ঢাকা শনিবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ২১ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ঢাকায় ফিল্মি স্টাইলে গুলি নিহত ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী’ মামুন

* শরীরে পাঁচটি গুলির চিহ্ন * শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমনের লোকজন হত্যার সঙ্গে জড়িত, দাবি মামুনের স্ত্রীর
ঢাকায় ফিল্মি স্টাইলে গুলি নিহত ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী’ মামুন

পুরান ঢাকার ন্যাশনাল মেডিকেল ইনস্টিটিউট হাসপাতালের সামনে গুলিতে নিহত ব্যক্তির বিস্তারিত নামণ্ডপরিচয় জানা গেছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের একটি সূত্র বলছে, নিহত ব্যক্তির নাম তারিক সাইফ মামুন (৫৫), তিনি ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী’। গতকাল সোমবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে এই ব্যক্তিকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ বলছে, দুর্বৃত্তরা খুব কাছ থেকে তাকে গুলি করে। পুলিশ বলছে, নিহত ব্যক্তি একসময় অন্য শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমনের সহযোগী ছিলেন, তবে অপরাধজগতের নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলছিল। গুলির ঘটনার সিসিটিভির একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, মামুন দৌঁড়ে পালানোর চেষ্টা করছেন। তখন দুই ব্যক্তি খুব কাছে থেকে তাকে গুলি করছেন। ঘটনাটি ঘটে তিন থেকে চার সেকেন্ডের মধ্যে। গুলি করার পর দুই ব্যক্তি ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন।

মামুনের পরিবার বলছে, তিনি দুই দিন ধরে রাজধানীর বাড্ডার ভাড়া বাসায় ছিলেন। গতকাল সোমবার সকালে একটি মামলায় আদালতে তার হাজিরা দেওয়ার কথা ছিল। এ জন্য তিনি সকালে বাসা থেকে বের হন। মামুনের স্ত্রী বিলকিস আক্তার বলেন, তারা ধারণা করছেন, শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমনের লোকজন এই হত্যার সঙ্গে জড়িত। এর আগেও ইমনের লোকজন মামুনকে হত্যার চেষ্টা করেছিল।

পুলিশ জানায়, শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন ও মামুন একসময় হাজারীবাগ, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর ও তেজগাঁও এলাকার আতঙ্ক ছিলেন। তাদের গড়ে তোলা বাহিনীর নাম ছিল ‘ইমন-মামুন’ বাহিনী। তারা দুজনই চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী ও সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের ভাই সাঈদ আহমেদ টিপু হত্যা মামলার আসামি। জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য অনুযায়ী, মামুনের বাড়ি লক্ষ্মীপুরে। তার জন্ম ১৯৭০ সালে। রাজধানীর কোতোয়ালি থানা-পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. ইয়াসিন বলেন, গুলির শব্দ শুনতে পেয়ে তিনি ন্যাশনাল মেডিকেল ইনস্টিটিউট হাসপাতালের সামনে যান। গিয়ে দেখেন, এক ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে আছেন। খুব কাছ থেকে তাকে গুলি করা হয়েছে বলে জানতে পেরেছেন। এই হত্যাকাণ্ডের পর আবারও আলোচনায় এসেছে ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের পুরোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা। আলোচনায় এসেছে ‘ইমন-মামুন বাহিনী’ বনাম ‘জোসেফ গ্রুপের’ সংঘর্ষ ও টার্গেট কিলিং।

পুলিশ ও আদালত সূত্র জানা গেছে, গতকাল সোমবার সকালে একটি মামলায় মামুন হাজিরা দিতে গিয়েছিলেন ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-২-এ। ১৯৯৭ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি মোহাম্মদপুরের পিসি কালচার হাউজিং এলাকায় জাহিদ আমিন ওরফে হিমেল হত্যাকাণ্ডের মামলায় অভিযুক্ত ছিলেন তিনি। এ মামলায় তার সঙ্গে আরও পাঁচ জন আসামি রয়েছেন ওসমান, মাসুদ ওরফে নাজমুল হোসেন, রতন, ইমন ও হেলাল। আদালতে এদিন সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য থাকলেও কোনো সাক্ষী হাজির না হওয়ায় শুনানি পিছিয়ে আগামী ৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মুলতবি করা হয়।

আদালত থেকে বেরিয়ে মামুন ঢাকা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যান। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, সকাল ১০টা ৫১ মিনিটে হাসপাতালের ফটক পার হওয়ার পর হঠাৎ দৌঁড়ে আবার ভেতরে ফিরে আসেন তিনি। তখনই গুলির শব্দে আশপাশের মানুষ ছুটোছুটি শুরু করেন।

হাসপাতালের নিরাপত্তাকর্মী মো. তারেক বলেন, ‘দুই জন দুর্বৃত্ত হঠাৎ এসে তাকে লক্ষ্য করে গুলি করে। একটি গুলি জানালার কাচে লাগে, কয়েকটি গুলি লাগে মামুনের শরীরে। তাকে উদ্ধার করে প্রথমে আমাদের হাসপাতালে নেওয়া হয়। অবস্থা খারাপ হওয়ায় ঢাকা মেডিকেলে পাঠানো হয় তাকে।’

মামুনের শরীরে পাঁচটি গুলির চিহ্ন : নিহত তারিক সাইফ মামুনের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেন সূত্রাপুর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) সাইদুল হোসেন মিলন। প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেন, লাশে মোট পাঁচটি গুলিবিদ্ধ জখমের চিহ্ন পাওয়া গেছে। মাথার নিচে একটি, বাম পিঠে একটি, বুকের ডান পাশে একটি, বাম হাতের কব্জিতে একটি এবং ডান হাতের কব্জির ওপরে একটি গুলি লেগেছে তার।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, এই হত্যাকাণ্ড আকস্মিক নয়, বরং দীর্ঘদিনের আন্ডারওয়ার্ল্ডের প্রতিশোধ-রাজনীতির ধারাবাহিকতা। সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের ভাই সাঈদ আহমেদ টিপু হত্যাকাণ্ড ও ঢাকার চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তোফায়েল আহমেদ জোসেফের সঙ্গে সানজিদুল ইসলাম ওরফে ইমন ও তারিক সাইফ মামুনের বিরোধ শুরু হয় বহু বছর আগে।

ইমন ও মামুন একসময় ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর ও তেজগাঁও এলাকার ত্রাস হিসেবে পরিচিত ছিল। তাদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ‘ইমন-মামুন বাহিনী’ ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে প্রভাব বিস্তার করেছিল। তারা দুজনেই চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী এবং সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের ভাই টিপু হত্যা মামলার আসামি। কারাগারে দীর্ঘদিন একই সেলে ছিলেন মামুন ও ইমন।

২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে তেজগাঁও এলাকায় মামুনকে লক্ষ্য করে গুলি চালায় একদল সন্ত্রাসী। সে সময় মোটরসাইকেল আরোহী ভুবন চন্দ্র শীলের মাথায় গুলি লাগে, পরে তিনি মারা যান। ঘটনার পর পুলিশ জানিয়েছিল, সেই হামলার পেছনে কারাবন্দি ইমনের অনুসারীরা ছিল।

তবে আন্ডারওয়ার্ল্ডের একটি সূত্রের দাবি, মামুন হত্যার মূলে রয়েছে আজিজ আহমেদের ভাই জোসেফ। সূত্রের দাবি, সাঈদ আহমেদ টিপু হত্যার পর থেকেই জোসেফের টার্গেটে ছিলেন মামুন।

সূত্র বলছে, মামুন কিলিং মিশনে মূল ভূমিকা রেখেছে ‘ইব্রাহিম গ্রুপ’। নেতৃত্বে ছিল ইব্রাহিম, সানি, অনিক, পারভেজ, মাসুদ, নাজমুল, ভাইগ্না রনি ও কিলার কামাল। ইব্রাহিম বাহিনীর সদস্যরা ৫ আগস্টের পর থেকে ইমন গ্রুপের হয়ে কলাবাগান, ধানমন্ডি, রায়েরবাজার, জিগাতলা, মনেশ্বর রোড ও ট্যানারি পট্টি এলাকায় শত শত কোটি টাকার চাঁদাবাজি করে আসছে। ফ্ল্যাট, জমি, আড়ত থেকে শুরু করে বাজার-দোকান, সব জায়গায় তাদের আধিপত্য। তাদের ভয়ে ভুক্তভোগীরা মামলা করার সাহস পান না।

ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে গুলি করা হয় মামুনকে। সাবেক সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল আজিজ আহমেদের ভাই তোফায়েল আহমেদ জোসেফ। নব্বইয়ের দশকে ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে পরিচিত পায় সে। ১৯৯৭ সালে তাদের আরেক ভাই সাঈদ আহমেদ টিপু খুন হন প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠীর গুলিতে। ২০০৪ সালে ফ্রিডম পার্টির নেতা মোস্তফা হত্যা মামলায় জোসেফকে মৃত্যুদণ্ড দেন আদালত। হাইকোর্ট সেই রায় বহাল রাখলেও ২০১৫ সালে আপিল বিভাগ তার সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন করেন। জোসেফের বিরুদ্ধে একসময় চাঁদাবাজি, খুন ও অবৈধ অস্ত্র বহনসহ অন্তত ১১টি মামলা ছিল।

২০১৮ সালের মে মাসে রাষ্ট্রপতির ক্ষমায় মুক্তি পেয়ে দেশ ছাড়ে জোসেফ। বর্তমানে জোসেফের অবস্থান দুবাইয়ে বলে গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যে জানা গেছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মল্লিক আহসান উদ্দিন সামী বলেন, ‘সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে দুই ব্যক্তি সরাসরি মামুনকে গুলি করেছে। তাদের পরিচয় যাচাই চলছে। হত্যাকাণ্ডের পেছনে কারা, কী কারণে, কার নির্দেশে, এসব বিষয় আমরা গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আন্ডারওয়ার্ল্ডের পুরোনো দ্বন্দ্ব, ব্যক্তিগত প্রতিশোধ, কিংবা ব্যাবসায়িক বিরোধ; সব দিকই আমরা বিবেচনায় নিচ্ছি। কোনো তথ্য চূড়ান্তভাবে নিশ্চিত হওয়ার আগে কিছু বলা ঠিক হবে না।’ চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলায় আটক হয়ে ২০ বছর জেলে থাকার পর ২০২৩ সালে জামিনে মুক্তি পান তারিক সাইফ মামুন। জামিনের তিন মাস পরই তেজগাঁওয়ে তাকে লক্ষ্য করে গুলি চালানো হয়। সেবার বেঁচে গেলেও এবার তিনি খুন হলেন আদালত থেকে বেরিয়ে মাত্র এক ঘণ্টার ব্যবধানে। মামুন হত্যাকাণ্ডের পর আবারও রাজধানী ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের পুরোনো আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত