
জুলাই গণঅভ্যুত্থানকালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ড পাওয়া শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আরও তিনটি মামলা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন। এর মধ্যে তার শাসনামলে ঘটা গুম সংক্রান্ত মামলা দুটি। এগুলোর আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে। অন্য মামলাটি ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরে হওয়া হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ নিয়ে। এর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের অপেক্ষায় রয়েছে বলে ট্রাইব্যুনাল সূত্র জানিয়েছে।
মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে গত সোমবার রায় ঘোষণা করেন ট্রাইব্যুনাল। রায়ে তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্তও করা হয়। আর দোষ স্বীকার করে রাজসাক্ষী হওয়ায় এ মামলায় সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এর আগে আদালত অবমাননার অভিযোগে চলতি বছরের জুলাইয়ে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল শেখ হাসিনাকে। তখন ‘২২৬ জনকে হত্যার লাইসেন্স পেয়ে গেছি’- শেখ হাসিনার এমন একটি বক্তব্যের অডিও রেকর্ড অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ে। এটি বিচার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা উল্লেখ করে প্রসিকিউশন আদালত অবমাননার অভিযোগ আনে। সেই মামলায় শেখ হাসিনাকে ছয় মাসের সাজা দেন ট্রাইব্যুনাল।
গুমের দুই মামলা : বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আলোচিত গুমের ঘটনায় চলতি বছরের ৮ অক্টোবর শেখ হাসিনাসহ ২৮ জনের বিষয়ে দুটি ফরমাল চার্জ বা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। সেই সঙ্গে সব আসামির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন। ওইদিন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান যে গুম, গোপন বন্দিশালায় আটক, নির্যাতন, হত্যাকাণ্ডসহ নানা ধরনের যে অপরাধ হয়েছে সেগুলোর ব্যাপারে দুটি ফরমাল চার্জ দাখিল করা হয়েছে। গুমের দুটি অভিযোগের মধ্যে একটি হলো আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে র্যাবের কিছু বিপদগামী সদস্যের টিএফআই সেল এবং বিভিন্ন গোপন বন্দিশালায় ভিন্নমতাবলম্বী রাজনৈতিক কর্মী, সাংবাদিক ও ব্লগারকে আটক রেখে নির্যাতন। এর বাইরে ডিজিএফআইয়ের কিছু বিপদগামী সদস্যের জেআইসি সেন্টারের অপব্যবহার করে রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের আটক রাখার ব্যাপারে আলাদা অভিযোগ দাখিল করা হয়। এসব অভিযোগের সঙ্গে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক নিরাপত্তা উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিকীসহ র্যাব ও ডিজিএফআইয়ের কয়েকজন কর্মকর্তাকে আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
এরপর ১৭ নভেম্বর এ দুই মামলার কয়েকজন আসামি সেনা কর্মকর্তা আদালতে হাজির হন। এরপর আদালত তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। দুটি মামলার পরবর্তী শুনানির জন্য আগামী ২৩ নভেম্বর দিন ধার্য রয়েছে।
শাপলা চত্বরে হত্যা : ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরের হত্যাকাণ্ড নিয়ে ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর বরাবর অভিযোগ করেন হেফাজতে ইসলামের নেতা আজিজুল হক। হেফাজত নেতা জুনায়েদ আল হাবিব ও মাওলানা মামুনুল হকের পক্ষে তিনি এ অভিযোগ করেন। এ ঘটনায় ২১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। তাদের মধ্যে আছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস, সাবেক মন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সাবেক এমপি হাজি সেলিম, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, নারায়ণগঞ্জের সাবেক এমপি শামীম ওসমান, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিকী, সাবেক আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক ও সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ। গত ১২ নভেম্বর এ মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময় বাড়িয়ে আগামী ১২ জানুয়ারি নির্ধারণ করা হয়েছে। মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণার পরদিন গত মঙ্গলবার সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে শেখ হাসিনার বাকি মামলা নিয়ে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামিম বলেন, ‘আর তিনটি মামলা আছে। একটি হলো ডিজিএফআইয়ের বন্দীশালা অর্থাৎ জেআইসি, সেখানে যে গুম এবং নির্যাতন করা হয়েছে তার একটি মামলা। আরেকটি হলো র্যাবের টিএফআই সেলে যে নির্যাতনের অভিযোগ, সে মামলা। এছাড়া ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরে গণহত্যার ঘটনায় একটি মামলা। এ তিনটি মামলায় এখন ট্রাইব্যুনালে তার বিরুদ্ধে বিচার হবে।’
হাসিনা পালিয়ে যাওয়ায় বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পেরেছে- জয়নুল আবেদীন : ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলার রায়কে দেশের জন্য মাইলফলক বলে মন্তব্য করেছেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন। তিনি বলেছেন, শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার ফলে বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পেরেছে। বৃহস্পতিবার সকালে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের পর সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন। তিনি এই মামলার অন্যতম আপিলকারী বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের আইনজীবী।
সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করে আনা ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে ১৪ বছর আগে দেওয়া রায় পুরোটাই বাতিল করেছেন আপিল বিভাগ। ওই রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিল মঞ্জুর ও এ-সংক্রান্ত রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) আবেদন নিষ্পত্তি করে আজ রায় দেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত। রায়ে বলা হয়, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার-সম্পর্কিত বিধানাবলি এই রায়ের মাধ্যমে পুনরুজ্জীবিত ও সক্রিয় করা হলো। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারসংক্রান্ত বিধানাবলি ভবিষ্যৎ প্রয়োগ যোগ্যতার ভিত্তিতেই কার্যকর হবে বলে রায়ে এসেছে। জয়নুল আবেদীন বলেন, রায় ঘোষণার পর আজ মনে হচ্ছে ঈদের দিন। কারণ, একজন বিচারপতি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে ত্রয়োদশ সংশোধনী নিয়ে রায় দিয়েছিলেন। সেই রায়ের ওপর ভিত্তি করে আওয়ামী লীগ সরকার গণতন্ত্রকে ধ্বংস করেছে। সংবিধান সংশোধন করেছে।
জয়নুল আবেদীন বলেন, আজকের রায়ের ফলে আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরে এসেছে। দেশের মানুষ এত দিন ভোট দিতে পারেনি। তারা এখন ভোট দিতে পারবে। জয়নুল আবেদীন বলেন, আদালত স্পষ্টভাবে বলেছেন যে এই রায় প্রসপেক্টিভ (ভবিষ্যৎমুখী)। বিএনপির পক্ষ থেকে তাঁরা আগেই আবেদন করেছিলেন যে আপিল ও রিভিউ নিষ্পত্তির সময় আদালত যেন রায়টি প্রসপেক্টিভ বলে ঘোষণা করেন। সেই আর্গুমেন্ট আদালত গ্রহণ করেছেন। রায়টিকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেন জয়নুল আবেদীন। তিনি বলেন, বিএনপি এই রায়কে স্বাগত জানায়।
সংশোধনী : প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয় ২০ নভেম্বর ২০২৫, বেলা ১টা ১২ মিনিটে। প্রতিবেদনের বক্তব্য ভুলবশত জ্যেষ্ঠ আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজলের বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে প্রতিবেদনের বক্তব্য জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীনের। ২০ নভেম্বর ২০২৫, বেলা ৩টা ৫৮ মিনিটে এই ভুল সংশোধন করা হলো। অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য দুঃখিত।