
বিএনপি বলেছে, জুলাই জাতীয় সনদের বাইরে গিয়ে সরকার কোনো সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলে তার সব দায়দায়িত্ব সরকারের ওপরই বর্তাবে। সনদে স্বাক্ষরকারী কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে তখন সেই সিদ্ধান্ত মান্য করার বাধ্যবাধকতা থাকবে না। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন দলের জ্যেষ্ঠ নেতা ও জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন। এর আগে গত সোমবার রাতে গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে দলটির স্থায়ী কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সভার সিদ্ধান্ত জানাতে দলের স্থায়ী কমিটি গতকাল এই সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করে।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে খন্দকার মোশাররফ বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দীর্ঘ প্রায় এক বছরব্যাপী আলোচনা হয়। আলোচনার ভিত্তিতে কতিপয় নোট অব ডিসেন্টসহ ঐকমত্যের ভিত্তিতে রচিত জুলাই জাতীয় সনদ গত ১৭ অক্টোবর স্বাক্ষরিত হয়। দেশের সংবিধান ও আইন অনুযায়ী তা বাস্তবায়নে সবাই অঙ্গীকারবদ্ধ।
খন্দকার মোশাররফ বলেন, সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের মধ্যে কেউ কেউ জুলাই জাতীয় সনদের বাইরে কোনো বিষয়ে সরকারি সিদ্ধান্ত ঘোষণার প্রসঙ্গে যেসব বক্তব্য দিচ্ছেন, তা বিভ্রান্তিকর। ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত সিদ্ধান্তকে উপেক্ষা করার শামিল। তারা স্পষ্ট ভাষায় বলতে চান, জুলাই জাতীয় সনদে উল্লেখিত বিষয়ের বাইরে সরকার কোনো সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলে সনদে স্বাক্ষরকারী কোনো দলের জন্য তা মান্য করার বাধ্যবাধকতা থাকবে না। সে ক্ষেত্রে সব দায়দায়িত্ব সরকারের ওপরই বর্তাবে।
সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে খন্দকার মোশাররফ বলেন, নির্বাচন নিয়ে নানা রকম ষড়যন্ত্র চলছে। যারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারছে না, নানাভাবে তারা দেশে অশান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করছে। সরকারকে সতর্ক পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য তারা আহ্বান জানাচ্ছেন।
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাউদ্দিন আহমদ ও মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ উপস্থিতি ছিলেন।
ঐকমত্যের বাইরে কিছু চাপিয়ে দিলে সব দায় সরকারকে নিতে হবে -মির্জা ফখরুল : বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সরকারকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, ৯ মাস ধরে সব দলের সঙ্গে আলোচনা করে যে বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, তার বাইরে কোনো কিছু গায়ের জোরে এ দেশের মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হলে তার সব দায়-দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে। তিনি অনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতির তীব্র সমালোচনা করে বলেন, এটি সাধারণ মানুষ বোঝেন না এবং বিএনপিও এটা গ্রহণ করবে না। তার মতে, পিআর হলো ‘বিভ্রান্ত করা’ এবং ‘ভোট পেছানো’। গতকাল মঙ্গলবার ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার বড়গাঁও ইউনিয়নের কিসমত কেশুর বাড়ি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে বড়গাঁও ইউনিয়নবাসীর সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
বিএনপির মহাসচিব বলেন, জোর করে হামাক পিআর চাপাই দিবা চাহাছে। পিআর বুঝেন? মুই বুঝি না। আমরা এটা চিনি না আমরা দীর্ঘকাল শত বছর ধরে ভোট দিয়ে আসতেছি। মোর ক্যান্ডিডেট দাঁড়াবে তাকে তার মার্কা দেখে ভোট দিব। এটাই তো হয়ে আসছে। তিনি জামায়াতে ইসলামীর নাম উল্লেখ করে বলেন, তারা পিআর আইন করতে চাইছে। তিনি মনে করেন, এগুলো হচ্ছে শুধু বিভ্রান্ত করা, ভোট পেছানো।
নির্বাচন পেছানোর কোনো সুযোগ নেই উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, এবার যদি নির্বাচনটা পিছিয়ে যায় তাহলে এই দেশটা একটা ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হবে। বিএনপি শুধু ঐকমত্য হওয়া বিষয়গুলোর পক্ষেই থাকবে বলে জানান তিনি।
শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ্য করে মির্জা ফখরুল বলেন, তিনি ভারতে গিয়ে হরতাল ঘোষণা করছেন এবং গাড়ি পোড়াচ্ছেন। কালকে কিন্তু গাড়িও পুড়ছে। দিল্লিতে বসে দেশের সর্বনাশ আর কইরো না। এত সাহস থাকলে, জনগণের প্রতি ভালোবাসা থাকলে পালিয়ে আছেন কেন? আসেন না কেন দেশে? আমরাও জেল খেটেছি দীর্ঘদিন আপনারাও খাটেন কিছুদিন।
মির্জা ফখরুল বলেন, গণভবনের কাছে জনগণ পৌঁছালে সামরিক বাহিনীর টেলিফোনে হাসিনা হেলিকপ্টারে করে পালিয়ে যান। পাবলিক আপনাকে ছিঁড়ে খায়ে ফেলবে, এই অবস্থা তৈরি হয়েছিল।
জামায়াতকে ইঙ্গিত করে মির্জা ফখরুল বলেন বলেন, কিছু দল প্রচার করছে যে, তারাই একমাত্র দেশপ্রেমিক ও সৎ দল এবং তারা ‘বেহেস্তের টিকিট’ বিক্রি করে। বেহেস্তের টিকিট আল্লাহতায়ালা ছাড়া আর নবী ছাড়া কেউ দিতে পারেন না। এগুলো যারা করছেন এই দুনিয়াতে তারা কিন্তু ইসলামের অপব্যাখ্যা দিচ্ছে। আমার ধর্মের অপব্যাখ্যা দিচ্ছে। তিনি বলেন, যারা মোনাফেকি করে তাদের থেকে সাবধান থাকতে হবে এবং এটি ইসলাম ধর্ম নয়।
দল ক্ষমতায় গেলে তারেক রহমানের পরিকল্পনার কথা তুলে ধরে মহাসচিব ফখরুল ইসলাম বলেন, বিএনপি ক্ষমতায় এলে ১৫ মাসের মধ্যে ১ কোটি মানুষের কাজের ব্যবস্থা করবে। পাশাপাশি, মা-বোনদের ন্যায্যমূল্যে পণ্য কেনার জন্য ‘ফ্যামিলি কার্ড’ এবং কৃষকদের সার-বিষ-পানিসহ ন্যায্যমূল্যে কেনার জন্য ‘ফার্মাস কার্ড’ দেওয়া হবে। বিএনপি বিচার বিভাগকে স্বাধীন করতে চায়, যাতে বিচারক নির্ভয়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারেন।
তিনি জিয়াউর রহমানকে স্মরণ করে বলেন, তিনিই সংবিধানে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম এবং আল্লাহর ওপর অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস যুক্ত করেছিলেন। তিনি ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’-এর দর্শন দিয়েছিলেন, যেখানে সব ধর্মের মানুষ এক থাকবে।
ইউনিয়ন বিএনপি সভাপতি ডা. আহম্মদ আলীর সভাপতিত্বে সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন- জেলা বিএনপির সভাপতি মির্জা ফয়সাল আমিন, সাধারণ সম্পাদক মো. পয়গাম আলী, সদর উপজেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল হামিদ ও সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান তুহিনসহ জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের দলটির বিভিন্ন স্তরের নেতারা।
জুলাই সনদের বাইরে সরকারের কোনো সিদ্ধান্ত মানতে রাজনৈতিক দলগুলো বাধ্য না -সালাহউদ্দিন : জুলাই জাতীয় সনদে উল্লেখিত বিষয়ের বাইরে সরকার কোনো সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলে সনদে স্বাক্ষরকারী কোনো দলের জন্য তা মানার বাধ্যবাধকতা থাকবে না বলে জানিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ কথা বলেন।
এর আগে লিখিত বক্তব্য পাঠ করে দলের স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্ত জানান খন্দকার মোশাররফ হোসেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য বলেন, ‘সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের মধ্যে কেউ কেউ জুলাই জাতীয় সনদের বাইরে কোনো কোনো বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্তের ঘোষণার প্রসঙ্গে যেসব বক্তব্য দিচ্ছেন, তা বিভ্রান্তিকর এবং ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত সিদ্ধান্ত অগ্রাহ্য করার সামিল।’
সালাহউদ্দিন আহমদ আহমেদ, ‘আমরা স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, জুলাই জাতীয় সনদে উল্লেখিত বিষয়ের বাইরে সরকার কোনো সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলে সনদে স্বাক্ষরকারী কোনো দলের জন্য তা মানার বাধ্যবাধকতা থাকবে না। সে ক্ষেত্রে সব দায়-দায়িত্ব সরকারের ওপর বর্তাবে,’ যোগ করেন তিনি। এ ব্যাপারে সতর্ক পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য বিএনপির পক্ষ থেকে সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
একই কথা পুনর্ব্যক্ত করে গণমাধ্যমকর্মীদের প্রশ্নের জবাবে সালাহউদ্দিন বলেন, ‘জুলাই জাতীয় সনদে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন দফায় কিছু নোট অব ডিসেন্ট আছে। সেই নোট অব ডিসেন্টগুলোর ক্ষেত্রে সনদে বলাও আছে যে, দলগুলো যদি নির্বাচন ইশতেহারে উল্লেখ করে জনগণের ম্যানডেট পায়, নোট অব ডিসেন্টগুলো তারা সেভাবে বাস্তবায়ন করতে পারবে। এখানে আমরা শতভাগ একমত, এখনও আমরা সেই জায়গায় আছি এবং আমরা স্বাক্ষরিত সনদের বাইরে নাই। কিন্তু যেভাবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সরকারের কাছে সনদ বাস্তবায়নের উপায় সংক্রান্ত যে সুপারিশ প্রদান করেছে, তার মধ্যে নোট অব ডিসেন্টের অংশগুলো উল্লেখিত নেই। একদম নেই।’ তিনি বলেন, ‘শুধু প্রস্তাবগুলোর ব্যাপারে ৪৮টি দফা দিয়ে তারা একটি তফসিল করেছে। সেই তফসিলে প্রস্তাবগুলো সম্পর্কে গণভোটের প্রস্তাব করেছে। জাতীয় ঐকমত্যের স্বার্থে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনে গণভোটের মাধ্যমে জুলাই জাতীয় সনদের ওপরে জনগণের সম্মতি নেওয়ার জন্য আমরা রাজি হয়েছিলাম, সে জায়গায় আমরা আছি।’
সাংবিধানিক আদেশ জারির ক্ষেত্রে বিএনপির অবস্থান জানতে চাইলে সালাহউদ্দিন বলেন, ‘আদেশের বিষয়ে আমরা সুনির্দিষ্ট কোনো প্রস্তাব এ রকম দেইনি যে, আদেশ কে জারি করবে। আমরা একটা সাংবিধানিকতার মধ্যে আছি। সাংবিধানিকভাবে এই সরকার শপথ নিয়েছে। সব কিছু আইনানুগভাবে চলছে। এখন কোনো অধ্যাদেশ জারি করার ক্ষমতা এই সংবিধান অনুসারে রাষ্ট্রপতির। যদি কোনো আদেশ জারি করতে হয় সেই আদেশের মর্যাদা যদি আইনি হয়, সেই আদেশ জারি করার মতো কোনো সাংবিধানিক অবস্থা বাংলাদেশে নেই। কারণ প্রেসিডেন্ট অর্ডারটা জারি করার একটা বিধান এক সময় ছিল, যত দিন পর্যন্ত বাংলাদেশের সংবিধান গৃহীত হয়নি। আপনারা সবাই জানেন, সে রকম পিও অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট অর্ডার নিয়ে তখন রাষ্ট্র চলত। সংবিধান গৃহীত হয়ে যাওয়ার পরে রাষ্ট্রপতির আদেশ জারির আর কোনো বিধান রইল না, সেটা বিলুপ্ত হলো। এখন কী রকম আদেশ দেবে? সেই আদেশের মর্যাদা কি আইনি মর্যাদা হবে? সেটা এখনও সরকার নির্ধারণ করেনি। একমাত্র অধ্যাদেশ প্রণয়ন করা ছাড়া রাষ্ট্রপতির অন্য কোনোভাবে আইন প্রণয়ন করার ক্ষমতা এখন নেই।’
‘এখন যেটা করছে, রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশ জারি করে কিন্তু আদেশ জারি করার কোনো বিধান বর্তমান সংবিধানে নেই। কিন্তু যদি এখন কোনো প্রজ্ঞাপনকে আদেশ নামকরণ করতে চায় এবং সেটার আইনি মর্যাদা না থাকে, সেটা প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সরকার প্রকাশ করতে পারে- আইন হবে না সেটা,’ যোগ করেন তিনি।
গণভোট ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনার সুযোগ আছে কি না জানতে চাইলে সালাহউদ্দিন বলেন, ‘সরকার যদি আলোচনার জন্য আহ্বান জানায়, সে ক্ষেত্রে আলোচনার সুযোগ থাকতে পারে। রাজপথে তো নয়!’