবর্তনের নির্দিষ্ট রুম, নেই বিশুদ্ধ খাবার পানির ব্যবস্থা। নেই কোনো মানসম্পন্ন আবাসিক হোটেল ও ভালো মানের খাবারের রেঁস্তোরা। গত চার বছর আগে সাদাপাথরে একটি বাথরুম করা হয়েছিল, যা গত বন্যায় পাহাড়ী ঢলের ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে। পর্যটকদের গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য নিরাপত্তার সমস্যা রয়েছে। শুধু টাকা নিয়ে রশিদ দিয়েই দায় শেষ করেন ইজারাদাররা। সীমানা নির্ধারণ করা হয়নি পার্কিংয়ের। অনেক সময় মাইকিং করে নিজ দায়িত্বে গাড়ি রাখার ঘোষণা দেন তারা।

এদিকে গত ২৭ সেপ্টেম্বর সাদাপাথরে পার্কিং এলাকা থেকে এক পর্যটকের প্রাইভেট কার চুরি হয়ে যায়। ভোক্তভোগী পর্যটক জানান, সকাল ৭টার দিকে তারা একটি প্রিমিও প্রাইভেট কার (ঢাকা মেট্রো-গ-২১৩৮৩৮) নিয়ে সাদাপাথর ভ্রমণে আসেন গাড়িটি তারা পার্কিংয়ের নির্দিষ্ট জায়গা পার্কিং করে চালকসহ সাদাপাথর স্পটে ঘুরতে যান, প্রায় চার ঘণ্টা পর সকাল ১১টায় ফিরে এসে দেখেন পার্কিংয়ে গাড়ি নেই। এই ঘটনায় স্থানীয় প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানানো হলেও গাড়ি উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। এছাড়াও পর্যটকদের গাড়ি থেকে মূল্যবান জিনিস প্রায়ই চুরির ঘটনা ঘটছে।

সিলেটের লিডিং ইউনিভার্সিটির ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালি বিভাগের প্রভাষক মো. আব্দুল হালিম বলেন, সিলেটের বেশিরভাগ পর্যটনকেন্দ্রে কোনো বিশ্রামাগার ও ওয়াশরুম নেই। এতে পর্যটকরা পর্যটন স্পটে এসে বিপাকে পড়েন। শুধু পর্যটন এলাকায় নয়, ওইসব স্থানে যাওয়ার পথেও ওয়াশরুম নির্মাণ করা প্রয়োজন। তিনি বলেন, সিলেটের পর্যটন স্পটগুলোতে কোনো বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নেই। ফলে পর্যটকরা পর্যটন স্পটগুলো নোংরা করছেন। পর্যটনশিল্পের বিকাশে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা জরুরি বলে মনে করেন আব্দুল হালিম।

সিলেটের অন্যতম আরও দুটি পর্যটনকেন্দ্র বিছনাকান্দি ও রাতারগুল জলারবন। দুটি স্থানে যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম সড়কপথ। বিগত কয়েক বছর থেকে এই দুই স্থানে যাতায়াতে সড়কের বেহাল দশা। পর্যটন স্পট বিছনাকান্দির দূরত্ব সিলেট থেকে প্রায় ৪২ কিলোমিটার। এই দূরত্বের গোয়াইনঘাট উপজেলার বঙ্গবীর রোড থেকে হাদারপাড় পর্যন্ত প্রায় সাত কিলোমিটারের সড়কের অবস্থা খুবই নাজুক ও খানাখন্দে ভরা। বিগত বন্যায় সড়কের পিচ উঠে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হলেও এখনো পর্যন্ত সড়কটি সংস্কার হয়নি। জলাবন খ্যাত রাতারগুলের দূরত্ব সিলেট থেকে প্রায় ২৬ কিলোমিটার। এই সড়কের পাঁচ কিলোমিটার সড়ক ভাঙাচোরা। এছাড়াও সড়কের চাঁনপুর থেকে মোটরঘাট পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটার কাঁচা রাস্তা। বৃষ্টির দিনে পর্যটকদের যাতায়াতে চরম সমস্যায় সম্মুখীন হতে হয়। এসব এলাকা যাতায়াতের একমাত্র বাহন সিএনজি-অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত টমটম। যার ফলে প্রায়ই সড়ক দুর্ঘটনার কবলে পড়ছেন পর্যটকরা। যার ফলে পর্যটকরা দুই স্থানে ভ্রমণে অনীহা প্রকাশ করছেন।

এব্যাপারে সিলেট এলজিইডির সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী মো. হাবিবুল্লাহ দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, জরুরিভিত্তিতে রাস্তা সংস্কারের চেষ্টা করা হচ্ছে। আশা করছি- প্রয়োজনীয় বরাদ্দ পেলে আগামী এক মাসের মধ্যে খানাখন্দগুলো ভরাট করে দেব। এতে যাতায়াতে কিছুটা স্বস্তি ফিরবে। আর আগামী এক-দুই বছরের মধ্যে প্রকল্পের মাধ্যমে পুরো রাস্তা নতুনভাবে মেরামত করা হবে।

এদিকে সিলেটের জাফলং, সাদাপাথর, বিছনাকান্দি, লালাখালে বেড়াতে এসে প্রায়শই পানিতে ডুবে পর্যটকদের মৃত্যু ঘটছে। বর্ষা মৌসুমে নদীতে পানি ও স্রোত বেড়ে যাওয়ায় পানিতে ডুবে প্রাণহানি বেশি ঘটে। এমন মৃত্যুর জন্য সংশ্লিষ্টরা পর্যটকদের সচেতনতার অভাবকে দায়ী করছেন। অপরদিকে, পর্যটদের অভিযোগ স্থানীয় প্রশাসনের উদাসীনতাই প্রাণহানি বাড়ছে। সরেজমিন সিলেটের কয়েকটি পর্যটন স্থান ঘুরে দেখা গেছে, কয়েকটি সাইনবোর্ড টাঙানো ছাড়া সিলেটের পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য আর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে ট্যুরিস্ট পুলিশের উপস্থিত তেমন লক্ষ্য করা যায় না।

এ ব্যাপারে ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মতিউর রহমান দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশকে জানান, সিলেটে আমাদের সাতটি জোন আছে। এমনিতেই আমাদের জনবল সংকট রয়েছে। নিজস্ব কোনো জায়গা নেই। আমরা ভাড়া বাসা নিয়েই অফিস পরিচালনা করছি। পর্যটন স্পটগুলোতে অস্থায়ী হেল্প ডেস্ক বসিয়ে সেবা প্রদানের চেষ্টা করছি। কেউ কোনো অভিযোগ করলে আমরা আইনগত সেবা প্রদান করি। পর্যটকদের সেবার মান আরও উন্নত করার জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করছি।

এদিকে, সিলেটের পর্যটনশিল্পের সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে সরকার, স্থানীয় প্রশাসন ও জনগণের সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন। তবে এই উদ্যোগগুলো বাস্তবায়িত হলে সিলেটের পর্যটন কেন্দ্রগুলো বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান পর্যটন গন্তব্যে পরিণত হতে পারে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত