ঢাকা শনিবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ২১ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

আলু : বিপদে কৃষক

এত আলু কোথায় রাখবেন তারা

মুন্সীগঞ্জ
এত আলু কোথায় রাখবেন তারা

বাজারে আর কিছু দিনের মধ্যে নতুন আলু নামবে। কিন্তু এখনও মুন্সীগঞ্জে হিমাগারগুলোত প্রচুর পরিমাণ আলু মজুত রয়েছে। তাই এবছরও আলুতে লাভ না হওয়ার শঙ্কা কাজ করছে কৃষকের মধ্যে। ফলে চলতি মৌসুমের আলু আবাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। দেশের অন্যতম শীর্ষ আলু উৎপাদন জেলা মুন্সীগঞ্জে আলুর দরপতনে চরম বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা। স্থানীয় হিমাগারে আলুর কেজি প্রতি দর মাত্র ১১ টাকা, অথচ কৃষকদের দাবি অনুযায়ী উৎপাদন থেকে শুরু করে সংরক্ষণ, পরিবহন ও বাছাই খরচ মিলিয়ে প্রতি কেজি আলুর খরচ দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৭ টাকা। ফলে পুঁজির কোনো অংশই আর কৃষকের হাতে থাকছে না। সরকারি হিসাবে, জমিতে কেজি প্রতি আলুর উৎপাদন খরচ পড়েছে ১৭ টাকা। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে হিমাগার ভাড়া ৬ টাকা, বস্তা ও পরিবহনসহ অন্যান্য খরচ সব মিলিয়ে ২৭ টাকা কেজি। কিন্তু সেই আলু হিমাগারে বিক্রি হচ্ছে ১১ টাকায় এবং খুচরা বাজারে বর্তমানে ১৮ থেকে ২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অথচ গত বছর এই সময় আলুর দাম ছিল ৬০ টাকা কেজি, যা থেকে কৃষকরা কিছুটা হলেও লাভ পেয়েছিলেন। এবার দরপতনের কারণে তারা একেবারে পুঁজি হারিয়ে দিশাহারা হয়ে পড়েছেন।

গজারিয়া উপজেলার মাথাভাঙা গ্রামের আলু ব্যবসায়ী ইসরাফিল ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘২৭ টাকার আলু ১১ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত বছর ভোক্তা অধিকার এসে দাম বেঁধে দিয়েছিল; কিন্তু এবার কেউ আসে না। কোল্ডস্টোরেজ ভাড়া, সার্ভিস খরচ সব মিলে ১ কেজি আলুর খরচ ২৭ টাকা হলেও, বাজার দরে তা বিক্রি হচ্ছে ১০ থেকে ১১ টাকায়। কৃষকরা পুরোপুরি পুঁজি হারিয়ে পঙ্গু হয়ে গেছে। এখন তো আলু বিক্রিই হচ্ছে না।’

শিবু বেপারী নামে এক কৃষক আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, নভেম্বরের মধ্যেই নতুন আলু বাজারে চলে আসবে। পুরোনো আলু নদীতে ফেলে দিতে হবে। আমরা চাই, সরকার আলু রপ্তানি করুক বা ভিজিএফ এর মাধ্যমে বিতরণ করুক, তাহলে কৃষকরা উপকৃত হবে। সরকার ২২ টাকা দর নির্ধারণ করে দিলেও মুন্সীগঞ্জে প্রতি কেজি আলু বেচাকেনা হচ্ছে ৮ টাকা কেজি দরে। এতে কেজিপ্রতি কৃষক ও ব্যবসায়ীদের লোকসান হচ্ছে ১৬ থেকে ১৮ টাকা। এ অবস্থায় হিমাগারে মজুত করা আলুতে ১ হাজার কোটি টাকা, পচন ধরায় ৫৪০ কোটি এবং সংরক্ষণ করতে না পেরে বাড়ি থেকে কম মূল্যে বিক্রি করায় লোকসান হয়েছে ৪৯৫ কোটি টাকা। এই হিসাবে এবার আলুতে লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৩৫ কোটি টাকা। এ কারণে মুন্সীগঞ্জের ৭০ হাজার কৃষক ও ব্যবসায়ীসহ লক্ষাধিক মানুষ দুশ্চিন্তায়।

মানিকপুর এলাকার বাসিন্দা ও ভোক্তা ওয়াহিদ সরকার বলেন, ‘বিদ্যুৎ বিল, কোল্ডস্টোরেজ ভাড়া, জমির চাষ খরচ, শ্রমিক মজুরি, সার ও বীজের দাম বেড়েছে। কিন্তু বাজারদরে সেই খরচও উঠছে না। কৃষক মাঠে মরছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, মুন্সীগঞ্জ জেলায় ৬১টি হিমাগারের আলু সংরক্ষণের ধারণক্ষমতা রয়েছে পাঁচ লাখ টন। এর মধ্যে আবার জেলার বাইরে থেকে ২৫ শতাংশ আলু সংরক্ষণ করা হয় মুন্সীগঞ্জের হিমাগারগুলোতে। ওই হিসাবে জেলায় উৎপাদিত আলুর মধ্যে সাড়ে তিন লাখ টন আলু হিমাগারে সংরক্ষণ করতে পেরেছেন কৃষকরা।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ ড. হাবিবুর রহমান আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, মুন্সীগঞ্জ জেলায় গত বছরে রবি মৌসুমে আলুর আবাদ হয়েছিল ৩৪ হাজার ৭৫৮ হেক্টর আর জমিতে মোট উৎপাদন হয় প্রায় ১০ লাখ ৮২ হাজার ৫৫৮ মে. টনের বেশি। এবছর আলু আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ৩৪৬৫৫ হেক্টর, উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৯৭৫৫৩৮.২৫ মে. টন। ৬১টি হিমাগারে সংরক্ষরণ করা হয়েছে ৫ লাখ ২৩ হাজার ৩৩৫ মেট্রিক টন এর মধ্যে এখন পর্যন্ত কৃষকের আলু মজুত রয়েছে প্রায় খাবার আলু ২ লাখ ২৬ হাজার ০২৩, বীজ আলু ১ লাখ ০৬ হাজার ১৬১, মোট আলু ৩ লাখ ৩২ হাজার ১৮৪ মেট্রিক টন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর আলু আবাদ করে লোকসান হওয়ায় কৃষকদের আলুর চাষাবাদ কমিয়ে উচ্চ মূল্যের ফসল যেমন ক্যাপসিকাম, মিষ্টি আলু, গম, ধান, ভুট্টা, বাঙ্গি, তরমুজ ও কলা চাষাবাদের পরামর্শসহ কৃষি প্রণোদনায় আওতায় ধান, গম, খেসারি, চীনাবাদাম, মিষ্টি কুমড়া এবং শীতকালীন উফশী ও হাইব্রিড জাতের শাকসবজির বীজ এবং সার বিনামূল্যে বিতরণ করেছে।

এখানে উল্লেখ যে, মুন্সীগঞ্জ জেলা আলু উৎপাদনের জন্য বাংলাদেশের অন্যতম একটি শীর্ষস্থানীয় জেলা এবং এখানে আলুর গড় ফলন প্রায় ৩০ টন হেক্টর। গত বছর আলুর বাজারমূল্য, অধিক হওয়ায় রেকর্ড পরিমাণ বেশি জমিতে আলু উৎপাদিত হয়। এই বিপুল পরিমাণ আলু বাজারে সরবরাহ বেশি থাকায় বাজারমূল্য কমে যায়। ফলে, কৃষক অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়াও, উৎপাদন খরচ হিমাগার ভাড়া, বস্তা, পরিবহন, সবকিছু মিলিয়ে কৃষকের আলু এখন লভ্যাংশ তুলতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। বর্তমান প্রেক্ষাপটে, মুন্সীগঞ্জ জেলায় ৬১টি সচল হিমাগারে এখন পর্যন্ত কৃষকের আলু মজুত রয়েছে প্রায় খাবার আলু ২,২৬,০২৩ বীজ আলু ১০৬১৬১, মোট আলু ৩,৩২,১৮৪ মে. টন। গত বছর এই সময়ে খাবার আলু ৮৪.৯৯১ মে.টন বীজ আলু ৭৯,৯৯১ মে. টন মোট কৃষকের আলু ছিল ১,৬৪,৯৩৫ যে টন। মুন্সীগঞ্জ আলু উৎপাদনে শীর্ষে থাকলেও বাজারজাতকরণে সমস্যা রয়েছে। এবছর বাজারদর কম হওয়ায় কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত