
দীর্ঘ ১৭ বছরের নির্বাসিত জীবনের অবসান ঘটিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে কেন্দ্র করে রাজধানীর কুড়িল-বিশ্বরোডের ৩০০ ফিট এলাকা বিশাল জনসমুদ্রে পরিণত হয়। গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা থেকে আসা লাখ লাখ নেতাকর্মী ও সমর্থকের পদভারে মুখর হয়ে উঠে পুরো এলাকা। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের স্রোত আরও বাড়তে, যার ফলে সড়কের দুই পাশ এবং মাঝখানের ডিভাইডারেও তিল ধারণের জায়গা পদখা যায় না। ব্যানার, ফেস্টুন, দলীয় পতাকা আর মুহুর্মুহু স্লোগানে পুরো ৩০০ ফিট এলাকায় এক অভূতপূর্ব উৎসবমুখর পরিবেশের সৃষ্টি হয়। প্রিয় নেতাকে স্বাগত জানাতে অনেক নেতাকর্মী দুদিন আগেই ঢাকা পৌঁছে এবং অনেকেই আগের রাতে এসেও ৩০০ ফিট এলাকায় খোলা আকাশের নিচে রাতযাপন করে। নেতাকর্মীদের এই আবেগ ও উদ্দীপনা প্রমাণ করে তারেক রহমানের ফেরা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে কতটা টানটান উত্তেজনা বিরাজ করছে।
দীর্ঘ ১৭ বছরের নির্বাসনের অবসান ঘটিয়ে দেশের মাটিতে পা রেখেছেন তারেক রহমান। এতে শুধু তার পরিবার ও দলের নয়, সমগ্র রাজনৈতিক অঙ্গনের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে তীব্র আবেগ, আশা ও প্রত্যাশার স্রোত। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের পর থেকেই লাখো নেতাকর্মী-সমর্থকের মধ্যে সৃষ্টি হয় উচ্ছ্বাস আর আবেগঘন পরিস্থিতি। এই আবেগঘন দৃশ্যের পেছনে রয়েছে দীর্ঘ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও ব্যক্তিগত সংগ্রাম, যা শুধু তারেক রহমানের জীবনের গল্প নয়, বরং বাংলাদেশের রাজনীতির এক জননেতার নতুন অধ্যায়ের সূচনা।
গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা ৪৩ মিনিটে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরে নামেন তারেক। তার সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী ডা. জুবাইদা রহমান ও মেয়ে ব্যারিস্টার জাইমা রহমান। বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে রাজধানীর ৩০০ ফিট এলাকার ৩৬ জুলাই এক্সপ্রেসওয়েতে গণসংবর্ধনায় যোগ দেন। বিমানবন্দর থেকে সংবর্ধনাস্থল- পুরো পথে ছিল লাখ লাখ নেতাকর্মীর স্রোত। তারেক রহমানও পুরো পথে সবাইকে হাত নেড়ে অভিবাদন জানান। এ যেন এক জনসমুদ্রে পরিণত হয়।
রাজনৈতিক জীবনে প্রবল আলোচিত ব্যক্তিত্ব সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান। ২০০৭-০৮ সালের রাজনৈতিক উত্তেজনার সময় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি পরিবারের সঙ্গে চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যান, যা পরে দীর্ঘ নির্বাসনে পরিণত হয়।
রাজনৈতিক দল ও সমালোচকরা বলছেন, তখনকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও বিচারিক চাপ তাকে বিদেশে থাকতে বাধ্য করেছিল। সেই সময়ের সরকারকে কিছু মহল সামরিক-সহায়তায় পরিচালিত বলে অভিহিত করেছিল, আর বিএনপি নেতারা দাবি করেছিলেন তাকে রাজনৈতিক কারণে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছিল। শুরুতে তিনি মাত্র কিছু মাসের জন্যই দেশ ছেড়েছিলেন। কিন্তু সেই সাময়িক প্রস্থান ধীরে ধীরে ১৭ বছরের দীর্ঘ নির্বাসনে পরিণত হয়, নিজেকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করতে হতে হয় লন্ডন থেকে। নির্বাসনে অবস্থানের সময়েও তারেক রহমান বিএনপির নেতৃত্বে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয় ছিলেন এবং দলের নেতাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। বিএনপি তাকে দলের ভবিষ্যৎ নেতা ও সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে দেখেছে।
তারেক রহমানের বিরুদ্ধেও একাধিক মামলা ও অভিযোগ ছিল, কিছু অভিযোগে আদালতে তার অনুপস্থিতিতে সাজা প্রদান করা হয়েছিল। তবে সেসব মামলা ও অভিযোগ বাদ পড়েছে। যার প্রেক্ষিত্রে আবারও প্রিয় মাতৃভূমিতে ফিরে আসার সুযোগ পেয়েছেন তিনি।
তারেক রহমানের দেশে ফেরাকে কেন্দ্র করে যেন এক বিশাল আবেগের তরঙ্গ সৃষ্টি হয়েছে। তিনি দেশের মাটিতে পা দেওয়ার অনেক আগেই বিমানবন্দর এলাকা ও শহরের বিভিন্ন জায়গায় লাখো নেতাকর্মী তাকে দেখতে, অভিবাদন জানাতে জড়ো হন।
অনেকে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। নেতাকর্মীদের ভাষায়, আজকের দিনটি এমন আবেগে ভরা যে, মনে হয় দীর্ঘদিনের অপেক্ষা আজ পূর্ণ হলো। তাদের মতে, তার এই প্রত্যাবর্তন শুধু একটি রাজনৈতিক অভিযান নয়, বরং একটি আস্থা ও পুনর্জাগরণের প্রতীক। তার ফিরে আসা বাংলাদেশে গণতন্ত্রের পথকে শক্তিশালী করবে এবং আগামী ফেব্রুয়ারির সাধারণ নির্বাচনে দলের শক্তি আরও দৃঢ় করবে।
তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সাক্ষী হতে আসা একজন আবেগজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, আজকের দৃশ্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি স্মরণীয় অধ্যায়। এটি নেতার দীর্ঘ নির্বাসনের পর দেশপ্রেমে উজ্জ্বল প্রত্যাবর্তন। তিনি বলেন, আজ তিনি শুধু একটি বিমানের যাত্রী হিসেবে নন, তিনি ফিরে এসেছেন একটি নতুন প্রত্যাশার প্রতীক হয়ে, নেতাকর্মীদের হৃদয়ে নতুন করে জীবন্ত হয়ে। এতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক আকাশ যেন নতুন আলোয় আলোকিত হয়েছে।
আরেকজন বলেন, আজকের দিনটি আমাদের জন্য ইতিহাসের এক স্বর্ণালী অধ্যায়। দীর্ঘ নির্বাসনের পর নেতা যখন দেশে ফিরে আসেন, তখন সাধারণ মানুষও তা শুধু নেতার নয়, দেশের জন্যও একটি বিজয় মনে করে। তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন আমাদের আবার একত্রিত করেছে এবং দলকে নতুন শক্তি দিয়েছে।
ছাত্রদলের নেতা আলমগীর হোসাইন বলেন, তারেক রহমানের ফিরে আসা আমাদের জন্য শুধু রাজনৈতিক ঘটনা নয়, এটি একটি আস্থা ও পুনর্জাগরণের প্রতীক। আমরা বহু দিন ধরে এই মুহূর্তের অপেক্ষায় ছিলাম। আজ তিনি আমাদের সঙ্গে আছেন, তাই মনে হচ্ছে বিএনপির শক্তি আরও দৃঢ় হবে এবং দেশের গণতন্ত্রের পথ শক্তিশালী হবে।
এর আগে এদিন সকাল ৯টা ৫৭ মিনিটে তারেক রহমানকে বহনকারী বিমানটি সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। সেখানে যাত্রাবিরতির পর তারেক রহমানকে বহনকারী বিমান বেলা ১১টা ৪০ মিনিটের দিকে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মাটি স্পর্শ করে। বিমানবন্দরে তারেক রহমানকে স্বাগত জানান দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা। এসময় তিনি নেতাদের সঙ্গে কোলাকুলি ও কুশলবিনিময় করেন এবং উপস্থিত সবার উদ্দেশে হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানান।
এরপর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে লাল-সবুজ বাসে করে ৩০০ ফিট এলাকার গণসংবর্ধনা মঞ্চে যান। সেখানে তিনি বক্তব্য রাখেন।
বিমানবন্দর টু ৩০০ ফিট -গাড়িবহর পৌঁছাতে লাগল তিন ঘণ্টা : ১৭ বছর নির্বাসিত জীবন শেষে দেশে ফিরলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। দেড় যুগেরও বেশি সময় পর নেতাকে কাছ থেকে দেখার অপেক্ষায় থাকা বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী ও উৎসুক জনতার ভিড় ছিল বিমানবন্দর থেকে সংবর্ধনাস্থল ৩০০ ফিট পর্যন্ত। যে কারণে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গণসংবর্ধনাস্থলে পৌঁছাতে ৩ ঘণ্টার বেশি সময় লেগেছে তারেক রহমানের গাড়ি বহরের।
তারেক রহমান লাল-সবুজ রংয়ের একটি বাসে করেই গণসংবর্ধনাস্থলে যান বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। বাসটির সামনে লেখা ‘সবার আগে বাংলাদেশ’। এই বাসের সামনে বসে তিনি নেতাকর্মীদের অভিবাদনের জবাবে হাত নাড়িয়ে তাদের শুভেচ্ছা জানান। এসময় বাঁধভাঙা উল্লাসে ফেটে পড়ে নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ। নেতাকর্মীরা স্লোগানে স্লোগানে মুখর করে রাখে পুরো এলাকা।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বক্তব্য চলাকালে তাকে এক নজর দেখতে সড়ক-ফ্লাইওভার, বাস ও ফুটওভার ব্রিজের ওপর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিএনপির নেতাকর্মীরা ভিড় করেন।