ঢাকা শনিবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২ পৌষ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মেঘনা বুড়িগঙ্গা ও রাঙ্গাবালীতে ৯ লাশ

* চাঁদপুরে মেঘনায় যাত্রীবাহী দুই লঞ্চের সংঘর্ষ, নিহত ৫ * বঙ্গোপসাগরে ট্রলারডুবি : নিখোঁজ বাবা-ছেলের লাশ উদ্ধার * ফতুল্লায় বুড়িগঙ্গায় নিখোঁজ দুই শ্রমিকের লাশ উদ্ধার
মেঘনা বুড়িগঙ্গা ও রাঙ্গাবালীতে ৯ লাশ

চাঁদপুরের মেঘনা নদীতে ঘনকুয়াশার মধ্যে এমভি অ্যাডভেঞ্চার-৯ লঞ্চের ধাক্কায় ভোলার চরফ্যাশন থেকে ঢাকাগামী এমভি জাকির সম্রাট-৩ লঞ্চের অন্তত ৫ জন যাত্রী নিহত হয়েছেন। এদিকে, পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলায় বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরার ট্রলার ডুবে নিখোঁজের দুই দিন পর বাবা-ছেলের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। এছাড়া ফতুল্লায় বুড়িগঙ্গায় নিখোঁজ দুই শ্রমিকের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এ নিয়ে মেঘনা, বুড়িগঙ্গা ও রাঙ্গাবালীতে ৯ জন নিহত হয়েছে।

চাঁদপুরে মেঘনায় যাত্রীবাহী দুই লঞ্চের সংঘর্ষ, নিহত ৫ : চাঁদপুরের মেঘনা নদীতে ঘন কুয়াশার মধ্যে এমভি অ্যাডভেঞ্চার-৯ লঞ্চের ধাক্কায় ভোলার চরফ্যাশন থেকে ঢাকাগামী এমভি জাকির সম্রাট-৩ লঞ্চের অন্তত ৫ জন যাত্রী নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও ১০ জন। নিহতদের মধ্যে ৪ জনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে। গতকাল শুক্রবার সকালে পরিচয় নিশ্চিতের বিষয়টি জানিয়েছেন ভোলার ইলিশা নৌ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ও?সি) সৈয়দ আশিকুর রহমান। পরিচয় শনাক্ত হওয়া চারজন হলেন- ভোলার লালমোহনের প?শ্চিম চর উম্মেদ ইউনিয়নের মো. মিলনের স্ত্রী রিনা বেগম (৪০), একই উপজেলার কা?জিরাবাদ গ্রামের আব্দুল গণি (৩৮), মো. সাজু (৪৫) ও চরফ্যাশন উপজেলার দুলারহাট থানা এলাকার আহম্মেদপুরের মো. হা?নিফ (৬০)।

লঞ্চের যাত্রী ও নৌ-পুলিশ সূত্রে জানা যায়, গত বৃহস্পতিবার বিকেলে চরফ্যাশনের ঘোষেরহাট ঘাট থেকে যাত্রী নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেয় এমভি জাকির সম্রাট-৩। গতকাল শুক্রবার রাত আনুমানিক ২টার দিকে চাঁদপুরের মেঘনা নদীতে পৌঁছালে প্রচণ্ড কুয়াশার কারণে লঞ্চটি গতি কমিয়ে দেয়। এসময় পেছন থেকে আসা বরিশালগামী অ্যাডভেঞ্চার-৯ লঞ্চটি সজোরে ধাক্কা দিলে জাকির সম্রাট-৩ লঞ্চের একপাশ দুমড়ে-মুচড়ে যায়। এতে এখন পর্যন্ত ৫ জ?ন নিহতের খবর পাওয়া গেছে। আর আহত হ?য়েছে অন্তত ১০ জন যাত্রী। দুর্ঘটনার পর ক্ষতিগ্রস্ত লঞ্চটি নিহত ও আহত যাত্রীদের নিয়ে ঢাকা সদরঘাটে পৌঁছায়। ভোলার ইলিশা নৌ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সৈয়দ আশিকুর রহমান জানান, ঘটনাটি চাঁদপুর জেলায় ঘটেছে। তবে আমরা নিহত ও আহতদের খোঁজ-খবর নিয়ে যাচ্ছি।

বঙ্গোপসাগরে ট্রলারডুবি- নিখোঁজ বাবা-ছেলের লাশ উদ্ধার : পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলায় বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরার ট্রলার ডুবে নিখোঁজের দুইদিন পর বাবা-ছেলের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। গতকাল শুক্রবার ভোরে সাগরের কাকমারা দ্বীপ এলাকার আলাদা স্থান থেকে তাদের লাশ উদ্ধার করা হয় বলে জানান রাঙ্গাবালী থানার ওসি মো. সিরাজুল ইসলাম। নিহতরা হলেন- মো. শামীম জোমাদ্দার (৪০) ও তার ১১ বছরের ছেলে সিয়াম জোমাদ্দার। তারা উপজেলার বড়বাইশদিয়া ইউনিয়নের চরগঙ্গা বাঁধঘাট বাজার এলাকার বাসিন্দা। ওসি সিরাজুল ইসলাম বলেন, বাবা ও ছেলের লাশের সুরতহাল করা হচ্ছে। এ বিষয়ে থানায় একটি ইউডি মামলা করা হয়েছে। এর আগে গত বুধবার মধ্য রাতে বঙ্গোপসাগরের ‘পাইপ বয়া’ এলাকায় হঠাৎ ঝড়ের কবলে পড়ে ট্রলারটি ডুবে যায়। এ সময় ট্রলারে থাকা ছয় জেলের মধ্যে চারজনকে অন্য একটি ট্রলার উদ্ধার করলেও দুইজন নিখোঁজ ছিলেন। উদ্ধার হওয়া জেলেরা হলেন- শামীমের বাবা মো. সিদ্দিক জোমাদ্দার (৫৮), মো. শাওন (২৪), মো. রাব্বী (১৮) এবং রাশেদ (২০)। উদ্ধার হওয়া জেলে শাওন সাংবাদিকদের বলেন, ২১ ডিসেম্বর সকাল ১০টার দিকে চরগঙ্গা বাঁধঘাট এলাকা থেকে ‘এফবি সিদ্দিক’ নামের একটি ট্রলার নিয়ে ছয়জন সাগরে ইলিশ ধরতে বের হই। দুই দিন পর বুধবার রাতে পাইপবয়া এলাকায় ট্রলার নোঙ্গর করে সবাই ঘুমিয়ে পড়ি। গভীর রাতে সাগরে হঠাৎ ঝড় উঠলে ঢেউয়ের তাণ্ডবে ট্রলারের তলা ফেটে পানি ঢুকতে থাকে। এক পর্যায়ে ট্রলারটি উল্টে গেলে আমরা সাগরে ভাসতে থাকি। এ সময় আমরা ভাসতে ভাসতে অন্য একটি ট্রলারে আশ্রয় নেই। তবে শামীম ও সিয়ামকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।

ফতুল্লায় বুড়িগঙ্গায় নিখোঁজ দুই শ্রমিকের লাশ উদ্ধার : ঘটনার প্রায় ১০ ঘণ্টা পর গতকাল শুক্রবার বিকেল পৌনে ৪টায় বাল্কহেডের ইঞ্জিন রুমের তলা থেকে উদ্ধার করা হয় নিখোঁজদের মরদেহ। পরে পাগলা নৌপুলিশের কাছে মরদেহ দুটি হস্তান্তর করা হয়। এর আগে ভোর ৬টায় সদর উপজেলার ফতুল্লা থানাধিন ধর্মগঞ্জ এলাকায় বুড়িগঙ্গা নদীতে বাল্কহেড ডুবির ঘটনা ঘটে। বুড়িগঙ্গা নদীর পূর্বপাড়ে স্বজনদের কান্না আর আহাজারিতে চারপাশের পরিবেশ ভারি হয়ে উঠেছে। দুপুর থেকে নিখোঁজদের উদ্ধারে অভিযান শুরু করে ফায়ার সার্ভিস, কোস্ট গার্ড, নৌপুলিশ ও বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ। বিকেল সাড়ে ৩টায় তাদের সঙ্গে উদ্ধার অভিযানে নামে স্থানীয় বেসরকারি ডুবুরি দল। মৃতরা হলেন- বাল্কহেডের দুই লস্কর মোহা. জহুরুল ইসলাম শাকিল (২৫) ও হাসান (২০)। শাকিলের বাড়ি পটুয়াখালী জেলায় এবং হাসানের বাড়ি ঝালকাঠি জেলার রাজাপুরে।

নৌপুলিশ নারায়ণগঞ্জ অঞ্চলের অতিরিক্ত ডিআইজি মো. আলমগীর হোসেন বলেন, ভোরে এম বি কাশফা স্নেহা নামে বালুবাহী একটি বাল্কহেড ফতুল্লার ধর্মগঞ্জ এলাকায় নদীর তীরে নোঙর করা ছিল। বরিশাল থেকে ছেড়ে আসা সুন্দরবন-১৬ নামে একটি যাত্রীবাহী লঞ্চ ঘন কুয়াশার কারণে বাল্কহেডটিকে দেখতে না পেয়ে পেছেন থেকে ধাক্কা দেয়। তখন বাল্কহেডটি নদীতে তলিয়ে গেলে ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা পাঁচজন শ্রমিক ডুবে যান। তবে তাদের মধ্যে তিনজন সাঁতরে তীরে উঠতে সক্ষম হলেও জহিরুল ও হাসান নিখোঁজ হন। খবর পেয়ে পাগলা নৌপুলিশ, কোস্টগার্ড ও ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল ঘটনাস্থলে পৌঁছে নিখোঁজদের উদ্ধারে অভিযান শুরু করে। পরে বিকেলের দিকে দুজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এস এম ফয়েজ উদ্দিন জানান, দুর্ঘটনার জন্য দায়ী লঞ্চটি আটক করে রাজধানীর সদরঘাটে রাখা হয়েছে। এ ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।

লঞ্চ দুর্ঘটনায় হতাহতদের জন্য অনুদানের ঘোষণা নৌ উপদেষ্টার : নৌপরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন লঞ্চ দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবারকে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং আহতদের চিকিৎসার জন্য ৫০ হাজার টাকা করে অনুদান দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। গতকাল শুক্রবার রাজধানীর সদরঘাটে দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত লঞ্চ পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান তিনি। এ সময় বস্ত্র ও পাট এবং নৌপরিবহন উপদেষ্টার দায়িত্বে থাকা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, আজকের ঘটনাটি দুঃখজনক। তিনি বলেন, সব ধরনের পরিবহনের মধ্যে নদীপথ তুলনামূলকভাবে নিরাপদ। তারপরও এ ধরনের দুর্ঘটনা মেনে নেওয়া যায় না। আমি নিজেও নিয়মিত নদীপথে যাতায়াত করি। লক্ষ্য করেছি, অনেক সময় রাতে লঞ্চ চলাচলের সময় লাইট ব্যবহার করা হয় না।

উপদেষ্টা জানান, দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আট সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। একই সঙ্গে ঘটনার সঙ্গে জড়িত দুই লঞ্চের দায়িত্বপ্রাপ্তদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তদন্ত শেষে প্রকৃত কারণ জানা যাবে। তিনি আরও জানান, এরইমধ্যে কয়েকটি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। রাতে কুয়াশার মধ্যে কোনো লঞ্চ চলাচল করতে পারবে না। রাতে কোথাও দাঁড়ালে অবশ্যই লাইট ব্যবহার করতে হবে। এ মৌসুমে বাল্কহেড সকাল ৮টার আগে চলাচল করতে পারবে না। এসব নির্দেশনা অমান্য করলে সংশ্লিষ্টদের গ্রেপ্তার করা হবে। নৌ উপদেষ্টা বলেন, এ ধরনের দুর্ঘটনা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। ঝড় বা তুফানে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, কিন্তু যেভাবে দু’টি লঞ্চের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে, তাতে মনে হয় চালক ঘুমিয়ে পড়েছিলেন অথবা অন্য কাউকে দিয়ে লঞ্চ চালাচ্ছিলেন। তবে তদন্ত ছাড়া নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যাবে না। তিনি বলেন, ভবিষ্যতে কোনো লঞ্চ চালক সঠিকভাবে লঞ্চ পরিচালনা না করলে, রাতে লাইট ব্যবহার না করলে বা নির্দেশনা অমান্য করলে তাদের রুট পারমিট ও লাইসেন্স বাতিল করা হবে।

মেঘনায় দুই লঞ্চের সংঘর্ষ- আট সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন : চাঁদপুরে মেঘনা নদীতে যাত্রীবাহী দুটি লঞ্চের মুখোমুখি সংঘর্ষে হতাহতের ঘটনায় আট সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠনের কথা জানিয়েছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। গতকাল শুক্রবার মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। এতে বলা হয়, নৌপরিবহন উপদেষ্টা এম. সাখাওয়াত হোসেন শুক্রবার সকালে ঢাকার সদরঘাটে দুর্ঘটনাকবলিত লঞ্চ পরিদর্শন করেছেন। সেখানে উপদেষ্টা বলেন, তদন্ত কমিটিকে সাত কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে হবে। ‘এডভেঞ্চার-৯’ লঞ্চের পাঁচ কর্মীকে পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। ‘তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

দুর্ঘটনায় ‘এমভি জাকির সম্রাট-৩’ লঞ্চটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ঘটনায় নিহত হন লঞ্চটির চার আরোহী; আহত হন বেশ কয়েকজন। নৌ উপদেষ্টা হতাহতদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেন এবং সমবেদনা জানান। উপদেষ্টা জানান, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবারকে এক লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং আহতদের চিকিৎসায় ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া দায়ী লঞ্চ মালিকের কাছ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে।

ঘনকুয়াশায় লঞ্চ না চালানোর নির্দেশনা দিয়ে উপদেষ্টা বলেন, প্রত্যেক লঞ্চের ফগ লাইট ও সাইড লাইট নিশ্চিত করতে হবে। তিনি প্রত্যেক লঞ্চের ফিটনেস ও লাইসেন্স তদারকির জন্য নৌপরিবহন অধিদপ্তরকে নির্দেশনা দেওয়ার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সবাইকে আরও দায়িত্বশীল হওয়ার আহ্বান জানান। উপদেষ্টার সঙ্গে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. নূরুন্নাহার চৌধুরী ও বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল আরিফ আহমেদ মোস্তফাও উপস্থিত ছিলেন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত