
দীর্ঘ ১৯ বছর পর বাবা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের কবর জিয়ারত করেছেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। গতকাল শুক্রবার বিকেল ৪টা ৩০ মিনিটে শেরেবাংলা নগরে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও বাবা জিয়াউর রহমানের মাজার জিয়ারত করতে আসেন তারেক রহমান। প্রথমেই বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সুস্থতা ও ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানে শহিদদের আত্মার শান্তি কামনা করে দোয়া করা হয়। পরে বাবার কবরের সামনে দাঁড়িয়ে দু’হাত তুলে আল্লাহতায়ালার দরবারে মোনাজাত করেন তারেক রহমান। কবরের সামনে কিছু সময় তিনি নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন এবং সূরা ফাতিহা পাঠ করেন। এ সময় তাকে চোখ মুছতে দেখা যায়। এ সময় বিএনপি মহাসচিবসহ দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য এবং কেন্দ্রীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তৎকালীন সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব থাকাকালে ২০০৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর দলটির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মাজারে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
দলটির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবীর খান বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এর আগে দুপুর ২টা ২০ মিনিটে গুলশানের বাসা থেকে বাবার করবের উদ্দেশ্যে রওনা হন তারেক রহমান। লাল-সবুজ রঙে সাজানো ‘সবার আগে বাংলাদেশ’ নামক বিশেষ নিরাপত্তা-বেষ্টিত বাসে চড়ে তিনি শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের কবর জিয়ারত করতে আসেন। এর আগে গত বৃহস্পতিবার এ বাসেই তিনি বিমানবন্দর থেকে গণসংবর্ধনাস্থলে যান। ওইদিনের মতো গতকালও তারেক রহমান বাসের সামনে দাঁড়িয়ে নেতাকর্মীদের উদ্দেশে হাত নাড়েন। তারেক রহমানের আসা উপলক্ষে গতকাল সকাল থেকেই ঢাকার শেরেবাংলা নগরের জিয়া উদ্যান ও আশপাশের এলাকায় বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের কয়েক হাজার নেতাকর্মী লক্ষ্য করা গেছে। কারও হাতে ছিল দলীয় পতাকা, কেউ ব্যানার ও পোস্টার হাতে মিছিল নিয়ে এসে একসঙ্গে জড়ো হন। এ সময় নেতাকর্মীরা স্লোগান ধরেন- ‘এক জিয়া লোকান্তরে, লক্ষ জিয়া ঘরে ঘরে; আজকের এই দিনে, জিয়া তোমায় মনে পড়ে; তারেক রহমান বীরের বেশে, আসছে ফিরে বাংলাদেশে।’
তারেক রহমানের বাবার কবর জিয়ারতকে কেন্দ্র করে বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে এক ধরনের আবেগও দেখা গেছে। তারা বলেন, বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে জিয়াউর রহমান, যা বাস্তবায়ন করেছে বেগম খালেদা জিয়া, তারেক রহমানের হাত ধরে তা এখন প্রস্ফুটিত হবে। নির্বাচনকেন্দ্রিক জটিলতাসহ দেশের সকল ধোঁয়াশা তারেক রহমানের আগমনে তা কেটে গেছে। নেতাকর্মীরা জানান, এটি শুধু একটি আনুষ্ঠানিক শ্রদ্ধা নিবেদন নয়, বরং দলের জন্য একটি ঐতিহাসিক ও প্রতীকী মুহূর্ত।
গতকাল শুক্রবার দুপুর ২টায় শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মাজার প্রাঙ্গণে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের হাত ধরে দেশ গণতান্ত্রিক যাত্রার পথে এগিয়ে যাবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘তারেক রহমানের হাত ধরে দেশ গণতান্ত্রিক যাত্রার পথে এগিয়ে যাবে। তার রাজসিক প্রত্যাবর্তন সেই বার্তাই বহন করে।’ তার নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনেরও প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এ উপলক্ষে শেরেবাংলা নগর এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। জিয়ার সমাধি ও আশপাশের সড়কে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন করা হয়। প্রবেশপথগুলোতে তল্লাশি চৌকি বসানো হয়েছে। দলীয় স্বেচ্ছাসেবকরাও শৃঙ্খলা রক্ষায় দায়িত্বপালন করেছেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, গতকাল দুপুরের আগেই জিয়া উদ্যান সংলগ্ন রাস্তাগুলোতে জনসমাগম বাড়তে থাকে। নিরাপত্তাজনিত কারণে নেতাকর্মীদের নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও স্বেচ্ছাসেবকদের তৎপরতায় পরিস্থিতি ছিল নিয়ন্ত্রিত। গত বৃহস্পতিবার তারেক রহমান বাংলাদেশ বিমানের বিজি-২০২ ফ্লাইটে দেশে ফেরেন। তিনি লন্ডন থেকে সিলেট হয়ে গতকাল বেলা ১১টা ৪৩ মিনিটে ঢাকায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছান। সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী ডা. জুবাইদা রহমান ও একমাত্র মেয়ে জাইমা রহমান। ঢাকা বিমানবন্দর থেকে পূর্বাচলের ৩০০ ফিটে যেতে যানজট না থাকলে আধা ঘণ্টার বেশি সময় লাগে না। গতকাল তারেক রহমানের সেই পথে যেতে সময় লেগেছে তিন ঘণ্টা। কারণ, রাস্তার দুই ধারে নেতাকর্মী-সমর্থকদের সারি, মানুষের ঢল।
কেবল নেতাকর্মী নন, অনেকেই এসেছেন ১৭ বছর পর দেশে ফেরা তারেক রহমানকে একপলক দেখার কৌতূহল নিয়ে, কেউবা প্রত্যাবর্তনের একটি স্মরণীয় দিনের সাক্ষী হতে। বিমানবন্দর থেকে পূর্বাচলের সংবর্ধনা মঞ্চ পর্যন্ত পথ যেন লোকারণ্য হয়ে ওঠে।
তারেক রহমানের পক্ষে জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন : বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পক্ষে সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন দলের নেতারা। তারেক রহমান গতকাল শুক্রবার সূর্যাস্তের আগে না পৌঁছানোর কারণে নেতারা বিকেল ৫টা ৬ মিনিটে শ্রদ্ধা জানান। বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান এ তথ্য জানান। মহান মুক্তিযুদ্ধের শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনে অংশ নেন বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর রায়, ড. আব্দুল মঈন খান, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য আমানউল্লাহ আমান, ঢাকা জেলা বিএনপির সভাপতি খন্দকার আবু আশফাক, সাধারণ সম্পাদক নিপুণ রায় চৌধুরী, নেতা ডা. দেওয়ান মোহাম্মদ সালাউদ্দিন, তমিজউদ্দীন, ইয়াসিন ফেরদৌস মুরাদ, আইয়ুব খান, মেজর জেনারেল (অব.) ফজলে এলাহী আকবর ও মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান। দেশে ফেরা তারেক রহমান গতকাল বিকেলে তার বাবা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবর জিয়ারত করেন। তিনি পৌনে ৫টার দিকে রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের জিয়া উদ্যানে অবস্থিত জিয়াউর রহমানের সমাধিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। সেখান থেকে তিনি সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধের পথে রওনা দেন।
তারেক রহমান এর আগে জনভোগান্তির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে দুপুরে গুলশান অ্যাভিনিউয়ের ১৯৬ নম্বর বাসায়ই জোহরের নামাজ আদায় করেন। তিনি দুপুর ২টা ৫৪ মিনিটে বাসা থেকে জিয়া উদ্যানের উদ্দেশ্যে রওনা হন। গুলশান-২ গোলচত্বর হয়ে বনানী, সেখান থেকে মহাখালী ফ্লাইওভার, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় এলাকা, বিজয় সরণি ও বিমানচত্বর অতিক্রম করে জিয়া উদ্যানে যান।
তিনি বিকেল ৪টা ৪০ মিনিটে সমাধিস্থলে প্রবেশ করেন। এসময় উদ্যান ও আশপাশের এলাকায় উপস্থিত দলীয় নেতাকর্মীরা রাস্তার দুই পাশে দাঁড়িয়ে তাকে অভিবাদন জানান এবং বিভিন্ন স্লোগান দেন। তখন নিরাপত্তায় সেনাবাহিনী, পুলিশ, র্যাব, এপিবিএন ও বিজিবি সদস্যরা দায়িত্ব পালন করেন।
স্মৃতিসৌধ ও জিয়া উদ্যান প্রাঙ্গণ ঢেকে ফেলা হয় নিরাপত্তার চাদরে : তারেক রহমানের আগমনকে কেন্দ্র করে ঢাকার সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধ এলাকায় কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়। স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণ ঢেকে ফেলা হয় কয়েক স্তরের নিরাপত্তার চাদরে। সকাল থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয় স্মৃতিসৌধে সাধারণ দর্শনার্থীদের প্রবেশ। ৯টা পর্যন্ত জাতীয় স্মৃতিসৌধের অভ্যন্তরে সাংবাদিকদের প্রবেশ করতে দেওয়া হলেও সকাল সাড়ে ৯টার পর থেকে স্মৃতিসৌধের ভিতরে আর কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। এছাড়াও জাতীয় স্মৃতিসৌধ কমপ্লেক্সের অভ্যন্তর ছাড়াও স্মৃতিসৌধের গেট ও সংলগ্ন সড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে সতর্ক অবস্থানে দায়িত্ব পালন করে র্যাব, পুলিশ, বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। অন্যদিকে তারেক রহমানের আগমনকে কেন্দ্র করে স্মৃতিসৌধের সামনে ভিড় করতে শুরু করে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। জাতীয় স্মৃতিসৌধের ইনচার্জ ও সাভার গণপূর্ত বিভাগের উপ-সহকারী প্রকৌশলী আনোয়ার হোসেন খান আনু বলেন, ‘সকাল থেকে স্মৃতিসৌধে সর্বসাধারণ ও দর্শনার্থীদের প্রবেশ বন্ধ রয়েছে। বিকেল ৩টায় সিএসএফ স্মৃতিসৌধের নিরাপত্তার বিষয়টি দেখবেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ফিরে যাওয়ার পর স্মৃতিসৌধ দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। এদিকে, তারেক রহমানের জিয়া উদ্যান ও সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে আগমন উপলক্ষে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মোতায়েন করা হয়। গতকাল শুক্রবার দুপুরে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) জনসংযোগ কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার্থে জিয়া উদ্যান ও সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধসহ ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে পর্যাপ্ত সংখ্যক বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।