ঢাকা শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

হাসিনার ২১ বছর কারাদণ্ড

হাসিনার ২১ বছর কারাদণ্ড

ঢাকার পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে প্লট দুর্নীতির দায়ে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের সঙ্গে আরও ১৯ জনকে সাজা দেওয়া হয়েছে। ঢাকার পঞ্চম বিশেষ জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মামুন গতকাল বৃহস্পতিবার প্লট দুর্নীতির তিন মামলার রায় ঘোষণা করেন।

পৃথক তিন মামলায় শেখ হাসিনাকে ৭ বছর করে মোট ২১ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া তিন মামলায় তার এক লাখ টাকা করে মোট তিন লাখ টাকার অর্থদণ্ড; অনাদায়ে ৬ বছর করে মোট ১৮ বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এক মামলায় সজীব ওয়াজেদ জয়ের পাঁচ বছরের কারাদণ্ড হয়েছে। পাশাপাশি এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড হয়েছে। আরেক মামলায় সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড হয়েছে।

তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, ঢাকা শহরে বাড়ি বা ফ্ল্যাট বা আবাসন সুবিধা থাকার পরেও ‘সেই তথ্য গোপন করে তারা আইন ভেঙে দুর্নীতির মাধ্যমে’ পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে ১০ কাঠা আকারের একটি করে প্লট বরাদ্দ নিয়েছেন। পূর্বাচলের ২৭ নম্বর সেক্টরের কূটনৈতিক জোনের ২০৩ নম্বর সড়কের আশপাশে এসব প্লটের অবস্থান।

মামলায় ২৩ নভেম্বর যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হয়। পরে আদালত রায় ঘোষণার তারিখ গতকাল ধার্য করেন। সে অনুযায়ী রায় দেওয়া হয়। পৃথক এই তিন মামলায় আসামি ৪৭। তবে ব্যক্তি হিসেবে এই সংখ্যা ২২। ১৭ নভেম্বর পৃথক এই তিন মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়। এর আগে গত ৩১ জুলাই আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দিয়েছিলেন আদালত। একটি মামলায় শেখ হাসিনাসহ আসামি ১২ জন। আরেকটি মামলায় শেখ হাসিনা, সজীব ওয়াজেদ জয়সহ আসামি ১৭ জন। অপর মামলায় শেখ হাসিনা, সায়মা ওয়াজেদ পুতুলসহ আসামি ১৮ জন।

শেখ হাসিনা, সজীব ওয়াজেদ জয় ও সায়মা ওয়াজেদ পুতুল ছাড়া অপর ১৯ আসামির মধ্যে একজন তিন মামলাতেই বেকসুর খালাস পেয়েছেন। তার নাম মো. সাইফুল ইসলাম সরকার। তিনি গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা। অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত না হওয়ায় তাকে খালাস দেওয়া হয়। আসামিদের মধ্যে একমাত্র গ্রেপ্তার আছেন রাজউকের সাবেক সদস্য (এস্টেট ও ভূমি) মোহাম্মদ খুরশীদ আলম। তিন মামলায় তাকে এক বছর করে মোট তিন বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া তিন মামলায় তাকে ৫ হাজার টাকা করে মোট ১৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছে। অনাদায়ে এক মাস করে মোট তিন মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। রায় ঘোষণা উপলক্ষে গতকাল তাকে আদালতে হাজির করা হয়। রায় শেষে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।

তিন মামলায় সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদকে ৬ বছর করে মোট ১৮ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া এক লাখ টাকা করে মোট তিন লাখ টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে ছয় মাস করে দেড় বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মো. শহীদ উল্লা খন্দকারকে তিন মামলায় ৬ বছর করে মোট ১৮ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এক লাখ টাকা করে মোট তিন লাখ টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে ছয় মাস করে দেড় বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) কাজী ওয়াছি উদ্দিনকে ৩ মামলায় ৬ বছর করে মোট ১৮ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া এক লাখ টাকা করে মোট তিন লাখ টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে ছয় মাস করে দেড় বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান মো. আনিছুর রহমান মিঞাকে তিন মামলায় ৫ বছর করে মোট ১৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ৫০ হাজার টাকা করে মোট দেড় লাখ টাকা অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছে, অনাদায়ে তিন মাস করে ৯ মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সাবেক একান্ত সচিব মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিনকে ২ মামলায় ৬ বছর করে মোট ১২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি এক লাখ টাকা করে মোট দুই লাখ টাকার অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছে। অনাদায়ে ছয় মাস করে এক বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। রাজউকের সাবেক সদস্য (পরিকল্পনা) মোহাম্মদ নাসির উদ্দীনকে তিন মামলায় তিন বছর করে মোট ৯ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ২০ হাজার টাকা করে মোট ৬০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছে। অনাদায়ে দুই মাস করে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। রাজউকের সাবেক সদস্য (উন্নয়ন) মেজর (অব.) সামসুদ্দীন আহমদ চৌধুরীকে তিন মামলায় তিন বছর করে মোট নয় বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

এ ছাড়া ২০ হাজার টাকা করে মোট ৬০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছে। অনাদায়ে দুই মাস করে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সহকারী সচিব পূরবী গোলদারকে তিন মামলায় এক বছর করে মোট তিন বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ৫, ১০ ও ৫ হাজার টাকা করে মোট ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড। অনাদায়ে এক মাস করে তিন মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। রাজউকের সদস্য (উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ) তন্ময় দাসকে দুই মামলায় তিন বছর করে মোট ছয় বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ২০ হাজার টাকা করে মোট ৪০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছে। অনাদায়ে দুই মাস করে চার মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

রাজউকের সদস্য (এস্টেট ও ভূমি) মো. নুরুল ইসলামকে দুই মামলায় তিন বছর করে মোট ছয় বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ২০ হাজার টাকা করে মোট ৪০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছে। অনাদায়ে দুই মাস করে চার মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। রাজউকের সদস্য (প্রশাসন ও অর্থ) কবির আল আসাদকে এক মামলায় তিন বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে দুই মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

রাজউকের পরিচালক (এস্টেট ও ভূমি-২) শেখ শাহিনুল ইসলামকে এক মামলায় তিন বছরের সশ্রম কারাদণ্ড, ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে দুই মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। রাজউকের পরিচালক (এস্টেট ও ভূমি-২) মো. কামরুল ইসলামকে এক মামলায় তিন বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে দুই মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। রাজউকের সহকারী পরিচালক (এস্টেট ও ভূমি-৩) মো. হাফিজুর রহমানকে এক মামলায় এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে এক মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। রাজউকের সহকারী পরিচালক (এস্টেট ও ভূমি-৩) মো. হাবিবুর রহমান সবুজকে এক মামলায় এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে এক মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। রাজউকের সহকারী পরিচালক (এস্টেট ও ভূমি-৩) নায়েব আলী শরীফকে ২ মামলায় ১ বছর করে মোট ২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ৫ হাজার টাকা করে মোট ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে ১ মাস করে ২ মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

রাজউকের সহকারী পরিচালক (এস্টেট ও ভূমি-৩) মাজহারুল ইসলামকে এক মামলায় এক বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে এক মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। প্লট বরাদ্দের দুর্নীতির অভিযোগে গত জানুয়ারিতে পৃথক ছয়টি মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। মামলাগুলোয় শেখ হাসিনা, সজীব ওয়াজেদ জয়, সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানা, রেহানার মেয়ে ব্রিটিশ এমপি টিউলিপ রিজওয়ানা সিদ্দিক, ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক, মেয়ে আজমিনা সিদ্দিকসহ অন্যদের আসামি করা হয়। এই ছয় মামলার মধ্যে তিনটির রায় হয় বৃহস্পতিবার।

হাসিনা পরিবারের রায়ে হতাশ দুদক : ঢাকার পূর্বাচলে প্লট দুর্নীতির মামলায় আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন না হওয়ায় হতাশ দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক। বৃহস্পতিবার রায়ের পর দুদকের কৌঁসুলি খান মো. মাইনুল হাসান লিপন বলেন, ‘আমরা সর্বোচ্চ সাজা প্রত্যাশা করেছিলাম, তা হয়নি। কমিশনের সাথে আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’

জয়ের প্লট বাতিল করে যোগ্য আবেদনকারীদের পুনরায় বরাদ্দের নির্দেশ : রাজউকের পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের প্লট বাতিল করে ভূমিহীন ও যোগ্য আবেদনকারীদের পুনরায় বরাদ্দের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি মা-ছেলের বিভিন্ন মেয়াদে কারা ও অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এই রায়ের ফলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের অনুকূলে বরাদ্দকৃত পূর্বাচল নিউ টাউন প্রকল্পের প্লটের বরাদ্দটি বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে।

প্লট বরাদ্দে মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সুপারিশের বিধান বন্ধের নির্দেশ : সরকারি প্লট বরাদ্দের ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়কে ‘বিশেষ সুপারিশের বিধান’ অবিলম্বে বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।

সম্পদের প্রতি শেখ হাসিনার ‘এত লোভ’! বিস্মিত বিচারক : ঢাকার পঞ্চম বিশেষ জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেছেন, এখানে রাজউক এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় অন্যায় করেছে; শেখ হাসিনা অন্যায়ের সঙ্গে জড়িত, প্রতারণা করেছেন। শেখ হাসিনা একজন পলিটিক্যাল লিডার, চারবারের প্রধানমন্ত্রী। তার কেন এতো টাকা লাগবে, এতো সম্পদ লাগবে? ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্লট দুর্নীতির তিন মামলায় বৃহস্পতিবার রায় ঘোষণার আগে পর্যবেক্ষণে এ কথা বলেন বিচারক। বিস্মিত হয়ে তিনি এও বলেন, ‘তার সম্পদের প্রতি এত লোভ!’

হাসিনার পক্ষে আদালতে না লড়ার ঘোষণা পান্নার : মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে আদালতে না লড়ার ঘোষণা দিয়েছেন আইনজীবী জেড আই খান পান্না। গতকাল বৃহস্পতিবার নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে দেওয়া এক ভিডিও বার্তায় তিনি এ ঘোষণা দেন।

তিনি পোস্টে লেখেছেন: ‘যে আদালতের ওপর শেখ হাসিনার আস্থা নেই, সেই আদালতে আমি তার পক্ষে লড়াই করব না। আমি এই ভিডিও বার্তার মাধ্যমে বিষয়টি জানালাম। রাষ্ট্র আমাকে শেখ হাসিনার আইনজীবী হিসেবে যে নিয়োগ দিয়েছে তার ফরমাল চিঠি এখনো পাইনি। চিঠি পেলে আমি ফরমাল ওয়েতে পদত্যাগের বিষয়টি জানাব। সম্প্রতি আমার বন্ধু অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমানের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা হয়েছে। আমি এ মামলায় তার পক্ষে লড়ব।’ ভিডিও বার্তায় দুদকের মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত সজিব ওয়াজেদ জয় ও সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের পক্ষে আইনি লড়াই করার ঘোষণা দেন তিনি।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত